জসীম উদ্দিন
(জানুয়ারি ১, ১৯০৩ - মার্চ ১৩, ১৯৭৬) একজন বিখ্যাত বাঙালি কবি। তিনি বাংলাদেশে 'পল্লী
কবি' হিসেবে পরিচিত। তাঁর লেখা কবর কবিতাটি বাংলা সাহিত্যে এক অবিস্মরণীয় অবদান। পুরো
নাম জসীম উদ্ দীন মোল্লা হলেও তিনি জসীম উদ্ দীন নামেই পরিচিত। নকশী কাঁথার মাঠ কবির
শ্রেষ্ঠ রচনা যা বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তিনি ১৯০৩ সনের পহেলা জানুয়ারি ফরিদপুর
জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার বাড়ি ছিলো একই জেলার গোবিন্দপুর
গ্রামে। বাবার নাম আনসার উদ্দিন মোল্লা। তিনি পেশায় একজন স্কুল শিক্ষক ছিলেন। মা আমিনা
খাতুন
ওরফে রাঙাছুট। জসীম উদ্ দীন ফরিদপুর ওয়েলফেয়ার স্কুল, ও পরবর্তীতে ফরিদপুর
জেলা স্কুল থেকে পড়ালেখা করেন। এখান থেকে তিনি তার প্রবেশিকা পরীক্ষায় ১৯২১ সনে উত্তীর্ন
হন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি. এ. এবং এম. এ. শেষ করেন যথাক্রমে ১৯২৯ এবং
১৯৩১ সনে। ১৯৩৩ সনে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের অধীনে রামতনু
লাহিড়ী গবেষণা সহকারী পদে যোগ দেন। এরপর ১৯৩৮ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের
প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৯ সনে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে সম্মান সূচক
ডি লিট উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি ১৩ মার্চ ১৯৭৬ সনে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। পরে তাকে
তাঁর নিজ গ্রাম গোবিন্দপুরে দাফন করা হয়।
জসীম উদ্দীন এর জনপ্রিয় সকল কবিতাঃ
পল্লী
কবি জসীম উদ্দীনের কবর কবিতা
এই
খানে তোর দাদির কবর ডালিম-গাছের তলে,
তিরিশ
বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।
এতটুকু
তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ,
পুতুলের
বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক।
এখানে
ওখানে ঘুরিয়া ফিরিতে ভেবে হইতাম সারা,
সারা
বাড়ি ভরি এত সোনা মোর ছড়াইয়া দিল কারা!
সোনালি
ঊষার সোনামুখ তার আমার নয়নে ভরি
লাঙল
লইয়া খেতে ছুটিলাম গাঁয়ের ও-পথ ধরি।
যাইবার
কালে ফিরে ফিরে তারে দেখে লইতাম কত
এ
কথা লইয়া ভাবি-সাব মোরে তামাশা করিত শত।
এমনি
করিয়া জানি না কখন জীবনের সাথে মিশে
ছোট-খাট
তার হাসি ব্যথা মাঝে হারা হয়ে গেনু দিশে।
বাপের
বাড়িতে যাইবার কাল কহিত ধরিয়া পা
আমারে
দেখিতে যাইও কিন্তু উজান-তলীর গাঁ।
শাপলার
হাটে তরমুজ বেচি পয়সা করি দেড়ী,
পুঁতির
মালার একছড়া নিতে কখনও হত না দেরি।
দেড়
পয়সার তামাক এবং মাজন লইয়া গাঁটে,
সন্ধাবেলায়
ছুটে যাইতাম শ্বশুরবাড়ির বাটে!
হেস
না
হেস না
শোন দাদু, সেই তামাক মাজন পেয়ে,
দাদি
যে তোমার কত খুশি হত দেখিতিস যদি চেয়ে!
নথ
নেড়ে নেড়ে কহিত হাসিয়া, এতদিন পরে এলে,
পথ
পানে চেয়ে আমি যে হেথায় কেঁদে মরি আঁখিজলে।
আমারে
ছাড়িয়া এত ব্যথা যার কেমন করিয়া হায়,
কবর
দেশেতে ঘুমায়ে রয়েছে নিঝঝুম নিরালায়!
হাত
জোড় করে দোয়া মাঙ দাদু, আয় খোদা! দয়াময়,
আমার
দাদীর তরেতে যেন গো ভেস্ত নসিব হয়।
তারপর
এই শূন্য জীবনে যত কাটিয়াছি পাড়ি
যেখানে
যাহারে জড়ায়ে ধরেছি সেই চলে গেছে ছাড়ি।
শত
কাফনের, শত কবরের অঙ্ক হৃদয়ে আঁকি,
গণিয়া
গণিয়া ভুল করে গণি সারা দিনরাত জাগি।
এই
মোর হাতে কোদাল ধরিয়া কঠিন মাটির তলে,
গাড়িয়া
দিয়াছি কত সোনামুখ নাওয়ায়ে চোখের জলে।
মাটিরে
আমি যে বড় ভালবাসি, মাটিতে মিশায়ে বুক,
আয়-আয়
দাদু, গলাগলি ধরি কেঁদে যদি হয় সুখ।
এইখানে
তোর বাপজি ঘুমায়, এইখানে তোর মা,
কাঁদছিস
তুই? কী করিব দাদু! পরাণ যে মানে না।
সেই
ফালগুনে বাপ তোর এসে কহিল আমারে ডাকি,
বা-জান,
আমার শরীর আজিকে কী যে করে থাকি থাকি।
ঘরের
মেঝেতে সপটি বিছায়ে কহিলাম বাছা শোও,
সেই
শোওয়া তার শেষ শোওয়া হবে তাহা কী জানিত কেউ?
গোরের
কাফনে সাজায়ে তাহারে চলিলাম যবে বয়ে,
তুমি
যে কহিলা বা-জানরে মোর কোথা যাও দাদু লয়ে?
তোমার
কথার উত্তর দিতে কথা থেমে গেল মুখে,
সারা
দুনিয়ার যত ভাষা আছে কেঁদে ফিরে গেল দুখে!
তোমার
বাপের লাঙল-জোয়াল দুহাতে জঢ়ায়ে ধরি,
তোমার
মায়ে যে কতই কাঁদিতে সারা দিনমান ভরি।
গাছের
পাতার সেই বেদনায় বুনো পথে যেতো ঝরে,
ফালগুনী
হাওয়া কাঁদিয়া উঠিত শুনো-মাঠখানি ভরে।
পথ
দিয়া যেতে গেঁয়ো পথিকেরা মুছিয়া যাইত চোখ,
চরণে
তাদের কাঁদিয়া উঠিত গাছের পাতার শোক।
আথালে
দুইটি জোয়ান বলদ সারা মাঠ পানে চাহি,
হাম্বা
রবেতে বুক ফাটাইত নয়নের জলে নাহি।
গলাটি
তাদের জড়ায়ে ধরিয়া কাঁদিত তোমার মা,
চোখের
জলের গহীন সায়রে ডুবায়ে সকল গাঁ।
ঊদাসিনী
সেই পল্লী-বালার নয়নের জল বুঝি,
কবর
দেশের আন্ধারে ঘরে পথ পেয়েছিল খুজি।
তাই
জীবনের প্রথম বেলায় ডাকিয়া আনিল সাঁঝ,
হায়
অভাগিনী আপনি পরিল মরণ-বিষের তাজ।
মরিবার
কালে তোরে কাছে ডেকে কহিল, বাছারে যাই,
বড়
ব্যথা র’ল,
দুনিয়াতে তোর মা বলিতে কেহ নাই;
দুলাল
আমার, যাদুরে আমার, লক্ষী আমার ওরে,
কত
ব্যথা মোর আমি জানি বাছা ছাড়িয়া যাইতে তোরে।
ফোঁটায়
ফোঁটায় দুইটি গন্ড ভিজায়ে নয়নজলে,
কী
জানি আশিস করে গেল তোরে মরণব্যথার ছলে।
ক্ষণপরে
মোরে ডাকিয়া কহিল
আমার কবর গায়
স্বামীর
মাথার মাথালখানিরে ঝুলাইয়া দিও বায়।
সেই
যে মাথাল পচিয়া গলিয়া মিশেছে মাটির সনে,
পরাণের
ব্যথা মরে নাকো সে যে কেঁদে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে।
জোড়মানিকেরা
ঘুমায়ে রয়েছে এইখানে তরুছায়,
গাছের
শাখারা স্নেহের মায়ায় লুটায়ে পড়েছে গায়।
জোনকিমেয়েরা সারারাত
জাগি জ্বালাইয়া দেয় আলো,
ঝিঁঝিরা
বাজায় ঘুমের নূপুর কত যেন বেসে ভালো।
হাত
জোড় করে দোয়া মাঙ দাদু, রহমান খোদা! আয়;
ভেস্ত
নসিব করিও আজিকে আমার বাপ ও মায়!
এখানে
তোর বুজির কবর, পরীর মতন মেয়ে,
বিয়ে
দিয়েছিনু কাজিদের বাড়ি বনিয়াদি ঘর পেয়ে।
এত
আদরের বুজিরে তাহারা ভালবাসিত না মোটে,
হাতেতে
যদিও না মারিত তারে শত যে মারিত ঠোঁটে।
খবরের
পর খবর পাঠাত, দাদু যেন কাল এসে
দুদিনের
তরে নিয়ে যায় মোরে বাপের বাড়ির দেশে।
শ্বশুর
তাহার কশাই চামার, চাহে কি ছাড়িয়া দিতে
অনেক
কহিয়া সেবার তাহারে আনিলাম এক শীতে।
সেই
সোনামুখ মলিন হয়েছে ফোটে না সেথায় হাসি,
কালো
দুটি চোখে রহিয়া রহিয়া অশ্রু উঠিছে ভাসি।
বাপের
মায়ের কবরে বসিয়া কাঁদিয়া কাটাত দিন,
কে
জানিত হায়, তাহারও পরাণে বাজিবে মরণবীণ!
কী
জানি পচানো জ্বরেতে ধরিল আর উঠিল না ফিরে,
এইখানে
তারে কবর দিয়েছি দেখে যাও দাদু! ধীরে।
ব্যথাতুরা
সেই হতভাগিনীরে বাসে নাই কেহ ভালো,
কবরে
তাহার জড়ায়ে রয়েছে বুনো ঘাসগুলি কালো।
বনের
ঘুঘুরা উহু উহু করি কেঁদে মরে রাতদিন,
পাতায়
পাতায় কেঁপে উঠে যেন তারি বেদনার বীণ।
হাত
জোড় করে দোয়া মাঙ দাদু, আয় খোদা! দয়াময়।
আমার
বুজীর
তরেতে যেন গো ভেস্ত নসিব হয়।
হেথায়
ঘুমায় তোর ছোট ফুপু, সাত বছরের মেয়ে,
রামধনু
বুঝি নেমে এসেছিল ভেস্তের দ্বার বেয়ে।
ছোট
বয়সেই মায়েরে হারায়ে কী জানি ভাবিত সদা,
অতটুকু
বুকে লুকাইয়াছিল কে জানিত কত ব্যথা!
ফুলের
মতন মুখখানি তার দেখিতাম যবে চেয়ে,
তোমার
দাদির ছবিখানি মোর হদয়ে উঠিত ছেয়ে।
বুকেতে
তাহারে জড়ায়ে ধরিয়া কেঁদে হইতাম সারা,
রঙিন
সাঁঝেরে ধুয়ে মুছে দিত মোদের চোখের ধারা।
একদিন
গেনু গজনার হাটে তাহারে রাখিয়া ঘরে,
ফিরে
এসে দেখি সোনার প্রতিমা লুটায় পথের পরে।
সেই
সোনামুখ গোলগাল হাত সকলি তেমন আছে।
কী
জানি সাপের দংশন পেয়ে মা আমার চলে গেছে।
আপন
হস্তে সোনার প্রতিমা কবরে দিলাম গাড়ি,
দাদু!
ধরধর বুক ফেটে যায়,
আর বুঝি নাহি পারি।
এইখানে
এই কবরের পাশে আরও কাছে আয় দাদু,
কথা
কস নাকো, জাগিয়া উটিবে ঘুমভোলা মোর যাদু।
আস্তে
আস্তে খুঁড়ে দেখ দেখি কঠিন মাটির তলে,
দীন
দুনিয়ার ভেস্ত আমার ঘুমায় কিসের ছলে !
ওই
দূর বনে সন্ধ্যা নামিয়ে ঘন আবিরের রাগে,
অমনি
করিয়া লুটায়ে পড়িতে বড় সাধ আজ জাগে।
মজিদ
হইতে আযান হাঁকিছে বড় সুকরুণ সুরে,
মোর
জীবনের রোজকেয়ামত ভাবিতেছি কত দূরে।
জোড়হাত
দাদু মোনাজাত কর, আয় খোদা! রহমান।
ভেস্ত
নসিব করিও সকল মৃত্যুব্যথিত প্রাণ।
বিদায়
কিছুদিন
বাদে আদিল কহিল, “গান ত হইল শেষ,
সোনার
বরণী সকিনা আমার চল আজ নিজ দেশ।
তোমার
জীবনে আমার জীবনে দুখের কাহিনী যত,
শাখায়
লতায় বিস্তার লভি এখন হয়েছে গত।
চল,
ফিরে যাই আপনার ঘরে শূন্য শয্যা তথা,
শুষ্ক
ফুলেরা ছাড়িছে নিশ্বাস স্মরিয়া তোমার কথা।”
শুনিয়া
সকিনা ফ্যাল ফ্যাল করি চাহিল স্বামীর পাানে,
সে
যেন আরেক দেশের মানুষ বোঝে না ইহার মানে।
আদিল
কহিল“সেথায়
তোমার হলুদের পাটাখানি,
সে
শুভ দিনের রঙ মেখে গায় ডাকিছে তোমারে রাণী,
উদাস
বাতাস প্রবেশ করিয়া শূূনো কলসীর বুকে,
তোমার
জন্যে কাঁদিছে কন্যে শত বিরহের দুখে।
মাটির
চুলা যে দুরন্ত বায়ে উড়ায়ে ভস্মরাশ,
ফাটলে
ফাটরে চৌচির হয়ে ছাড়িছে বিরহ শ্বাস।
কন্যা-সাজানী
সীমলতা সেথা রোপেছিলে নিজ হাতে।
রৌদ্রে-দাহনে
মলিন আজিকে কেবা জল দিবে তাতে।
চল,
ফিরে যাই আপনার ঘরে, সেথায় সুখের মায়া।
পাখির
কুজনে ঝুমিছে সদাই গাছের শীতল ছায়া।
ক্ষণেক
নীরব রহিয়া সকিনা শুধাল স্বামীরে তার,
“কোথা সেই ঘর আশ্রয়-ছায়া মিলিবে জীবনে
আর ?
অভাগিনী
আমি প্রতি তিলে তিলে নিজেরে করিয়া দান,
কত
না দুঃখের দাহনে কিরনু সে ঘরের সন্ধান।
সে
ঘর আমার জনমের মত পুড়িয়া হয়েছে ছাই,
আমার
সমুখে শুষ্ক মরু যে ছাড়ে আগুনের হাই।”
আদিল
কহিল, “সে মরুতে আজি বহিছে মেঘের ধারা,
তুমি
সেথা চল নকসা করিয়া রচিবে তৃণের চারা।
সেথা
অনাগত শিশু কাকলীর ফুটিবে মধুর বোল,
নাচিবে
দখিন বসন্ত বায় দোলায়ে সুখের দোল।”
“মিথ্যা লইয়া কতকাল পতি প্রবোধিব আপনায়
?”
ম্লান
হাসি হেসে শুধায় সকিনা, “দুঃখের দাহনায়
অনেক
সহিয়া শিখেছি বন্ধু, মিছার বেসাতি করি,
ভবের
নদীতে ফিরিছে কতই ভাগ্যবানের তরী।
সেথায়
আমার হলনাক ঠাঁই, দুঃখ নাহি যে তায়,
সান্ত্বনা
রবে, অসত্য লয়ে ঠকাইনি আপনায়।
কোন
ঘরে মোরে নিয়ে যাবে পতি?যেথায় সমাজনীতি,
প্রতি
তিলে তিলে শাসনে পিষিয়া মরিছে জীবন নিতি।
না
ফুটিতে যেথা প্রেমের কুসুম মরিছে নিদাঘ দাহে,
না
ফুটিতে কথা অধরে শুকায় বিভেদের কাঁটা রাহে।
সাদ্দাদ
সেথা নকল ভেস্ত গড়িয়া মোহের জালে,
দম্ভে
ফিরেছে টানিছে ছিঁড়িছে আজিকার এই কালে।
সে
দেশের মোহ হইতে যে আজি মুক্ত হয়েছি আমি,
স্বার্থক
যেন লাগিছে যে দুখ সয়েছি জীবনে, স্বামী।
কোন
ঘরে তুমি নিয়ে যাবে পতি, কুলটার দুর্নাম,
যেথায়
জ্বলিছে শত শিখা মেলি অফুরান অবিরাম।
যেথায়
আমার অপাপ-বিদ্ধ শিশু সন্তান তরে,
দিনে
দিনে শুধু রচে অপমান নানান কাহিনী করে।
যেথায়
থাপড়ে নিবিছে নিমেষে বাসরের শুভ বাতি.
মিলন
মালিকা শুকায় যেখানে শেষ না হইতে রাতি।
যেথায়
মিথ্যা সম্মান অর খ্যাতি আর কুলমান,
প্রেম-ভালবাসা
স্নেহ-মায়া পরে হানিছে বিষের বাণ।
সেথায়
আমার ঘর কোথা পতি ? মোরে ছায়া দিতে হায়,
নাই
হেন ঠাঁই রীতি নীতি ঘেরা তোমাদের দুনিয়ায়।
এ
জীবনে আমি ঘরই চেয়েছিনু সে ঘরের মোহ দিয়ে,
কেউ
নিল হাসি, কেউ নিল দেহ কেউ গেল মন নিয়ে।
ঘর
ত কেহই দিল না আমারে, মিথ্যা ছলনাজাল,
পাতিয়া
জীবনে নিজেরে ভুলায়ে রাখি আর কতকাল।”
আদিল
কহিল, “আমিও জীবনে অনেক দুঃখ সয়ে,
নতুন
অর্থ খুঁজিয়া পেয়েছি তোমার কাহিনী লয়ে।
আর
কোন খ্যাতি, কোন গৌরব, কোন যশ কুলমান,
আমাদের
মাঝে আনিতে নারিবে এতটুকু ব্যবধান।
বিরহ
দাহনে যশ কুলমান পোড়ায় করেছি ছাই,
তোমার
জীবন স্বর্ণ হইয়া উজলিছে সেথা তাই।
চল
ঘরে যাই, নতুন করিয়া গড়িব সমাজনীতি,
আমাদের
ভালবাসী দিয়ে সেথা রচিব নতুন প্রীতি,
সে
ঘর বন্ধু, এখনো রচিত হয় নাই কোনখানে,
সে
প্রীতি ফুটিবে আমারি মতন কোটি কোটি প্রাণদানে।
তুমি
ফিরে যাও আপনার ঘরে, রহিও প্রতীক্ষায়.
হয়ত
জীবনে আবার মিলন হইবে তোমা-আমায়।’
“কারে সাথে করে ফিরে যাব ঘরে ? শূন্য বাতাস
তথা,
ফুঁদিয়ে
এ বুকে আগুন জ্বালাবে ইন্ধনি মোর ব্যথা।”
“একা কেন যাবে ?”সকিনা যে কহে, “এই যে তোমার
ছেলে,
এরে
সাথে করে লইও সেথায় নতুন জীবন মেলে।
দিনে
দিনে তারে ভুলে যেতে দিও জনম দুখিনী মায়,
শিখাইও
তারে, মরিয়াছে মাতা জীবনের ঝোড়ো বায়।
কহিও,
দারুণ বনের বাঘে যে খায়নি তাহারে ধরে,
মনের
বাঘের দংশনে সে যে মরিয়াছে পথে পড়ে।
এতদিন
পতি, তোমার আশায় ছিনু আমি পথ চেয়ে,
আঁচলের
ধন সঁপিলাম পায় আজিকে তোমারে পেয়ে।
কতেকদিন
সে কাঁদিবে হয়ত অভাগী মায়ের তবে,
সে
কাঁদব তুমি সহ্য করিও আর এক শুভ স্মরে।
মোর
জীবনের বিগত কাহিনী মোর সাথে সাথে ধায়,
তাহারা
আঘাত হানিবে না সেই অপাপ জীনটায়।
বড়
আদরের মোর তোতামণি তারে যাও সাথে নিয়ে,
আমারি
মতন পালিও তাহারে বুকের আদর দিয়ে।”
এই
কথা বলি অভাগী সকিনা ছেলেরে স্বামীর হাতে,
সঁপিয়া
যে দিতে নয়নের জল লুকাইল নিরালাতে।
তোতামণি
কয়, “মাগো, মা আমার লক্ষী আমার মা,
তোমারে
ছাড়িয়া কোথাও যে মোর পরাণ টিকিবে না।
কোন
বনবাসে আমারে মা তুমি আজিকে সঁপিয়া দিয়া,
কি
করিয়া তুমি জীবন কাটাবে একেলা পরাণ নিয়া।”
“বাছারে! সে সব শুধাসনে মোরে, এটুকু জানিস
সার,
ছেলের
শুভের লাগিয়া সহিতে বহু দুখ হয় মার।
রজনী
প্রভাতে মা বোল বলিয়া আর না জুড়াবি বুক,
শতেক
দুখের দাহন জুড়াতে হেরিব না চাঁদ মুখ।
তবু
বাছা তোরে ছাড়িতে হইবে, জনম দুখিনী মার,
সাধ্য
হল না বক্ষে রাখিতে আপন ছেলেরে তার।”
ছেলেরে
আঁচলে জড়ায়ে সকিনা কাঁদিল অনেকক্ষণ,
তারপর
কোন দৃঢতায় যেন বাঁধিয়া লইল মন।
উসাদ
কন্ঠে কহিল স্বামীকে, “ফিরে যাও, নিজ ঘরে,
মোদের
মিলন বাহিরে হল না রহিল হৃদয় ভরে।
আমার
লাগিয়া উদাসী হইয়া ফিরিয়াছ গাঁয় গাঁয়,
এই
সান্ত্বনা রহিল আমার সমুখ জীবনটায়।
যাহার
লাগিয়া এমন করিয়া অমন পরাণ করে,
আজি
জানিলাম, তাহারো পরাণ আমারো লাগিয়া ঝরে।
এ
সুখ আমার দুখ-জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার,
সারাটি
জনম তপস্যা করি শোধ নাহি হবে তার।
এই
স্মরণের শক্তি আমারে চালাবে সমুখ পানে,
যে
অজানা সুর মোহ বিস্তারি নিশিদিন মোর টানে।”
“প্রাণের সকিনা ?” আদিল শুধায়, “সে তব জীবনটায়,
আমার
তরেতে এতটুকু ঠাই নাহি কোন তরুছায় ?”
“আছে, আছে পতি, “সকিনা যে কহে, “হায়রে যাহারে
পাই,
তাহারে
আবার হারাইতে সখা, বড় যে আরাম তাই।
ফুলেরে
ডাকিয়া পুছিনু সেদিন, “ফুল ! তুমি বল কার ?
ফুলে
কহে, যারে কিছু না দিলাম আমি যে সবটা তার।
শুধালাম
পুন; বল বল ফুল ! সব তুমি দিলে যারে,
সেকি
আজ হাসে বরণে সুবাসে তোমার দানের ভাবে ?
“সে আমার কাছে কিছু পায় নাই। ফুল কহে ম্লান
হাসি,
‘পদ্মের বনে ফিরিছে সারসী কুড়ায়ে শামুক
রাশি।
পুছিলাম
পুন ফুল !তুমি বল কোথায় সবতি তব ?
ফুল
কহে, যারে কিছু দেই নাই সেথা মোর চিরভব।
এ
জীবনে মোর এই অভিশাপ যারে কিছু দিতে যাই,
কর্পুর
সম উবে যায় তাহা, হাতে না লইতে তাই।
যে
আমারে চাহে যতটা করিয়া আমি হই তত তার,
ইচ্ছা
করিয়া আমি যে জীবনে কিছু নারি হতে কার।
যে
আমারে পায় তাহার নিশীথে চির অনিদ্রা জাগে,
ফুলশয্যা
যে কন্টকক্ষত তাহার জীবনে লাগে।
সাপের
মাথায় চরণ রাখিয়া চলে সে আঁধার রাতে,
দুখের
মুকুট মাথায় পরিয়া বিষের ভান্ড হাতে।
নিকটে
করিয়া যে আমারে চাহে আমি তার বহুদূর,
দূরের
বাঁশীতে বেজে ওঠে নিতি প্রীতি মিলনের সুর।
ফুলের
কাহিনী স্মরিযা পতি গো, অনেক শিখেছি আজ,
স্বেচ্ছায়
তাই হাসিয়া নিলাম বিরহ মেঘের বাজ।
নিকটে
তোমারে পেতে চেয়েছিনু, সাধ হল না তাই,
দূরের
বাঁশীরে দূরে রেখে দেখি বুকে তারে যদি পাই।
গলে
না লইতে শুকাল মালিকা, মিলন রাতের মোহে,
চিরশূণ্যতা
ভরেছি এ বুকে দোঁহে আকড়িয়া দোঁহে।
আজ
তাই পতি, বড় আশা করে তোমারে পাঠাই দূরে,
সেই
শূন্যতা ভরে যদি ওঠে আমার বুকের সুরে।
আদিল
কহিল, প্রাণের সকিনা, সারাটি জনম ভরে,
দুখের
সাগরে সাঁতার কেটেছ কেবলি আমার তরে।
আজকে
তোমার কোন সাধ হতে তোমারে না দিব বাধা,
স্বেচ্ছায়
আমি বরিয়া নিলাম এই বিরহের কাঁদা।
বিদায়ের
কালে বল অভাগিনী, কোথায় বাঁধিবে ঘর,
কোন
ছায়াতরু শীতলিত সেই সুদূর তেপান্তর?
ম্লান
হাসি হেসে কহিল সকিনা, আমার মতন হায়,
অনেক
সহিয়া ঘুমায়েছে সারা জীবনে ঝড়িয়ায়;
কবর
খুঁড়িয়া বাহির করিয়া তাদের কাহিনী মালা,
বক্ষে
পরিয়া প্রতি পলে পলে বুঝিব তাদের জ্বালা।
যত
ভাঙা ঘর শুষ্ক কুসুম, দলিত তৃষিত মন,
সেথায়
আমার যোগ সাধনের রচিব যে ধানাসন।
সেইখানে
পতি বরষ বরষ রহিব তপস্যায়,
খুঁজিব
নতুন কথা যা শুনিলে সব দুখ দূরে যায়।
জানি
না সে কোন কথা-অমৃত, কোন সে মধুর ভাষা,
তবু
আজ মোর নিশিদিশি ভরি জাগিতেছে মনে আশা;
সে
কথার আমি পাব সন্ধান, দুঃখ দাহন মাঝে,
হয়ত
বেদন-নাশন কখন গোপনে সেখা রোজে।
একান্ত
মনে বসি ধ্যানাসনে একটি একটি ধরি,
মোর
ব্যথাগুলি সবার ব্যথার সঙ্গে মিশাল করি;
পরতে
পরতে খুলিয়া খুলিয়া দিনের পরেতে দিন,
খুঁজিয়া
দেখিব কোথা আছে সেই কথামৃতের চিন।
যদি
কোন কোন সন্ধান মেলে, সে মধুর সুর নিয়া,
নতুন
করিয়া গড়িব আবার আমাদের এ দুনিয়া।
সেইদিন
পতি ফিরিয়া যাইব আবার তোমার ঘরে,
অভাগীরে
যদি ভালবাস সখা, থেকো প্রতীক্ষা করে।
বিদায়ের
আগে ও চরণে শেষ ছালাম জানায়ে যাই,
দোয়া
করো মোরে, এই সাধনায় সিদ্ধি যেন গো পাই।
আর
যদি কভু ফিরে নাহি আসি, ব্যথার দাহনানলে,
জানিও,
অভাগী মরিয়াছে সেথা নিরাশায় জ্বলে জ্বলে।
আজি
এ জীবন বিষে বিষায়িত, প্রেম, ভালবাসা, মায়া,
বেড়িয়া
নাচিছে গোর কুজঝট কদাকার প্রেত ছায়া।
জ্বলিছে
বহ্নি দিকে দিগনে-, তীব্র লেলিহা তার,
খোদার
আরশ কুরছির পরে মূর্চ্ছিছে বারবার।
দিন
রজনীর দুইটি ভান্ড পোরা যে তীব্র বিষে,
মাটির
পেয়ালা পূর্ণ করিয়া উঠেছে গগন দিশে।
তারকা-চন্দ্রে
জ্বলিছে তাহার তীব্র যে হুতাশন,
তারি
জ্বালা হতে নিস্তার মোর না হইল কোনক্ষণ।
সন্ধ্যা
সকাল তারি শিখা লয়ে আকাশের দুই কোলে,
মারণ
মন্ত্র ফুকারি ফুকারি যুগল চিতা যে জ্বলে।
তাই
এ জীবন সরায়ে লইনু তোমার জীবন হতে,
আমারে
ভাসিতে দাও পতি, সেই কালিয়-দহের স্রোতে।
বাপের
সঙ্গে চলিয়াছে ছেলে, ফিরে চায় বারে বারে,
পারিত
সে যদি দুটি চোখ বরি টেনে নিয়ে যেত মারে।
পাথরের
মত দাঁড়ায়ে সকিনা, স্তব্ধ যে মহাকাল,
খুঁজিয়া
না পায় অভাগিনী তরে সান্ত্বনা ভাষাজাল।
চরণ
হইতে চলার চক্র খসিয়া খসিয়া পড়ে,
নয়ন
হইতে অশ্রুর ধারা নিশির শিশিরে ঝরে।
তিনু
ফকিরের সারিন্দা বাজে, আয়রে দুষ্কু আয়,
পাতাল
ফুঁড়িয়া দুনিয়া ঘুরিয়া আকাশের নিরালায়।
আয়রে
দুস্কু, কবরের ঘরে হাজার বছর ঘুরে,
ছিলি
অচেতন আজকে আয়রে আমার গানের সুরে।
রাতের
পরী
রাতের
বেলায় আসে যে রাতের পরী,
রজনীগন্ধা
ফুলের গন্ধে সকল বাতাস ভরি।
চরণের
ঘায়ে রাতের প্রদীপ নিভিয়া নিভিয়া যায়,
হাসপাতালের
ঘর ভরিয়াছে চাঁদিমার জোছনায়।
মানস
সরের তীর হতে যেন ধবল বলাকা আসে,
ধবল
পাখায় ঘুম ভরে আনে ধবল ফুলের বাসে।
নয়ন
ভরিয়া আনে সে মদিরা, সুদূর সাগর পারে,
ধবল
দ্বীপের বালু-বেলাতটে শঙ্খ ছড়ায় ভারে।
তাহাদেরি
সাথে লক্ষ বছর ঘুমাইয়া নিরালায়,
ধবল
বালুর স্বপন আনিয়া মাখিয়াছে সারা গায়।
আজ
ঘুম ভেঙে আসিয়াছে হেথা, দেহ লাবনীর পরে,
কত
না কামনা ডুবিছে ভাসিছে আপন খুশীর ভরে।
বসনে
তাহার একে একে আসি আকাশের তারাগুলি,
জ্বলিছে
নিবিছে আপনার মনে রাতের বাতাসে দুলি।
রাতের
বেলায় আসে যে রাতের পরী
চরণে
বাজিছে ঝিঁঝির নূপুর দোলে ধরা মরি মরি!
তাহারি
দোলায় বনপথে পথে ফুটিছে জোনাকী ফুল,
রাত-জাগা
পাখি রহিয়া রহিয়া ছড়ায় গানের ভুল!
তারি
তালে তালে স্বপনের পরী ঘুমের দুয়ার খুলে,
রামধনু
রাঙা সোনা দেশেতে ডেকে যায় হাত তুলে।
হলুদ
মেঘের দোলায় দুলিয়া হলদে রাজার মেয়ে,
তার
পাছে পাছে হলুদ ছড়ায়ে চলে যায় গান গেয়ে।
রাতের
বেলায় ঝুমিছে রাতের পরী,
মোহ
মদিরার জড়াইছে ঘুম সোনার অঙ্গ ভরি।
চেয়ারের
গায়ে এলাইল দেহ খানিক শ্রানি-ভরে,
কেশের
ছায়ায় মায়া ঘনায়েছে অধর লাবনী পরে।
যেন
লুবানের ধূঁয়ার আড়ালে মোমের বাতির রেখা,
কবরের
পামে জ্বালাইয়া কেবা রচিতেছে কোন লেখা।
পাশে
মুমূর্ষু রোগীর প্রদীপ নিবু নিবু হয়ে আসে,
উতল
বাতাস ঘুরিয়া ফিরিয়া কাঁদিছে দ্বারের পাশে।
মরণের
দূত আসিতে আসিতে থমকিয়া থেমে যায়,
শিথিল
হস্ত হতে তরবারি লুটায় পথের গায়।
যুক্ত
করেতে রচি অঞ্জলি বার বার ক্ষমা মাগে,
রাত্রের
পরী মেলি দেহভার ঝিমায় ঘুমের রাগে।
ভোরের
শিশির পদ্ম পাতায় রচিয়া শীতল চুম,
তাহার
দুইটি নয়ন হইতে মুছাইয়া দিবে ঘুম।
রক্তোৎপল
হইতে সিদুর মানাইতে তার ঠোঁটে,
শুক-তারকার
সোনার তরনী দীঘির জলে যে লোটে।
No comments:
Post a Comment
Thanks for your comment