বাংলা ছোটগল্প - সেদিন তুমি ও আমি
এখন ভোর চারটা দশ মিনিট। একটু পরেই ব্যবসায়ের কাজে চট্টগ্রাম যেতে হবে। শিশির ঘুমিয়ে থাকার ভান করেছে। আমি জানি ওর ঘুম ভেঙ্গে গেছে। আমি ঘুম থেকে জাগবার আগেই। আমি যদি ওঠে না পড়তাম, ও নিজেই আমার সাথে দুষ্টুমি করতে করতে জাগিয়ে দিত। প্রথমে আমার গালে সামান্য স্পর্শ করে, অথবা ওর সুদীর্ঘ চুলের কয়েকটা দিয়ে আমার মুখ, কান ও নাকে সুরসুরি দিত। তারপর বলতো, ‘ওঠো, আমায় ছেড়ে চলে যাবার সময় হলো।’ অভিমানী চোখ দু’টো তখন ভারী হয়ে আমায় আপ্লোত করত।
লাফ দিয়ে ওঠে বিছানায় বসে একমুহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে কাছে এসেই জড়িয়ে ধরল। প্রতিবারই ও এমন এক এক্সপ্রেশনে থাকে যেন আমি কয়েক বছরের জন্য ওকে ছেড়ে যাচ্ছি। অথচ আমি মাঝে মাঝে ব্যবসায়ের কাজে বিভিন্ন জায়গায় যাই।
দরজায় দাড়িয়ে আমার চলে যাবার দৃশ্য দেখবে। সামান্য দূরে গিয়ে পিছন ফিরে হাতে ইশারা দিয়ে বললাম, দরজা লাগিয়ে শুয়ে পড়ো। একটু পড়েই আযান দিবে মসজিদে। চারিদিকে শুনশান আওয়াজ আর ঘুটঘুটে অন্ধকার। অনেক পথ পায়ে হেটে যেতে হবে।
যখনই কোথাও যাবো, ও তখনই এমনভাবে ইমোশনাল হয়ে যায়, যা আমাকে অনেক ভাবিয়ে তুলে। এখন আমি তাই ভাবছি। অন্ধকারে জোনাকিদের দেখতে ভাল লাগে। সবার ভাল লাগা একরকম নয়। যেমন এই অন্ধকারে শিশির যদি জোনাকিদের দেখতো হয় ভয়ে আত্মহারা হয়ে যেত।
আমার ভয় অনেক কম। প্রায়ই আমি এমন শেষ রাতে অথবা মধ্যরাতে আমি একা চলাফেরা করি। একদিন অবশ্য একটা বেড়াল আমায় সামান্য ঝাঁকি দিয়েছিল। মানে গা শিউরে ওঠে ছিল। আমি যে পথে হেটে যাচ্ছি, সেই পথটা অনেক দীর্ঘ আর মাঝপথে কোন বাড়িঘর নেই। রাস্তার দুই পাশে বড় বড় মেহগনি ও কড়ই গাছ। দৈত্যের হাতের মতো ডালপালা চারিদিকে ছড়িয়ে রেখেছে। এমন নির্জন জায়গায় হঠাৎ ঝোঁপ থেকে একটা কালো বেড়াল বেড়িয়ে এলো, মোবাইলে টর্চ জ্বেলে আমি ওকে দেখলাম। আমার দিকে এমনভাবে তাকালো এর চোখদুটো ভয়ংকরভাবে জ্বলে ওঠলো।
তবে আমি দেখলাম তাকে কিছু সময় ধরে। হয়তো আমার উপর কিছুটা বিরক্ত হয়েছিল, আমি ওর চোখে আলো ধরেছি বলে। বিরক্ত ভাব নিয়ে হেটে চলে গেল। কিন্তু আমি প্রথমবার কিছুটা ভীত হয়ে ছিলাম।
ভাবতে ভাবতে স্টেশনে চলে আসলাম। গাড়ির টিকেট কেনা হয়ে গেছে। গাড়ির সীটে বসতে না বসতেই শিশিরের ফোন কল।
-কী গো, ওঠেছো গাড়িতে?
-হ্যা। মাত্রই ওঠলাম। তুমি ঘুমাওনি?
- তুমি কোথাও যাবার সময় আমি কি কখনো ঘুমাই?
- কিন্তু দিনের বেলায় যে তোমার ঘুম পাবে, তখন তো কাজের চাপে ঘুমানোর সময় পাবে না।
- না পেলে নাই। তুমি কবে আসবে বলো।
আমি একটু রসিকতা করে বললাম,
- এইতো বাড়িতে আসার জন্য গাড়িতে ওঠেছি, আজই চলে আসব।
- লায়ার, চট্টগ্রাম যাবে বলে গাড়িতে ওঠেছো। আর মিথ্যে বলতে হবে না।
আমি যে রসিকতা করেছি, এটা হয়তো ও বুঝতে পারেনি। তাই সিরিয়াস হয়ে বলছে মিথ্যে বলছি।
-আমি একসপ্তাহ পর আসবো সোনা। মন খারাপ করোনা।
- মন খারাপ করবো কেন, তুমি তো আর সখ করে আমায় ছেড়ে যাচ্ছ না।
আমি জানি ও যতই মুখে বলুক, মন খারাপ না কিন্তু ওর মনটা অনেক খারাপ।
আমি বললাম, জানো সকাল বেলার পরিবেশটা না অসম্ভ উপভোগ করার মতো।
- তুমি করো উপভোগ। আমার খুব খারাপ লাগছে।
- হাহ্, একটু আগেই না বললে তোমার মন খারাপ না।
- আচ্ছা একটা গান শোনাবে?
- এ কেমন আবদার সোনা, আমি না গাড়িতে বসে আছি। গান গাইলে লোকে কী বলবে?
- বললে বলবে। তাতে কী?
- আচ্ছা, তোমার কী একটা কথা মনে আছে, আমাদের বিয়ের সময় কী হইছিল?
- দরকার নেই মনে থাকার। তুমি আমায় গান শোনাবে কিনা বলো?
শিশির প্রায়ই এমনভাবে কথা বলে। আসলে ও ইচ্ছে করেই এ কাজটা করে। ও ভাবে আমি ওর এমন আবদারে বিরক্ত হবো অথবা সিরিয়াস হয়ে যাবো। আর আমিও মাঝে মাঝে ওর মনের সুপ্ত ইচ্ছাটা পূরণ করার জন্যে হলেও বিরক্ত হবার ভান করি। আবার আমি যে অন্য কথা বলে তার আবদার এড়িয়ে যেতে চাই, সেটা সে সহজেই বুঝতে পারে। এটা নেহাতই তার একটা ছেলেমানুষি। আবার নিজে থেকেই বলবে,
- আচ্ছা কি যেন বলবে বললে, বলো এবার।
আরেকটু বেশি আগ্রহ দেখাবার জন্যে আমি তাকে বললাম- আরে কিছু না। এমনি বলছিলাম, তোমার কথা এড়িয়ে যাবার জন্যে।
- কখনো না। আমি তোমায় চিনি। তুমি কিছু বলতে চাইছ মানে বলতেই চাইছ। বলো বলো।
- তোমার আমার যখন বিয়ের তারিখ ঠিক করা হলো, তখনকার ঘটনাটা মনে আছে?
- থাকবেনা আবার। সে তো স্মরণীয় ঘটনা।
No comments:
Post a Comment
Thanks for your comment