চোখের বালি - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর || বিনোদিনী চরিত্র
- সাহিত্য বিশ্লেষণ, সমালোচনায় মোঃ অলিউল্লাহ
‘চোখের বালি’ উপন্যাসের অন্যতম উল্লেখযোগ্য চরিত্র বিনোদিনী। উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রাখে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এ চরিত্রটি অতি যত্নে গড়া এবং শিল্পীর চরিত্র নির্মাণের নিপুন কৌশল প্রস্ফুটিত হয় বিনোদিনী চরিত্রের মাধ্যমে। বিনোদিনীকে উপস্থাপন করা হয় প্রাপ্ত বসয়স্ক, সুদর্শনা, দক্ষ এবং বিধবা হিসাবে। বিনোদিনীর বাবার আর্থিক অবস্থা সচল না হওয়া সত্ত্বেও সে মেয়েকে মিশনারী মেম রেখে অতিযত্নে পড়াশোনা ও কারুকার্য শিখিয়েছিলেন।
তবে মেয়ের বিয়ের বয়স পার হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তার উদাসীনতা ছিল না। কিন্তু তার মৃত্যুর পর বিনোদিনীর বিধবা মাতা সংসারের অভাবের জন্য মেয়েকে পাত্রস্থ করার ক্ষেত্রে অস্থির হয়ে গিয়েছিলেন। একই গ্রামের মেয়ে বিনোদিনীর মা হরিমতি ও রাজলক্ষী। শৈশবের খেলার সাথী। তাই রাজলক্ষীর ছেলের সাথে বিয়ে দিতে চাইলে তার ছেলে মহেন্দ্র দ্বিধায় পরে যায় এবং বিয়ে করতে অনিহা প্রকাশ করে। পরে রাজলক্ষীর জন্মভূমি বারাসতের গ্রাম সম্পর্কিয় এক ভ্রাতুষ্পুত্রের সাথে বিনোদিনীকে তার মা বিয়ে দেয়। কিছু দিন যেতে না যেতেই বিনোদিনীর স্বামী মারা যায়।
মহেন্দ্র অবশ্য তার কাকীমার বোনঝি আশাকে বিয়ে করে স্বাচ্ছন্দেই সংসার করছিলো। নবদম্পতির কোনরূপ আহ্লাদের বাকি রইলোনা। এমনকি মহেন্দ্রের মা যখন তার জন্মভূমিতে বেরাতে যায়, সেখানে বিহারীর মাধ্যমে তার মাকে চিঠি পাঠায়। কিন্তু মাকে দেওয়া চিঠি যখন বিনোদিনী পরে শোনাচ্ছিল, তখন চিঠির কিছু অংশ পরে বুঝতে পেরেছিলো এই চিঠিতে কেবল স্বামী-স্ত্রির প্রণয়-উপাখ্যান লেখা বৈ কিছু নাই। তাই চিঠি খানা নিজের কাছে রেখে দেয় এবং পরে একেলা ঘরে সেই পড়ে বিনোদিনীর মনে অন্য রকম এক অনুভূতি খেলা করে। বিনোদিনী স্বামী সোহাগ ভালোভাবে বুঝবার আগেই বিধবা হয়, তাই আশা ও মহেন্দ্রের বিবাহ উত্তর সকল বিষয়গুলো চিঠি পড়ে অনুধাবন করছিলো ও নিজের অনূভুতির সাথে মিলিয়ে নিয়েছিল।
বিনোদিনী ভালো করেই জানতো মহেন্দ্র ও বিহারীর সাথে তার বিবাহের কথা-বার্তা হয়েছে। তারা দু’জনেই বিনোদিনীকে দেখতে যাওয়া ও প্রয়োজন মনে করেনি। কিন্তু রাজলক্ষী জন্মভূমিতে ফিরে যাবার বিনোদিনীর অধিক যত্নে খুবই তৃপ্ত হয় এবং বাড়ি ফেরার সময় বিনোদিনীকে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। বিনোদিনী ও আশার মধ্যে খুব ভালো সম্পর্ক তৈরী হয়। যেহেতু বিনোদিনী সকল কাজেই খুব পারদর্শী তাই আনাড়ি আশাকে কারুকার্য ও ঘরের কাজ শিখানোর মাধ্যমে দু’জন দুজনের সখী হয়ে যায়। আশা তার সইকে নিজের বরের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। মহেন্দ্র এমন অসাধারণ সুন্দরী নারী এর আগে কখনো দেখেনি।
অন্যদিকে বিনোদিনীও আশা ও মহেন্দ্রের বৈবাহিক জীবনভোগের দৃশ্য দেখার লোভ সামলাতে না পেরে তাদেরকে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ শুরু করে। দিনের পর দিন বিনোদিনীর নিপুন কর্মদক্ষতা, ইংরেজিতে কথা বলা ও তার সৌন্দর্যের জন্য মহেন্দ্রের মনে আচর কাটে। একসময় মহেন্দ্র বিনোদিনীর প্রেমের ফাঁদে বন্দী হয় এবং নিজের স্ত্রীর সাথে বৈরী সম্পর্ক তৈরী হতে থাকে। অন্যদিকে মহিনের বাড়িতে প্রায়ই বিহারী আসে এবং বিনোদিনীর আপ্যায়ন ও আতিথেয়তায় পরিতৃপ্ত হয়। এমনকি বিহারী যখন দূরে চলে যেতো তখন বিনোদিনী অতিযত্নে তার ঘর গোছানো, গ্লাসে ফুল সাজানো ও ঘরটিকে সাজিয়ে ঘুছিয়ে পরিপাটি করে রাখতো।
বিহারী ধীরে ধীরে বিনোদিনীতে মুগ্ধ হয়ে যায়। বিনোদিনী সবই বুঝতে পারে। একদিকে যেমন মহেন্দ্র তার জন্য অত্যন্ত উদাসীন ও তাকে ছাড়া অতি অক্ষম বোধ করে অন্য দিকে তার স্ত্রীর সাথে ক্রমেই ভালোবাসা শেষ হয়ে যেতে থাকে। বিনোদিনী শুরুতে আশার সখী হয়ে সকল কাজ শিখানোর দায়ভার গ্রহণ করেছিলো। কিন্তু আশা নিজেও জানতে পারেনি, এভাবে সে তার স্বামী বিনোদিনীর প্রতি আকৃষ্ট হবে। আশা তাদের প্রেমালাপ ও দৃষ্টিভঙ্গি উপলব্ধি করে এক সময় মহেন্দ্রকে মুক্তি দিলো।
বিনোদিনী বিধবা হলেও সে ইংরেজ ম্যামের কাছে ইংরেজি শিখেছে। সকল প্রকার কারুকার্য ও গৃহের কাজে খুবই দক্ষ। যেমন অপরূপ সৌন্দর্যের অধিকারী তেমনি সে গুণবতী। তার রূপে ও গুণে মুগ্ধ হয়ে বিহারী ও মহেন্দ্র এক সময় পাগলপারা হয়ে যায়। সেই সুযোগে বিনোদিনীও তাদের মানসিকতা বুঝতে পেরে তাদের সাথে খেলায় মেতে ওঠে। যেই মহিন একসময় স্ত্রীর প্রতি অগাধ ভালবাসায় মাতোয়ারা ছিলো, সে এখন বিনোদিনীর ছলনায় মাতাল।
বিনোদিনী চরিত্রের দ্বৈতরূপ ‘চোখের বালি’ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অংকন করেছেন। বিনোদিনী একদিকে নিজের প্রতি অবহেলাকারীদের নাকে দড়ি লাগিয়ে ঝুলিয়েছে অন্যদিকে নিজের কামনা-বাসনার উদ্দেশ্য হাসিল করেছে। কিন্তু উপন্যাসের শেষের দিকে মহেন্দ্রকে করুণ পরিণতিতে প্রতিফলিত করেছে। চরিত্রের সার্থকতা বিবেচনায় বিনোদনী চরিত্রটি সফল ও ভাস্বর।
* আশা চরিত্র
* রাজলক্ষী চরিত্র
* বিহারী চরিত্র
* অন্নপূর্ণা চরিত্র
No comments:
Post a Comment
Thanks for your comment