সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ও তাঁর শিল্পকর্মঃ
বাংলা সাহিত্যের বিশাল আকাশে তিনি উড়ে বেরিয়েছেন স্বাধীন পাখির মতো। নিজের মনের কথাগুলো এবং সমাজবাস্তবার প্রতিটা প্রতিচ্ছবি খুব সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখেছেন আর সেসবকে উপজীব্য করেছেন তাঁর লেখনিতে। তিনি আর কেউ নন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। যার পরিচয় দিতে গেলে বলতে হয়, তিনি এক অসামান্য কথাশিল্পি, যিনি আপন নিষ্ঠা ও মনস্বতায় স্বতন্ত্র। প্রকট চেতনাপ্রবাহী প্রকরণিক উৎকর্ষতা ও কাল চৈতন্যানুগ বিষয়বস্তুর ঋদ্ধতার গুণে তাঁর শিল্পচর্চায় আমাদের হৃদয়কে স্পর্শ করে আর চেতনায় আমাদের বিবেকবোধের জাগরণ ঘটে।
তাঁর তিনটি বিরলপ্রজ উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের ভান্ডারকে করেছে আরোও সমৃদ্ধ। সেসব কর্ম বিরল প্রজ হলেও, আত্ম-আবিষ্কার স্পৃহা ও ধীসম্পন্নতার কারনে তা হয়ে উঠেছে অতুলনীয়। এ তিনটি উপন্যাস হলো- ‘লালসালু’ (১৯৪৮), ‘চাঁদের অমাবস্যা’ (১৯৬৪), ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ (১৯৬৮)। এসব উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের নতুন আবিষ্কার ও সমাজ-ব্যক্তিসংলগ্নতা সবিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ জায়গা দখল করে রয়েছে। মানবীয় অস্তিত্বের ক্লানিহীন সাধনায় তিনি সর্বদা ব্যস্ত রেখেছেন নিজেকে। তিনি আবিষ্কার করতে চেয়েছেন যে, নিরস্তিত্ত্বে জীবন থাকতে পারেনা, আর তাই অাধাঁর পেরিয়ে আলোর পানে অস্তিত্বের অন্বেষনে সফল দায়িত্ববান হয়ে উঠাই তাঁর সাহিত্যে মৌল উপজীব্য।
একটা বিশেষ বস্তু থেকে সেই বস্তুর মর্মবাণীকে আবিষ্কার করাই তাঁর সাহিত্যের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল। তিনি অন্বেষণ করেছেন তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলোর মধ্যে, খোঁজেছেন তাদের অবস্থান- ‘আমি’, ‘সে’, ‘ওরা’ এসব ব্যক্তি সত্ত্বা আর তাদের অস্তিত্বের অবস্থান থেকে। ব্যক্তিচেতনার পাশাপাশি তিনি দার্শনিক মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন সমাজচেতনা, বস্তুভেদী ও বস্ত অতিক্রমী হতে গিয়ে। তিনি পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ উভয় প্রান্তে তাঁর নায়কদের করেছেন বিচ্ছিন্ন, বিভক্ত বহিরাগত, আবার উন্মুখ ও সমাজচ্যুত নয় এমন। কাহিনীগুলোতে শুরুর দিকে দেখা যায় বস্তুবাদ কিন্তু পরবর্তীতে তা ক্রমশই সত্যের অতলে ডুবে যেতে থাকে। তিনি বাস্তববাদী হয়েও আমরা তাকে তখন দেখতে পাই একজন অন্তর্বাস্তবাদী হিসাবে।
তাঁর বর্ণিত কাহিনীগুলো শুরুতে যেমন সাবলীল ও সরলতায় মোড়ানো থাকে, পরবর্তীতে তা হয়ে ওঠে অতি বিশ্লেষণধর্মী। তবে যতদূর জানা যায় তাঁর এ অস্তিত্ববাদী মনোভাব তাঁকে প্রভাবিত করেছে বহুকাল প্যারিস প্রবাসের ফলে। তাঁর শিল্পকর্ম আরো বেশী স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যখন কেউ বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নানা ধরনের বিষয়বস্তুর পরোখ করে।সমাজ মনস্কতা, জীবনঘনিষ্ঠতার মধ্য দিয়ে জীভন ও সমাজের যে চিত্ররূপ তাঁর শিল্পে চিত্রিত হয়েছে তাতে সামন্ত জীবনবাদের প্রতি, ধর্মীয় গোঁড়ামির প্রতি তীব্র ঘৃণা, তীক্ষ্ণ তিরস্কার উচ্চারিত হয়েছে। জীবনকে অবলোকন করা যে মাত্রাবোধ তাঁর মধ্যে বহমান তা তাঁর মৌলিক এবং স্বসময়ের প্রতি দার্শনিক মনোভাবের জন্ম দিয়েছে।
এদেশের ধর্মীয় ও সামাজিক চেতনার ধারপ্রান্তে গিয়ে তিনি আধুনিক
ব্যক্তিমনের অস্তিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। এখানকার ধর্ম সম্পৃক্ত ব্যক্তি, পীর-দরবেশ-খাদেমদের চারিত্রিক অসঙ্গতি, তাদের ফ্রয়েডীয় বিচ্ছিন্নতা ও লিবিডো চেতনা উপভৌগিক মানসিকতার রূপকল্পে তিনি প্রবলভাবে সচেষ্ট ছিলেন। যদি আমরা ‘লালসালু’ উপন্যাসের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো, এখানে একদল ভাগ্য বিপর্যস্ত মানুষের সাথে একজন কপট ও চতুর ব্যক্তি ধর্মকে পুঁজি করে সামান্য কোরআনের জ্ঞানকে নিজ সার্থহাসিলে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে , সেসব সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণায় মেতে উঠেছে। ধর্মের প্রতি সেসময়ের মানুষের বিশেষ দূর্বলতা ও খোদাভীতির ফলেই মজিদের মতো ব্যক্তিরা মানুষের আবেগ আর অনুভূতির সাথে জোয়া খেলেছে, করেছে তাদের উদ্দেশ্য হাসিল।
‘চাঁদের অমাবস্যা’যেখানে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা ও চেতনাপ্রবাহে বৈশিষ্টমন্ডিত সেখানে শিল্পীর মনোযোগ কেড়েছে সমাজসচেতনতা। ব্যক্তি সমাজের বাইরে নয় এটাই তারঁ লক্ষ্যবস্তু আর সেকারণে ব্যক্তিসত্তা ও সমাজের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও একই সঙ্গে সঙ্গে সেই ব্যক্তিসত্তাটির সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়াটি সুস্পষ্ট হয়ে উঠে।যে গ্রামে উপন্যাসের ভিত্তিভূমি তার- বড়বাড়ি, স্কুলের শিক্ষক, পুলিশ- সবই যথেষ্টভাসে স্পষ্ট হয়ে উঠে। এখানে দেখা যায় ব্যক্তিসত্তার বহিঃপ্রকাশ ও ধারাবর্ণণার পশ্চাৎ জমিনে সমাজ সত্তাকে সচেতনভাবে সক্রিয় করে রেখেছেন। এখানে আমরা দেখি কিভাবে ধর্মের প্রতি বিদ্রুপাত্মক দৃষ্টিভঙ্গীকে পরোক্ষরূপে তুলে ধরা হয়েছে।
লেখকের সমাজসচেতনতার অন্যতম প্রয়াস ফুটে উঠে ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ উপন্যাসে। এখানে দেখানো হয় মুস্তফার অস্তিত্ব ও তার নৈতিক অপর্যাপ্ততা, অধঃপতন হয় একটি পরিবারের, পিতার নিঃসঙ্কোচ পশুতে পরিণত হওয়া এবং একটি গ্রামের লক্ষ্যণীয় পরিবর্তন। এখানে আমরা ঘটনা গুলোকে আবিষ্কার করি অন্য এক অনুঘটনার শর্ত হিসেবে, কর্ম যেখানে কারণের শর্ত, একটি টার্নিং পয়েন্টের পর অন্য এক টার্নিং পয়েন্ট। যা অনেকটা অতিনাটকীয় মূর্তিধারণ করে। প্রত্যেকটি চরিত্রই যেখানে স্বাধীনভাবে নিজ আকাশে উড়ে বেড়ায়।
চরিত্র নির্মাণ ও কাহিনী রূপায়ণের ক্ষেত্রে তিনি যে কতটা যত্নশীল ছিলেন তা কেবল স্পষ্ট হয় তাঁর সাহিত্যকর্মে সতর্ক ও গভীরভাবে মনোনিবেশ করলে। তাঁর উপন্যাসের বিষয়বস্তু, ঘটনাপ্রবাহ, প্রেক্ষাপট, পরিবেশ-প্রতিবেশ সবই যেন আপন মৃত্তিকা সংলগ্ন। তিনি পরম যত্নে সমাজ-বাস্তবতা ও ব্যক্তির মধ্যকার সময়ের ব্যবধানে ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনাকে নিজ হাতে থরেবিথরে সাজিয়ে একটি আল্টিমেট রেজাল্ট হিসাবে পাঠকের সামনে আয়নার মতো তুলে ধরেন।
সাহিত্য সমালোচনায় পঠিত বই সমূহ এবং তথ্যসূত্র/তথ্যের উৎসঃ
উইকিপিডিয়া, ‘লালসালু’ উপন্যাস, ‘চাঁদের অমাবস্যা’ উপন্যাস, ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ উপন্যাস, বিভিন্ন সমালোচিত বই ও নবদূত গাইড।
No comments:
Post a Comment
Thanks for your comment