অবস্থান
মোঃ অলিউল্লাহ
সময়ের স্রোতে ভেসে যায় প্রাচীন-অর্বাচীন, বদলে যায় চিরচেনা প্রকৃতি ও পরিবেশ, বিলুপ্ত হয়ে যায় টিকে থাকার লড়াইয়ে হেরে যাওয়া পৃথিবীর অসংখ্য প্রাণ। টিকে থাকার লড়াইয়ে যারা একটু বেশি এগিয়ে, তারাই সব থেকে মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ। বিলুপ্ত হওয়া পৃথিবীর সকল উপাদানের কথা শুধু পাঠ্য বই, যাদুঘর, উইকিপিডিয়া এবং কিছু নস্টালজিক মানুষের স্মৃতিতে ধারন করে।
বিদ্যমান অস্তিত্বের সকল প্রাণীই হয়তো আধুনিক। ইদানিং আধুনিক কথাটাও কেমন সেকেলি মনে হয়। এই শব্দটাতেও কেমন জড়িয়ে গেছে আদীমতা। প্রজন্মকেও মানুষ টপকে যেতে পারে, তবে পরবর্তীকালে নিজেকে কোন না কোন প্রজন্মের ভিতর করে আবদ্ধ। তানাহলে যে আইডেনটিটি ক্রাইসিসে বাধা পড়ে যাবে। কারণ পৃথিবীর সকল উপাদানই যে কোন না কোন স্থান, কাল, পাত্রবেধে সুনির্ধারিত।
ইতিহাসের পাতায় পাতায় সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও যুগের বিবর্তনের কথা উল্লেখ রয়েছে। আমরা গতানুগতিক জীবনধারা ও অদ্যোপ্রান্ত বিবেচনা করলে, নিজেদের একটা সময়ে ফেলতে হয়। সময়ের দাবীতে আমরা আধুনিকতাকে হারিয়েছি নান্দনিকতায়। সেই অর্থে আমরা উত্তরাধুনিক কিংবা তাকেও অতিক্রম করার পথে।
তবে হিসাবটা একটু অন্যভাবে করলে দেখবো কিছু দিক থেকে আমরা আবার আদীমের দিকেই ফিরে যাচ্ছি। যেমন আমাদের পোষাক পরিচ্ছেদ, প্রাচীনকালে গাছের ছাল ও পশুর চামড়া পরিধান করে মানুষ তাদের শরীরকে আবৃত করতো। সেই পোষাকের যে বৈশিষ্ট ছিলো সেটা ছিলো সময়োপযোগী। আমাদের বর্তমানের ফ্যাশন ডিজাইনাররা হয়তো সেই পথেই হাটছেন। সভ্য জাতির মধ্যে স্টাইল কিংবা ফ্যাশনেবল ডিজাইন উপহার দিতে গিয়ে এ যুগের নারী-পুরুষকে সাজাচ্ছেন অর্ধ-উলঙ্গ করে।
খাদ্যাভ্যাসেও আমরা কিছু দিক দিয়ে সেই দিকেই যাচ্ছি। প্রাচীনকালে বেঁচে থাকার জন্যে মানুষ বিভিন্ন পশুপাখি পুড়িয়ে খেতো। ইদানিং আমরা বারবিকিউ নামে পাখি ও মুরগি পুড়িয়ে খাওয়ার প্র্যাক্টিস করছি। যাক, মজা করেই দু’য়েকটা কথা বললাম। মজা দেখা এবং মজার করার মধ্যে একধরনের আনন্দ আছে।
সেদিন ইজি বাইকে করে বাজারে যাচ্ছিলাম। স্বাভাবিকভাবে ঐ ইজিবাইকে ছয়জন যাত্রী বসতে পারে। কিন্তু সেখানকার ড্রাইভাররা সবসময় আটজনকে নিয়ে জোরপূর্বক যাতায়াত করে। এতে সাধারণ মানুষের কি ভোগান্তি হলো, তা দেখার সময় নেই ওদের। সমাজকর্তাদেরও সে ব্যাপারে দায় নেই।
যাত্রীদের মধ্যে দুইজন দোকান্দার , চারজন খেটেখাওয়া কৃষক পর্যায়ের, একজনের পেশা চিহ্নিত করা গেল না। সবার মধ্যে একধরনের অস্বস্তিবোধ দেখতে পেলাম। সবার কথা ঠিকভাবে বোঝা যাচ্ছিল না। যতদূর বুঝতে পারলাম, একজন বলল- ‘গাড়ির যেই অবস্তা, যেইকোনো সময় খালে পইড়াযাইবোগা।’
অন্যজন বলল,‘পইড়ে গেলে জানি ডাইন দিহে পড়ে, তাইলে শিশু কাহায় নিচে পড়বো। শিশু কাহার শইলে যেই শক্তি, গাড়ির নিচে পড়লেও কিছু অইতোনা।’
পাশে বসা দোকান্দার বলল- ‘হ ঠিক কইছস, শিশু কাহায় সত্তর বছরেও কি শক্তি গত্তরে। কিন্তু আড্ডি ছাড়া আর কিছু শইলে দেখা যায় না।’।
যাকে নিয়ে কথা হচ্ছে, সে সব কথা শুনছে আর মুচকি হাসছে। কারণ সে জানে তার বয়স অনেক হয়েছে, শরীরে শক্তি বলতে আর বেশি নেই। তাই লোকে তাকে নিয়ে হেয়ালি করে।
মধ্য বয়সী সেই ভদ্র লোকটি বলে উঠলো,‘দুনিয়া পাল্ডাই গেছেগা। এহন আগের মতো আর মানুষের মইধ্যে মায়া নাই। কেউ মইরা গেলেও কারো কিচ্ছু আইয়ে যায়না। আগের দিনে কুত্তাগুলা মাইনসের গু খাইতো। এহন আর কুত্তা গু খায়না, কারন মাইনসে ঘুষ খায়, সুদ খায়, পারলে মাইনসেরে ধইরা মাইনসে খায়। আগে গরু মরলে হাজার হাজার হুগুন মাডিতে নাইম্মা আইতো, এহন আর হুগুন মাডিতে নামেনা। উপরে থাইক্কা মাইনসের তামসা দেহে। মরা গরুর গোসতও মাইনসে খাইয়া লায়, হুগুন আর কি খাইবো।’
কিছুটা অবাক হয়েই দেখলাম ওনাকে। পাল্টে যাওয়া পৃথিবীর প্রত্যক্ষদর্শী। আমার এক স্যার ছিলো, বাতেন স্যার। ওনি বলেছিলো, ‘আমরা এখন অনেক আধুনিক। ছোট বেলায় মা ডিম ভেজে দিতো। আমরা বলতাম, ভাজা। আরো আছে সিদ্ধ ও আধা সিদ্ধ ডিম। কিন্তু এখন আমরা ইংরেজদের মুখের থুথু ফেলার সাথে সাথে যে ইংরেজি ভাষা বের হতো, সেই কয়েকটা ভাষা শিখে সেইসব খাবারকে বলি ওমলেট, মামলেট ....। আমাদের দেশের বিএ, এম এ পাশ করা ছেলেটা দশ হাজার টাকা বেতনে চাকরিতে ঢুকে। তাও আবার শতকরা দশজন। আর নব্বইজন বেকার। কিন্তু খেলার মাঠে যেই ছেলেটা কোনদিন স্কুলে যায়নি, কোন কাজ শিখে নি, সেই ছেলে বাম হাত ঘুরিয়ে একটা বল করে আরেকজন ব্যাট ধরে পিটায়। ওদের আয় মাসে লাখ টাকার ওপরে।
আমাদের দেশেও বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো রয়েছে ক্লাসিফিকেশন। আমরা মানুষের জীবদ্দশায় তাদের কয়েকটা শ্রেণিতে বিভক্ত করে থাকি। উচ্চবৃত্ত, মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত। আরো আছে উচ্চ মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত। কিন্তু এই পৃথিবীর কিছু মানুষ আছে যারা জীবন যাপন করছে ঠিকই, কিন্তু সে আদৌ জানে না, সে আসলে কোন শ্রেণী বিলং করছে।
স্বাভাবিক শারিরীক গঠন নিয়ে যেসব মানুষ তাদের সচেষ্টা দ্বারা অর্থ আয় করে এবং সেইরূপে জীবন যাপন করে তাদের নিজস্ব একটা ব্যক্তি পরিচয় বা সমাজে একটা অবস্থান তৈরী হয়। কিন্তু যদি বলা হয়, একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের কথা, বিভিন্ন রকমের প্রতিবন্ধীসহ যারা বামুন কিংবা শারীরিকভাবে অস্বাভাবিক গঠনের তাদের জীবনের প্রতিটা দিন যে কতটা দুর্বিসহ আর প্রতিকূলতায় আবদ্ধ তা নির্ণয় করা সম্ভব নয়। তাদের বেঁচে থাকার অর্থটা হয়তো কোন ডিকশনারীতে পাওয়া যাবেনা।
তাহলে তারা কোন শ্রেণীতে পড়ে? আমাকে অনেক ভাবতে হবে। আপনাদের ভাবতে হবে কিনা জানিনা। আমরা যারা প্রতিনিয়ত আমাদের ছোট ছোট সমস্যাগুলো নিয়ে এত বেশী চিন্তিত, সেখানে তাদের সমস্যা নিয়ে তাদের অনুভূতি কি হতে পারে?
আমাদের দিনদিন তৈরী হচ্ছে বৈরী মনোভাব, প্রতিহিংসার অস্থিরতা, টিকে থাকার লড়াই, হারজিতের প্রতিযোগিতা আর বেড়ে চলছে নোংরা রাজনীতি ও অসুস্থ মানসিকতা।
আমাদের আতংক এখন ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, জলোচ্ছাস কিংবা বন্যার পর মহামারি নয়। প্রাকৃতিক প্রকৃতি আমাদের ভীত করতে না পারলেও মনুষ্য প্রকৃতির নিয়ে আমরা মারাত্মক ভীত।
পৃথিবীতে এমন প্রাণী হয়তো দু’য়েকটা মিলবেনা যে প্রাণী সমগোত্রীয় শিশু প্রাণীর উপর জৈবিক চাহিদা কিংবা রিপুর তাড়নায় ঝাপিয়ে পড়েছে। কিন্তু মানুষের মধ্যে এমন পাশবিক ও নোংরা মানসিকতা দেখা যায় যে, সাত বছরের একটা বাচ্চা মেয়েকেও ধর্ষণ করতে ছাড় দেয় না। কোন গর্ভবর্তী নারীকেও কিছু নরপশু ধর্ষণ করার জন্য ঝাপিয়ে পড়ে।
সকল প্রাণীই কোন না কোন মাধ্যমে জীবন টিকিয়ে রাখে। তাদের মধ্যেও সামাজিক অবস্থান নিয়ে শ্রেণী বিভক্তি আছে কিনা আমার সন্দেহ আছে।মানুষের তথাকথিত ব্যক্তিত্ববোধের কাছে উচু-নিচু ভেদাভেদ আর শ্রেণী বৈষম্য খুবই সার্বজনিন।
এখানে কেউ যদি টাকার বিনিময়ে মানুষ হত্যা করে আর তা যদি ক্ষমতাবলে গোপন রাখতে পারে, তাহলে তার সামাজিক মর্যাদা রয়ে যায় অক্ষুন্ন।
কিন্তু কয়েকটা বখাটে ছেলে জোর করে একটা মেয়েকে ধর্ষণ করলে, তাকে বেছে নিতে হয় মৃত্যুর পথ কিংবা গৃহহীন হয়ে বাড়ি ছেড়ে দূরে গিয়ে থাকতে হয়। সেখানেও তার মুক্তি নেই, সুযোগের ব্যবহার করে সুশীল শ্রেণীর কিছু মানুষ তাকে বাধ্য করে বেশ্যা হিসাবে পরিণত হতে। সেখানে সারাজীবন তাকে বাচঁতে হয় মুখ লুকিয়ে, কোন রকম সামাজিক মর্যাদা না পেয়ে। তাকে কোন শ্রেণীতে রাখা যায় কি?
এ দেশের সকল পাগল ব্যক্তিরা কোন শ্রেণীর। যারা দিন-রাত উদ্দেশ্যহীনভাবে জীবন যাপন করে। যারা জানেনা অতীত কি, বর্তমান কি আর ভবিষ্যত কি। যারা কালকের জন্য স্বপ্ন দেখার মানে বুঝে না। যারা জীবন মৃত্যুর মাঝামাঝি পার্থক্য বুঝেনা, তাদের কথা কী বলা যায়? অথচ এই জগৎ সংসারই কিনা তাদের এই অবস্থার জন্য দায়ী।
আধুনিকতার মোড়কে আমরা নিজেদের বেধে নিয়েছি ঠিকই, সত্যিকারের আধুনিক কি আমরা হতে পেরেছি? ডিজিটাল যুগের নানা রকম ইলেক্ট্রনিক যন্ত্র আবিষ্কার করে এবং তা ব্যবহারের মধ্য দিয়ে মানুষকেও একধরনের যন্ত্রে পরিণত করলো এই যান্ত্রিকতা। শুধু তাই নয়, দৈনন্দিন সকল যন্ত্র ও সামাজিক মাধ্যমে বিক্রি করা হচ্ছে আমাদের জীবনের সকল মূহুর্তকে। হাসি, কান্না, অভিমান ও অনুভূতির নানা অভিজ্ঞতা দ্বারা আমরা হয়ে ওঠেছি পন্য, আমরাই ক্রেতা আবার আমরাই বিক্রেতা। কত বৈচিত্র এই নান্দনিকতার!
No comments:
Post a Comment
Thanks for your comment