রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (৭ই মে, ১৮৬১ - ৭ই আগস্ট, ১৯৪১)[১] (২৫শে বৈশাখ, ১২৬৮ - ২২শে শ্রাবণ, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ)[১] ছিলেন অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক।[২] তাঁকে বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক মনে করা হয়।[৩] রবীন্দ্রনাথকে গুরুদেব, কবিগুরু ও বিশ্বকবি অভিধায় ভূষিত করা হয়।[৪] রবীন্দ্রনাথের ৫২টি কাব্যগ্রন্থ,[৫] ৩৮টি নাটক,[৬] ১৩টি উপন্যাস[৭] ও ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন[৮] তাঁর জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রকাশিত হয়। তাঁর সর্বমোট ৯৫টি ছোটগল্প[৯] ও ১৯১৫টি গান[১০] যথাক্রমে গল্পগুচ্ছ ও গীতবিতান সংকলনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় প্রকাশিত ও গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনা ৩২ খণ্ডে রবীন্দ্র রচনাবলী নামে প্রকাশিত হয়েছে।[১১] রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় পত্রসাহিত্য উনিশ খণ্ডে চিঠিপত্র ও চারটি পৃথক গ্রন্থে প্রকাশিত।[১২] এছাড়া তিনি প্রায় দুই হাজার ছবি এঁকেছিলেন।[১৩] রবীন্দ্রনাথের রচনা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।[১৪]
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতার এক ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিবান ব্রাহ্ম পিরালী ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।[১৫][১৬][১৭][১৮] বাল্যকালে প্রথাগত বিদ্যালয়-শিক্ষা তিনি গ্রহণ করেননি; গৃহশিক্ষক রেখে বাড়িতেই তাঁর শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।[১৯] আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন।ক[›][২০] ১৮৭৪ সালে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-এ তাঁর "অভিলাষ" কবিতাটি প্রকাশিত হয়। এটিই ছিল তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা।[২১] ১৮৭৮ সালে মাত্র সতেরো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ প্রথমবার ইংল্যান্ডে যান।[২২] ১৮৮৩ সালে মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়।[২২] ১৮৯০ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গের শিলাইদহের জমিদারি এস্টেটে বসবাস শুরু করেন।[২২] ১৯০১ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানেই পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করেন।[২৩] ১৯০২ সালে তাঁর পত্নীবিয়োগ হয়।[২৩] ১৯০৫ সালে তিনি বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন।[২৩] ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করেন।[২৩] কিন্তু ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি সেই উপাধি ত্যাগ করেন।[২৪] ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য তিনি শ্রীনিকেতন নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন।[২৫] ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠিত হয়।[২৬] দীর্ঘজীবনে তিনি বহুবার বিদেশ ভ্রমণ করেন এবং সমগ্র বিশ্বে বিশ্বভ্রাতৃত্বের বাণী প্রচার করেন।[২৫] ১৯৪১ সালে দীর্ঘ রোগভোগের পর কলকাতার পৈত্রিক বাসভবনেই তাঁর মৃত্যু হয়।[২৭]
রবীন্দ্রনাথের কাব্যসাহিত্যের বৈশিষ্ট্য ভাবগভীরতা, গীতিধর্মিতা চিত্ররূপময়তা, অধ্যাত্মচেতনা, ঐতিহ্যপ্রীতি, প্রকৃতিপ্রেম, মানবপ্রেম, স্বদেশপ্রেম, বিশ্বপ্রেম, রোম্যান্টিক সৌন্দর্যচেতনা, ভাব, ভাষা, ছন্দ ও আঙ্গিকের বৈচিত্র্য, বাস্তবচেতনা ও প্রগতিচেতনা।[২৮] রবীন্দ্রনাথের গদ্যভাষাও কাব্যিক।[২৯] ভারতের ধ্রুপদি ও লৌকিক সংস্কৃতি এবং পাশ্চাত্য বিজ্ঞানচেতনা ও শিল্পদর্শন তাঁর রচনায় গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল।[৩০] কথাসাহিত্য ও প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে নিজ মতামত প্রকাশ করেছিলেন।[৩১] সমাজকল্যাণের উপায় হিসেবে তিনি গ্রামোন্নয়ন ও গ্রামের দরিদ্র মানুষ কে শিক্ষিত করে তোলার পক্ষে মতপ্রকাশ করেন।[৩২] এর পাশাপাশি সামাজিক ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধেও তিনি তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।[৩৩] রবীন্দ্রনাথের দর্শনচেতনায় ঈশ্বরের মূল হিসেবে মানব সংসারকেই নির্দিষ্ট করা হয়েছে; রবীন্দ্রনাথ দেববিগ্রহের পরিবর্তে কর্মী অর্থাৎ মানুষ ঈশ্বরের পূজার কথা বলেছিলেন।[৩৪] সংগীত ও নৃত্যকে তিনি শিক্ষার অপরিহার্য অঙ্গ মনে করতেন।[৩৫] রবীন্দ্রনাথের গান তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি।[৩৬] তাঁর রচিত আমার সোনার বাংলা ও জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে গানদুটি যথাক্রমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ও ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের জাতীয় সংগীত।[৩৭]
তথ্য সূত্র:https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%B0%E0%A6%AC%E0%A7%80%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%A5_%E0%A6%A0%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A7%81%E0%A6%B0
সোনার তরী
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।
কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।
রাশি রাশি ভারা ভারা
ধান কাটা হল সারা,
ভরা নদী ক্ষুরধারা
খরপরশা।
কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।
একখানি ছোটো খেত, আমি একেলা,
চারি দিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।
পরপারে দেখি আঁকা
তরুছায়ামসীমাখা
গ্রামখানি মেঘে ঢাকা
প্রভাতবেলা--
এ পারেতে ছোটো খেত, আমি একেলা।
গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে,
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
ভরা-পালে চলে যায়,
কোনো দিকে নাহি চায়,
ঢেউগুলি নিরুপায়
ভাঙে দু-ধারে--
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
ওগো, তুমি কোথা যাও কোন্ বিদেশে,
বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে।
যেয়ো যেথা যেতে চাও,
যারে খুশি তারে দাও,
শুধু তুমি নিয়ে যাও
ক্ষণিক হেসে
আমার সোনার ধান কূলেতে এসে।
যত চাও তত লও তরণী-'পরে।
আর আছে?-- আর নাই, দিয়েছি ভরে।
এতকাল নদীকূলে
যাহা লয়ে ছিনু ভুলে
সকলি দিলাম তুলে
থরে বিথরে--
এখন আমারে লহ করুণা করে।
ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই-- ছোটো সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।
শ্রাবণগগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে
রহিনু পড়ি--
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।
[ ফাল্গুন ১২৯৮ শিলাইদহ। বোট ]
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর - বলাকা
যে-কথা বলিতে চাই,
বলা হয় নাই,
সে কেবল এই--
চিরদিবসের বিশ্ব আঁখিসম্মুখেই
দেখিনু সহস্রবার
দুয়ারে আমার।
অপরিচিতের এই চির পরিচয়
এতই সহজে নিত্য ভরিয়াছে গভীর হৃদয়
সে-কথা বলিতে পারি এমন সরল বাণী
আমি নাহি জানি।
শূন্য প্রান্তরের গান বাজে ওই একা ছায়াবটে;
নদীর এপারে ঢালু তটে
চাষি করিতেছে চাষ;
উড়ে চলিয়াছে হাঁস
ওপারের জনশূন্য তৃণশূন্য বালুতীরতলে।
চলে কি না চলে
ক্লান্তস্রোত শীর্ণ নদী, নিমেষ-নিহত
আধো-জাগা নয়নের মতো।
পথখানি বাঁকা
বহুশত বরষের পদচিহ্ন-আঁকা
চলেছে মাঠের ধারে, ফসল-খেতের যেন মিতা,
নদীসাথে কুটিরের বহে কুটুম্বিতা।
ফাল্গুনের এ-আলোয় এই গ্রাম, ওই শূন্য মাঠ,
ওই খেয়াঘাট,
ওই নীল নদীরেখা, ওই দূর বালুকার কোলে
নিভৃত জলের ধারে চখাচখি কাকলি-কল্লোলে
যেখানে বসায় মেলা-- এই সব ছবি
কতদিন দেখিয়াছে কবি।
শুধু এই চেয়ে দেখা, এই পথ বেয়ে চলে যাওয়া,
এই আলো, এই হাওয়া,
এইমতো অস্ফুটধ্বনির গুঞ্জরণ,
ভেসে-যাওয়া মেঘ হতে
অকস্মাৎ নদীস্রোতে
ছায়ার নিঃশব্দ সঞ্চরণ,
যে আনন্দ-বেদনায় এ জীবন বারেবারে করেছে উদাস
হৃদয় খুঁজিছে আজি তাহারি প্রকাশ।
(পদ্মা, ৮ ফাল্গুন, ১৩২২)
রাহুর প্রেম
শুনেছি আমারে ভালো ই লাগে না,
নাই-বা লাগিল তোর,
কঠিন বাঁধনে চরণ বেড়িয়া
চিরকাল তোরে রব আঁকড়িয়া
লৌহশৃঙ্খলের ডোর।
তুই তো আমার বন্দী অভাগিনী
বাঁধিয়াছি কারাগারে,
প্রাণের শৃঙ্খল দিয়েছি প্রাণেতে
দেখি কে খুলিতে পারে।
জগৎ-মাঝারে যেথায় বেড়াবি,
যেথায় বসিবি, যেথায় দাঁড়াবি,
কি বসন্ত শীতে দিবসে নিশীথে
সাথে সাথে তোর থাকিবে বাজিতে
এ পাষাণ প্রাণ অনন্ত শৃঙ্খল
চরণ জড়ায়ে ধ'রে।
এক বার তোরে দেখেছি যখন
কেমনে এড়াবি মোরে।
চাও নাই চাও, ডাক নাই ডাক,
কাছেতে আমার থাক নাই থাক,
যাব সাথে সাথে, রব পায় পায়,
রব গায় গায় মিশি —
এ বিষাদ ঘোর, এ আঁধার মুখ,
হতাশ নিশ্বাস, এই ভাঙা বুক,
ভাঙা বাদ্য-সম বাজিবে কেবল
সাথে সাথে দিবানিশি।
অনন্ত কালের সঙ্গী আমি তোর
আমি যে রে তোর ছায়া —
কিবা সে রোদনে কিবা সে হাসিতে
দেখিতে পাইবি কখনো পাশেতে,
ছবি ও গান
কখনো সমুখে কখনো পশ্চাতে,
আমার আঁধার কায়া।
গভীর নিশীথে একাকী যখন
বসিয়া মলিন প্রাণে,
চমকি উঠিয়া দেখিবি তরাসে
আমিও রয়েছি বসে তোর পাশে
চেয়ে তোর মুখপানে।
যে দিকেই তুই ফিরাবি বয়ান
সেই দিকে আমি ফিরাব নয়ান,
যে দিকে চাহিবি আকাশে আমার
আঁধার মুরতি আঁকা।
সকলি পড়িবে আমার আড়ালে,
জগৎ পড়িবে ঢাকা।
দুঃস্বপ্নের মতো, দুর্ভাবনাসম,
তোমারে রহিব ঘিরে —
দিবস-রজনী এ মুখ দেখিব
তোমার নয়ননীরে।
বিশীর্ণকঙ্কাল চিরভিক্ষাসম
দাঁড়ায়ে সম্মুখে তোর
‘ দাও দাও ' বলে কেবলি ডাকিব
ফেলিব নয়নলোর।
কেবলি সাধিব, কেবলি কাঁদিব,
কেবলি ফেলিব শ্বাস —
কানের কাছেতে প্রাণের কাছেতে
করিব রে হা-হুতাশ।
মোর এক নাম কেবলি বসিয়া
জপিব কানেতে তব,
কাঁটার মতন দিবস রজনী
পায়েতে বিঁধিয়ে রব।
পূর্বজনমের অভিশাপ-সম
রব আমি কাছে কাছে,
ভাবী জনমের অদৃষ্টের মতো
বেড়াইব পাছে পাছে।
ঢালিয়া আমার প্রাণের আঁধার
বেড়িয়া রাখিব তোর চারি ধার
নিশীথ রচনা করি।
কাছেতে দাঁড়ায়ে প্রেতের মতন
শুধু দুটি প্রাণী করিব যাপন
অনন্ত সে বিভাবরী।
যেন রে অকূল সাগর-মাঝারে
ডুবেছে জগৎ-তরী —
তারি মাঝে শুধু মোরা দুটি প্রাণী
রয়েছি জড়ায়ে তোর বাহুখানি,
যুঝিস ছাড়াতে, ছাড়িব না তবু
সে মহাসমুদ্র- ' পরি।
পলে পলে তোর দেহ হয় ক্ষীণ,
পলে পলে তোর বাহু বলহীন,
দুজনে অনন্তে ডুবি নিশিদিন —
তবু আছি তোরে ধরি।
রোগের মতন বাঁধিব তোমারে
নিদারুণ আলিঙ্গনে —
মোর যাতনায় হইবি অধীর,
আমারি অনলে দহিবে শরীর,
অবিরাম শুধু আমি ছাড়া আর
কিছু না রহিবে মনে।
গভীর নিশীথে জাগিয়া উঠিয়া
সহসা দেখিবি কাছে,
আড়ষ্ট কঠিন মৃত দেহ মোর
তোর পাশে শুয়ে আছে।
ঘুমাবি যখন স্বপন দেখিবি,
কেবল দেখিবি মোরে,
এই অনিমেষ তৃষাতুর আঁখি
চাহিয়া দেখিছে তোরে।
নিশীথে বসিয়া থেকে থেকে তুই
শুনিবি আঁধারঘোরে,
কোথা হতে এক কাতর উন্মাদ
ডাকে তোর নাম ধ'রে।
সুবিজন পথে চলিতে চলিতে
সহসা সভয় গণি,
সাঁঝের আঁধারে শুনিতে পাইবি
আমার হাসির ধ্বনি।
হেরো অন্ধকার মরুময়ী নিশা —
আমার পরান হারায়েছে দিশা,
অনন্ত এ ক্ষুধা অনন্ত এ তৃষা
করিতেছে হাহাকার।
আজিকে যখন পেয়েছি রে তোরে
এ চিরযামিনী ছাড়িব কী করে।
এ ঘোর পিপাসা যুগ-যুগান্তরে
মিটিবে কি কভু আর।
বুকের ভিতরে ছুরির মতন,
মনের মাঝারে বিষের মতন,
রোগের মতন, শোকের মতন
রব আমি অনিবার।
জীবনের পিছে মরণ দাঁড়ায়ে,
আশার পশ্চাতে ভয় —
ডাকিনীর মতো রজনী ভ্রমিছে
চিরদিন ধরে দিবসের পিছে
সমস্ত ধরণীময়।
যেথায় আলোক সেইখানে ছায়া
এই তো নিয়ম ভবে,
ও রূপের কাছে চিরদিন তাই
এ ক্ষুধা জাগিয়া রবে!
হঠাৎ দেখা
রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা,
ভাবি নি সম্ভব হবে কোনোদিন।
আগে ওকে বারবার দেখেছি
লালরঙের শাড়িতে
দালিম ফুলের মতো রাঙা;
আজ পরেছে কালো রেশমের কাপড়,
আঁচল তুলেছে মাথায়
দোলনচাঁপার মতো চিকনগৌর মুখখানি ঘিরে।
মনে হল, কালো রঙে একটা গভীর দূরত্ব
ঘনিয়ে নিয়েছে নিজের চার দিকে,
যে দূরত্ব সর্ষেখেতের শেষ সীমানায়
শালবনের নীলাঞ্জনে।
থমকে গেল আমার সমস্ত মনটা;
চেনা লোককে দেখলেম অচেনার গাম্ভীর্যে।
হঠাৎ খবরের কাগজ ফেলে দিয়ে
আমাকে করলে নমস্কার।
সমাজবিধির পথ গেল খুলে,
আলাপ করলেম শুরু --
কেমন আছ, কেমন চলছে সংসার
ইত্যাদি।
সে রইল জানলার বাইরের দিকে চেয়ে
যেন কাছের দিনের ছোঁয়াচ-পার-হওয়া চাহনিতে।
দিলে অত্যন্ত ছোটো দুটো-একটা জবাব,
কোনোটা বা দিলেই না।
বুঝিয়ে দিলে হাতের অস্থিরতায় --
কেন এ-সব কথা,
এর চেয়ে অনেক ভালো চুপ করে থাকা।
আমি ছিলেম অন্য বেঞ্চিতে
ওর সাথিদের সঙ্গে।
এক সময়ে আঙুল নেড়ে জানালে কাছে আসতে।
মনে হল কম সাহস নয়;
বসলুম ওর এক-বেঞ্চিতে।
গাড়ির আওয়াজের আড়ালে
বললে মৃদুস্বরে,
"কিছু মনে কোরো না,
সময় কোথা সময় নষ্ট করবার।
আমাকে নামতে হবে পরের স্টেশনেই;
দূরে যাবে তুমি,
দেখা হবে না আর কোনোদিনই।
তাই যে প্রশ্নটার জবাব এতকাল থেমে আছে,
শুনব তোমার মুখে।
সত্য করে বলবে তো?
আমি বললেম, "বলব।"
বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়েই শুধোল,
"আমাদের গেছে যে দিন
একেবারেই কি গেছে,
কিছুই কি নেই বাকি।"
একটুকু রইলেম চুপ করে;
তারপর বললেম,
"রাতের সব তারাই আছে
দিনের আলোর গভীরে।"
খটকা লাগল, কী জানি বানিয়ে বললেম না কি।
ও বললে, "থাক্, এখন যাও ও দিকে।"
সবাই নেমে গেল পরের স্টেশনে;
আমি চললেম একা।
(শান্তিনিকেতন, ২৪ জুন, ১৯৩৬)
দুই বিঘা জমি
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শুধু বিঘে দুই ছিল মোর ভুঁই আর সবই গেছে ঋণে।
বাবু বলিলেন, ‘ বুঝেছ উপেন, এ জমি লইব কিনে। '
কহিলাম আমি, ‘ তুমি ভূস্বামী, ভূমির অন্ত নাই।
চেয়ে দেখো মোর আছে বড়ো - জোর মরিবার মতো ঠাঁই। '
শুনি রাজা কহে, ‘ বাপু, জানো তো হে, করেছি বাগানখানা
পেলে দুই বিঘে প্রস্থ ও দিঘে সমান হইবে টানা —
ওটা দিতে হবে। ' কহিলাম তবে বক্ষে জুড়িয়া পাণি
সজল চক্ষে, ‘ করুণ রক্ষে গরিবের ভিটেখানি ।
সপ্ত পুরুষ যেথায় মানুষ সে মাটি সোনার বাড়া ,
দৈন্যের দায়ে বেচিব সে মায়ে এমনি লক্ষ্মীছাড়া! '
আঁখি করি লাল রাজা ক্ষণকাল রহিল মৌনভাবে,
কহিলেন শেষে ক্রূর হাসি হেসে, ‘ আচ্ছা, সে দেখা যাবে। '
পরে মাস দেড়ে ভিটে মাটি ছেড়ে বাহির হইনু পথে —
করিল ডিক্রি, সকলই বিক্রি মিথ্যা দেনার খতে।
এ জগতে, হায়, সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি —
রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।
মনে ভাবিলাম মোরে ভগবান রাখিবে না মোহগর্তে ,
তাই লিখি দিল বিশ্বনিখিল দু বিঘার পরিবর্তে ।
সন্ন্যাসীবেশে ফিরি দেশে দেশে হইয়া সাধুর শিষ্য
কত হেরিলাম মনোহর ধাম, কত মনোরম দৃশ্য!
ভূধরে সাগরে বিজনে নগরে যখন যেখানে ভ্রমি
তবু নিশিদিনে ভুলিতে পারি নে সেই দুই বিঘা জমি।
হাটে মাঠে বাটে এই মতো কাটে বছর পনেরো - ষোলো —
একদিন শেষে ফিরিবারে দেশে বড়ই বাসনা হল।
নমোনমো নম সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি!
গঙ্গার তীর স্নিগ্ধ সমীর, জীবন জুড়ালে তুমি।
অবারিত মাঠ, গগনললাট চুমে তব পদধূলি,
ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোটো ছোটো গ্রামগুলি।
পল্লবঘন
আম্রকানন রাখালের
খেলাগেহ,
স্তব্ধ
অতল দিঘি কালোজল — নিশীথশীতল স্নেহ।
বুকভরা
মধু বঙ্গের বধূ জল লয়ে যায়
ঘরে —
মা
বলিতে প্রাণ করে আনচান, চোখে
আসে জল ভরে।
দুই
দিন পরে দ্বিতীয় প্রহরে প্রবেশিনু
নিজগ্রামে —
কুমোরের
বাড়ি দক্ষিণে ছাড়ি রথতলা
করি বামে ,
রাখি
হাটখোলা, নন্দীর গোলা, মন্দির
করি পাছে
তৃষাতুর
শেষে পঁহুছিনু এসে আমার
বাড়ির কাছে ।
ধিক্
ধিক্ ওরে, শতধিক্ তোরে, নিলাজ
কুলটা ভূমি!
যখনি
যাহার তখনি তাহার, এই কি জননী
তুমি!
সে
কি মনে হবে একদিন
যবে ছিলে
দরিদ্রমাতা
আঁচল
ভরিয়া রাখিতে ধরিয়া ফল ফুল শাক
পাতা!
আজ
কোন্ রীতে কারে ভুলাইতে ধরেছ
বিলাসবেশ —
পাঁচরঙা
পাতা অঞ্চলে গাঁথা, পুষ্পে
খচিত কেশ!
আমি
তোর লাগি ফিরেছি বিবাগি গৃহহারা
সুখহীন —
তুই
হেথা বসি ওরে রাক্ষসী, হাসিয়া
কাটাস দিন!
ধনীর
আদরে গরব না ধরে! এতই
হয়েছ ভিন্ন
কোনোখানে
লেশ নাহি অবশেষ সেদিনের কোনো চিহ্ন!
কল্যাণময়ী
ছিলে তুমি অয়ি, ক্ষুধাহরা সুধারাশি!
যত
হাসো আজ যত করো
সাজ ছিলে
দেবী, হলে দাসী।
বিদীর্ণ
হিয়া ফিরিয়া ফিরিয়া চারি দিকে চেয়ে
দেখি —
প্রাচীরের
কাছে এখনো যে আছে, সেই
আমগাছ একি!
বসি
তার তলে নয়নের জলে শান্ত
হইল ব্যথা,
একে
একে মনে উদিল স্মরণে বালক
- কালের কথা ।
সেই
মনে পড়ে জ্যৈষ্ঠের ঝড়ে রাত্রে
নাহিকো ঘুম,
অতি
ভোরে উঠি তাড়াতাড়ি ছুটি আম
কুড়াবার ধুম ।
সেই
সুমধুর স্তব্ধ দুপুর, পাঠশালা - পলায়ন —
ভাবিলাম
হায় আর কি কোথায় ফিরে
পাব সে জীবন !
সহসা
বাতাস ফেলি গেল শ্বাস শাখা
দুলাইয়া গাছে,
দুটি
পাকা ফল লভিল ভূতল আমার
কোলের কাছে।
ভাবিলাম
মনে বুঝি এতখনে আমারে চিনিল মাতা,
স্নেহের
সে দানে বহু সম্মানে বারেক
ঠেকানু মাথা।
হেনকালে
হায় যমদূত - প্রায় কোথা
হতে এল মালী,
ঝুঁটি
- বাঁধা উড়ে সপ্তম সুরে পাড়িতে
লাগিল গালি।
কহিলাম
তবে, ‘ আমি তো নীরবে দিয়েছি
আমার সব —
দুটি ফল তার করি
অধিকার, এত
তারি কলরব! '
চিনিল
না মোরে, নিয়ে গেল
ধরে কাঁধে
তুলি লাঠিগাছ —
বাবু
ছিপ হাতে পারিষদ - সাথে ধরিতেছিলেন
মাছ।
শুনি
বিবরণ ক্রোধে তিনি কন, ‘ মারিয়া
করিব খুন! '
বাবু
যত বলে পারিষদ - দলে বলে
তার শতগুণ।
আমি
কহিলাম, ‘ শুধু দুটি আম ভিখ
মাগি মহাশয়! '
বাবু
কহে হেসে, ‘ বেটা সাধুবেশে
পাকা চোর অতিশয়।
'
আমি
শুনে হাসি আঁখিজলে ভাসি, এই
ছিল মোর ঘটে —
তুমি
মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি
আজ চোর বটে !
No comments:
Post a Comment
Thanks for your comment