জীবনানন্দ দাশ


জীবনানন্দ দাশ

জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি জীবনানন্দ দাশ সংকলিত স্বরচিত কবিতার একটি সংকলন কবির মৃত্যুর কয়েকমাস পূর্বে ১৯৫৪ সালের মে মাসে এই গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় বইটির বর্তমান প্রকাশক ভারবি কবি পূর্ণেন্দু পত্রী ভারবি সংস্করণের প্রচ্ছদশিল্পী


জীবনানন্দ দাশ এই গ্রন্থটির ভূমিকায় লিখেছিলেন, “ভালো কবিতা যাচাই করবার বিশেষ শক্তি সংকলকের থাকলেও আদি নির্বাচন অনেক সময়ই কবির মৃত্যুর পরে খাঁটি সংকলনে গিয়া দাঁড়াবার সুযোগ পায় কিন্তু কোনো-কোনো সংকলনে প্রথম থেকেই যথেষ্ট নির্ভুল চেতনার প্রয়োগ দেখা যায় পাঠকের সঙ্গে বিশেষভাবে যোগ-স্থাপনের দিক দিয়ে -ধরনের প্রাথমিক সংকলনের মূল্য আমাদের দেশেও লেখক পাঠক প্রকাশকদের কাছে ক্রমেই বেশি স্বীকৃত হচ্ছে হয়তো যিনি কবিতা লেখা ছেড়ে দেননি তাঁর কবিতার -রকম সংগ্রহ থেকে পাঠক সমালোচক -কাব্যের যথেষ্ট সংগত পরিচয় পেতে পারেন ; যদিও শেষ পরিচয়লাভ সমসাময়িকদের পক্ষে নানা কারণেই দুঃসাধ্য"

কবিতাসূচীঃ এই গ্রন্থে কবির জীবদ্দশায় প্রকাশিত ঝরাপালক, ধূসর পান্ডুলিপি, বনলতা সেন, মহাপৃথিবী, সাতটি তারার তিমির এবং কবির মৃত্যুর পরবর্তীতে প্রকাশিত রূপসী বাংলা এবং বেলা অবেলা কালবেলা কাব্যগ্রন্থদ্বয়ে সংকলিত সর্বমোট বায়াত্তরটি ; এবং অগ্রন্থিত কিংবা অপ্রকাশিত কবিতানিচয় থেক বাকী আঠারোটি কবিতা গৃহীত হয় অগ্রন্থিত কবিতাগুলোর মধ্যে 'আবহমান', 'ভিখিরী' এবং 'তোমাকে' ‌বনলতা সেন পর্যায়ের এবং তিনটি মহাপৃথিবী পর্যায়ের যথা মনোকণিকা, সুবিনয় মুস্তফী এবং অনুপম ত্রিবেদী সাতটি তারার তিমির পর্বের অপ্রকাশিত চারটি কবিতাগুলো হলো অনন্দা, স্থান থেকে, দিনরাত, এবং পৃথিবীতে এই পূর্বে প্রকাশিত এবং শ্রেষ্ঠ কবিতায় প্রথম গ্রন্থিত কবিতাগুলো হলোঃ তবু, পৃথিবীতে, এই সব দিনরাত্রি, লোকেন বেসের জর্নাল, ১৯৪৬-৪৭, মানুষের মৃত্যু হলে, আছে এবং যাত্রী

বিভিন্ন সংস্করণের প্রকাশেতিহাসঃ
নাভানা প্রকাশন কর্তৃক শ্রেষ্ঠ কবিতা- প্রকাশিত হয় ১৯৫৪ খৃস্টাব্দের মে মাসে (বৈশাখ ১৩৬১ বাং) কবি বিরাম মুখোপাধ্যায় (১৯১৫ - ১৯৯৮)কবিতাগুলো নির্বাচন করেন প্রকাশিত পাঁচটি গ্রন্থ থেকে বাহাত্তর এবং অন্যান্য অগ্রন্থিত অপ্রকাশিত রচনাবলী থেকে আঠারোটি কবিতা গৃহীত হয় ১৩৬ পৃষ্ঠার গ্রন্থটির মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল পাঁচ টাকা প্রচ্ছদ শিল্পী ছিলেন শ্রী ইন্দ্র দুগা (১৯১৮ - ১৯৮৯) প্রচ্ছদ দেখে জীবনানন্দ সন্তুষ্ট হয়েছিলেন
ভারত বুক এজেন্সি, সংক্ষেপে ভারবি, ২৬ কলেজ স্ট্রীট, কলকাতা ৭৩, ১৯৬৬-এর নভেম্বর মাসে এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করে এটিই এই সংস্করণটি দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে মোট ১০+১৫০=১৬০ পৃষ্ঠার গ্রন্থটির মূল্য ছিল ছয় টাকা প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন কবি-শিল্পী পূর্ণেন্দু পত্রী এতে কবিতার সংখ্যা ছিল ৯০টি দ্বিতীয় ভারবি সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৮৪ খৃষ্টাব্দের জানুয়ারী মাসে এতে ১৫টি কবিতা যোগ করা হয় বলাবাহুল্য নতুন কবিতাগুলো জীবনানন্দ নির্বাচিত নয় এই ১৫টি কবিতার শিরোনামঃ তুমি আলো, তোমায় আমি দেখেছিলাম, তোমায় আমি, সবার ওপর, ইতিবৃত্ত, এখন ওরা, সময় মুছিয়া ফেলে, কেন মিছে নক্ষত্রেরা, রবীন্দ্রনাথ, অনেক মৃত বিপ্লবী স্মরণে, আলোকপত্র, কার্তিক-অঘ্রায়ণ ১৯৪৬, আশাভরসা, উপলব্ধি, আলোপৃথিবী

শ্রেষ্ঠ কবিতার- পূর্বে প্রকাশিত কবিতাগুলোতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সংস্কার পরিলক্ষিত হয় তবে প্রধানত সাধু বা শিষ্ট শব্দের বদলে চলিত রীতি বা কথ্য শব্দে রূপান্তরের খাতিরেই এই পরিবর্তন যেমনঃ চুমা হয়েছে চুমো, লব হয়েছে নেবো ইত্যাদি কখনো বাচন ভঙ্গি বদলে গেছে

স্বীকৃতিঃ
১৯৫৫ সালে কবির মৃত্যুর পরর্তী বৎসর ভারত সরকার কর্তৃক এই গ্রন্থখানি শ্রেষ্ঠ বাংলা গ্রন্থ বিবেচিত হয় এবং জীবনানন্দ দাশকে এই গ্রন্থের জন্য মরণোত্তর সাহিত্য অকাদেমী পুরস্কার প্রদান করা হয় প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, জীবনানন্দই এই পুরস্কারের প্রথম প্রাপক
                                                                                                         তথ্য সূত্রঃhttps://banglarkobita.com/book/famous/91

বনলতা সেন

    জীবনানন্দ দাশ

হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।

চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ’পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে , ‘এতোদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।

সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে — সব নদী- ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।





দুজন

   জীবনানন্দ দাশ

আমাকে খোঁজো না তুমি বহুদিন-কতদিন আমিও তোমাকে
খুঁজি নাকো;- এক নক্ষত্রের নিচে তবু-একই আলোপৃথিবীর পারে
আমরা দুজনে আছি; পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়,
প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়,
হয় নাকি?’- বলে সে তাকাল তার সঙ্গিনীর দিকে;
আজ এই মাঠ সূর্য সহধর্মী অঘ্রাণ কার্তিকে
প্রাণ তার ভরে গেছে

দুজনে আজকে তারা চিরস্থায়ী পৃথিবীর আকাশের পাশে
আবার প্রথম এল-মনে হয়- যেন কিছু চেয়ে-কিছু একান্ত বিশ্বাসে
লালচে হলদে পাতা অনুষঙ্গে জাম বট অশ্বত্থের শাখার ভিতরে
অন্ধকারে নড়ে- চড়ে ঘাসের উপর ঝরে পড়ে;
তারপর সান্ত্বনায় থাকে চিরকাল;

যেখানে আকাশে খুব নীরবতা,শান্তি খুব আছে,
হৃদয়ে প্রেমের গল্প শেষ হলে ক্রমে ক্রমে যেখানে মানুষ
আশ্বাস খুঁজেছে এসে সময়ের দায়ভাগী নক্ষত্রের কাছে:
সেই ব্যাপ্ত প্রান্তরে দুজন; চারিদিকে ঝাউ আম নিম নাগেশ্বরে
হেমন্ত আসিয়া গেছে;-চিলের সোনালি ডানা হয়েছে খয়েরি;
ঘুঘুর পালক যেন ঝরে গেছে- শালিকের নেই আর দেরি,
হলুদ কঠিন ঠ্যাং উঁচু করে ঘুমাবে সে শিশিরের জলে;
ঝরিছে মরিছে সব এই খানে বিদায় নিতেছে ব্যাপ্ত নিয়মের ফলে

নারী তার সঙ্গীকে : ‘পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়,
জানি আমি; — তারপর আমাদের দুঃস্থ হৃদয়
কী নিয়ে থাকিবে বলো; — একদিন হৃদয়ে আঘাত ঢের দিয়েছে চেতনা,
তারপর ঝরে গেছে; আজ তবু মনে হয় যদি ঝরিত না
হৃদয়ে প্রেমের শীর্ষ আমাদেরপ্রেমের অপূর্ব শিশু আরক্ত বাসনা
ফুরত না যদি, আহা, আমাদের হৃদয়ের থেকে–’
এই বলে ম্রিয়মাণ আঁচলের সর্বস্বতা দিয়ে মুখ ঢেকে
উদ্বেল কাশের বনে দাঁড়িয়ে রইল হাঁটুভর

হলুদরঙের শাড়ি, চোরকাঁটা বিঁধে আছ, এলোমেলো অঘ্রাণের খড়
চারিদিকে শূন্য থেকে ভেসে এসে ছুঁয়ে ছেনে যেতেছে শরীর;
চুলের উপর তার কুয়াশা রেখেছে হাত, ঝরিছে শিশির;–

প্রেমিকের মনে হল : ‘এই নারী-অপরূপ-খুঁজে পাবে নক্ষত্রের তীরে
যেখানে রবো না আমি, রবে না মাধুরী এই, রবে না হতাশা,
কুয়াশা রবে না আরজনিত বাসনা নিজেবাসনার মতো ভালোবাসা
খুঁজে নেবে অমৃতের হরিণীর ভিড় থেকে ইপ্সিতেরে তার



আট বছর আগে একদিন 
জীবনানন্দ দাশ


শোনা গেল লাশকাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে;
কাল রাতে – ফাল্গুনের রাতের আঁধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হল তার সাধ ।
বধু শূয়েছিল পাশে, শিশুটিও ছিল;
পেম ছিল, আশা ছিল – জোছনায় – তবু সে দেখিল
কোন ভূত? ঘুম কেন ভেংগে গেল তার?
অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল – লাশ কাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার ।

এই ঘুম চেয়েছিলে বুঝি !
রক্তফেনামাখা মুখে মড়কের ইদুরের মত ঘাড় গুজি
আঁধার ঘুজির বুকে ঘুমায় এবার ;
কোনদিন জাগিবে না আর ।

কোনদিন জাগিবে না আর
জানিবার গাঢ় বেদনার
অবিরাম অবিরাম ভার
সহিবে না আর -’
এই কথা বলেছিল তারে,
চাঁদ ডুবে গেলে – অদ্ভুত আঁধারে
যেন তার জানালার ধারে
উটের গ্রীবার মত কোন এক নিস্তব্ধতা এসে ।
তবুও তো পেঁচা জাগে;
গলিত স্থবির ব্যাংগ আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে
কয়েক্টি প্রভাতের ইশারায় -অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে ।

টের পাই যূথচারী আঁধারের গাঢ় নিরুদ্দেশে
চারি দিকে মশারির ক্ষমাহীন বিরুদ্ধতা;
মশা তার অন্ধকার সঙ্ঘারামে জেগে থাকে জীবনের স্রোত ভালবেসে ।
রক্ত ক্লেদ বসা থেকে রৌদ্রে ফের উড়ে যায় মাছি ;
সোনালী রোদের ঢেইয়ে উড়ন্ত কীটের খেলা কত দেখিয়াছি ।
ঘনিষ্ট আকাশ যেন, কোন বিকীর্ণ জীবন
অধিকার করে আছ ইহাদের মন ।;
দুরন্ত শিশুর হাতে ফড়িংযের ঘন শিহরন
মরনের সাথে লড়িয়াছে ।
চাঁদ ডুবে গেলে প্রধান আঁধারে তুমি অশ্বত্থের কাছে
এক গাছা দড়ি হাতে নিয়ে গিয়েছিলে তবু একা একা,
যে জীবন ফড়িংযের দোয়েলের – মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা ,
এই জেনে ।

অশ্বথের শাখা
করেনি কি প্রতিবাদ? জোনাকীর ভিড় এসে
সোনালী ফুলের স্নিগ্ধ ঝাকে
করে নি কি মাখা মাখি ?
থুর থুরে অন্ধ পেঁচা এসে
বলে নি কি ‘ বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনো জলে ভেসে?
চমৎকার! —
ধরা যাক দুই একটা ইদুর এবার !’
জানায় নি কি পেঁচা এসে এ তুমুল গাঢ় সমাচার ?
জীবনের এই স্বাদ – সুপক্ক যবের ঘ্রাণ হেমন্তের বিকেলের –
তোমার অসহ্য বোধ হল;
মর্গে কি হৃদয় জুড়ালো
মর্গে – গুমোটে
থ্যাঁতা ইদুরের মত রক্তমাখা ঠোটে !

শোনো
তবুও এ মৃতের গল্প; – কোন
নারীর প্রণয়ে ব্যর্থ হয় নাই ;
বিবাহিত জীবনের সাধ
কোথাও রাখেনি কোন খাদ ।
সময়ের উদবর্তনে উঠে আসে বধু
মধু – আর মননের মধু
দিয়েছে জানিতে;
হাঢ়াভাতের গ্লানি কোন বেদনার শীতে
এ জীবন কোন দিন কেপে ওঠে নাই;
তাই
লাশকাটা ঘরে
চিৎ হয়ে শূয়ে আছে টেবিলের ‘পরে ।

জানি – তবু জানি
নারীর হৃদয় – প্রেম -শিশূ – গৃহ- নয় সবখানি;
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয় –
আরো এক বিপন্ন বিষ্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে;
ক্লান্ত ক্লান্ত করে ;
লাশ কাটা ঘরে
সেই ক্লান্তি নাই,
তাই
লাশকাটা ঘরে
চিৎ হয়ে শূয়ে আছে টেবিলের ‘পরে ।

তবু রোজ রাতে আমি চেয়ে দেখি, আহা,
থুরথুরে অন্ধ পেঁচা অশ্বত্থের ডালে বসে এসে,
চোখ পাল্টায়ে কয়ঃ ‘ বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনো জলে ভেসে?
চমৎকার! —
ধরা যাক দুই একটা ইদুর এবার –!’

হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজো চমৎকার?
আমিও তোমার মত বুড়ো হব – বুড়ি চাঁদটারে আমি করে দেব বেনোজলে পার
আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার ।




No comments:

Post a Comment

Thanks for your comment