Showing posts with label বাংলা নাটক. Show all posts
Showing posts with label বাংলা নাটক. Show all posts

Thursday, September 5, 2019

বাংলা নাটক- নিঃসঙ্গের-সঙ্গী

নিঃসঙ্গের-সঙ্গী

(মোঃ অলিউল্লাহ্)

খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে রেহমান অন্তু কে ।  কপাল থেকে ঝড়ে পড়ছে অঝড়ে ঘাম।  চোখ দু’টো হয়ে আছে আগুনের মতো লাল আর চোখের দুই কোণে অশ্রু টলমল করছে।  আষাঢ়ের আকাশ যখন মেঘের ভার সইতে না পেরে হঠাৎ এক সময় বৃষ্টিতে ভাসিয়ে দেয় সবকিছু ঠিক তেমনি তার চোখের জল যেন আর বাধা মানে না।  হাঁপানোর কারনে মুখ থেকে কোন কথাই সরলোনা তার।  অবশেষে কন্ঠরুদ্ধতাকে ধরে রাখতে না পেরে হাও মাও করে কেঁদে ওঠলো সে।  গ্রীন হাসপাতালে,  দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে কাঁদতে লাগলো।  পাশেই ইমার্জেন্সি রুম।   প্রায় দুই ঘন্টা আগে কয়েকটি মেয়ে নিশান্তিকাকে নিয়ে এসেছিল এখানে।   রেহমান অন্তু,  কেমন জানি স্তব্দ হয়ে কিছু ভাবতে লাগলো।  



নিউইয়র্কের একটি ভার্সিটিতে পড়াশুনা করছে অন্তু।  মা নেই,  বাবার স্নেহে লালিত হয়ে একসাথেই বসবাস করে দু’জন।  ভারি হাস্য-চঞ্চল স্বভাবের ছেলে অন্তু।  বাবার সাথে সম্পর্কটা বলতে গেলে খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতো।  তার কোন কথাই বাবার কাছে অজানা নয়। তবে একটা কথা ছাড়া,  যা কোন দিন বলতে পারেনি মুখ ফুটে। ‘নিশান্তিকা’ তার ফেইছবুক ফ্রেন্ড।

ঢাকা ইউনিভার্সিটির ইকোনোমিকস্ এর ছাত্রী সে।  খুবই শান্ত ও নরম প্রকৃতির মেয়ে।  খোদা তায়ালা’র নিপুণ হস্তে গড়া অপরূপ মহিমা ও অকৃত্রিম সৌন্দর্য তার লাবন্যে মিশেছে।  তবে তা কেবল নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখতেই সে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে,  লোক সম্মুখে তা একেবারেই অজানা।  ২ অক্টোবর ২০১২ অন্তু তাকে ফেইছবুকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠায়। নিশান্তিকা ফেইছবুকে একেবারেই নতুন,  সে অন্তুকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করলো।  

 এক সময় অন্তু আর নিশান্তিকার কথোপকথন শুরু হল।  
অন্তু-“রিক্ততার বেদনায় অপূর্ণতাকে পূর্ণতা দিতে বিধাতার একটা ইঙ্গিত পেয়েছিলাম গতকাল রাতে।  কখনো কখনো মনে হয় স্বপ্নগুলো আসলে স্বপ্ন নয়,  মাঝে মাঝে সত্যিও হয়।  তারই হয়তো বহিঃপ্রকাশ তুমি”।  
নিশান্তিকা-“মানে? ”
অন্তু-“কেমন আছো? ”
নিশান্তিকা- “হুম।  ”
অন্তু – “তারমানে ভালো।  ”
নিশান্তিকা- “হুম।  ”
অন্তু-“বুঝা যাচ্ছে তুমি অনেকটা চাপা স্বভাবের।  ”
নিশান্তিকা- “আমি আবার কখন চাপা মারলাম? ”
অন্তু কিছুক্ষণ কিছু বলল না।  
অন্তু-“তুমি কোথায় থাক? ”

নিশান্তিকা- “এড়িয়ে গেলা?  ঢাকায়।  লেখাপড়া করি,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।  কই বললে নাতো? ”
অন্তু-“ চাপা মারার কথা বলিনি,  চাপা স্বভাবের বলেছি।  ”
নিশান্তিকা- “কি কর তুমি? ”
অন্তু- “মস্তিষ্কের নিষ্ক্রক্রয়তা দূর করি।  ”
নিশান্তিকা  - “মানে? ”
অন্তু – “হাঁচি দিলে যেমন মস্তিষ্কের নিষ্ক্রয়তা দূর হয়,  তেমনি কিছু আকাক্সিক্ষত বস্তুর খোঁজ পেলে আমার তেমনি মনে হয়।  ”
নিশান্তিকা – “ঠিক বুঝলাম না।  কি আকাক্সিক্ষত বস্তুর সন্ধান পেয়েছো,  বলা যাবে কি? ”
অন্তু- “অস্তিত্বের একটি অতিপ্রাকৃত ব্যাপার আছে,  জানো কি? ”
নিশান্তিকা – “না।  ”

অন্তু-“এই পৃথিবীর অতলস্পর্শে প্রতিটা মানুষই কোন না কোন ভাবে তাকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়।  সে চায় মানুষের কল্পিত চোখের সম্মুখে সারাক্ষণ ভেসে বেড়াতে।  আর সে জন্য কিছু না কিছু রেখে যায় মানুষের দরবারে।  আর আমার চোখে ভেসে বেড়াও তুমি প্রতিদিন,  অন্ত:হীন।  ”
নিশান্তিকা – “আমাকে তো তুমি কোনদিন দেখনি।  তবে কী করে তোমার আঁখি সম্মুখে আমি ভেসে বেড়াই? ”
অন্তু-“ঐযে অস্তিত্ব।  তোমার অস্তিত্ব যে আমার দেহ মনের অভ্যন্তরে পৌছে গেছে।  মুখ শুধু কথা বলেনা,  দেহ ও হৃদয়ের ভারও বহন করে।  ”
নিশান্তিকা – “তুমি তোমার প্রোফাইল পিকচারে তোমার ছবি দাও না কেন? ”
অন্তু-“যদি কারো কাছে খারাপ লাগে? ”
নিশান্তিকা – “তোমার ফ্রেন্ড লিস্ট এ তো আমি ছাড়া আর কেউ নেই।  ”
অন্তু-“তুমি তো আছো ।  ”
নিশান্তিকা – “ঘুম আসছে।  আজকের মতো এখানেই সমাপ্ত।  ”
অন্তু - “ফোন নাম্বারটা দিবে? ”

নিশান্তিকা -“প্রথম দিনেই? আচ্ছা তোমার টা দাও আমি কল করছি।  ”
সূর্য এর আলোতে ভয়ংকর কিছুও তেমন একটা ভীতির সঞ্চার করেনা,  যতটা ভয়ের কারণ হয় রাত্রিকালে। মানুষের ভিতরকার ঘুমন্ত প্রাণটার হয়তো তখনই প্রকাশ মেলে নিজের অনুভূতির কাছে।  

প্রভাত পাখির গুঞ্জন শুনে ঘুম ভাঙ্গল নিশান্তিকার।  বিশ্ব-বিদ্যালয়ের হলে,  চমৎকার এক ফুল বাগান।  বারান্দার সিঁড়িতে বসে,  বড়ই ব্যাকুল লাগছে,  তাই ভাবলো একটা কল দেই ওকে।  

নিশান্তিকা-“মনের প্রাণবন্ত উচ্ছাস গুলোর বহি:প্রকাশ ঘটে প্রভাতের শিমুল তলায়,  শেফালির সৌন্দর্য মুগ্ধতায়,  আর কুয়াশায় ঝড়া পড়া বকুলের মধ্যদিয়ে।  সেই আগেকার দিনের পল্লী যুবতির ভোরবেলায় ফুল কুড়ানোর পর মালা গাথার স্বাদ আমারো জাগে,  তবে মনের কোন একটা গহীনে একটা ভয় কাজ করে,  যদি সে মালা শুকিয়ে যায়; তাহলে তো আর যথার্থ গ্রহণযোগ্যতা হবেনা।  এ শুধু একটি সূর্য ওঠা সকাল নয়,  এ যেন আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই শৈশবে।   যখন মায়ের হাতটি ধরে এক পা দু’পা হাটতে হাটতে স্কুলের দিকে রওয়ানা হতাম,  রাস্তায় প্রভাতের সেই ফুল কুড়িয়ে ব্যাগের পকেটে রাখতাম।  মেয়ের আনন্দ দেখে মাও ফুল কুড়িয়ে দিত।  আর প্রাণের অগোচরে বিরাজ করা সেই বাল্য বন্ধুটির হাতে তুলে দিতাম সকল ফুল।  সেও আমার মতো ব্যাগের পকেটে নিয়ে বাসায় রেখে দিত।   আমি ভাবতাম সে হয়তো তা ফেলে দেয়।  কিন্তু একদিন বড় ধরেনর সারপ্রাইজ দিল আমাকে।  স্কুল ছুটির পর আমাকে বাসায় যেতে দিলনা। আমাকে নিয়ে গেল বহুদূরের এক স্থানে যেখানে কাশফুলের সমারোহ। দেখে মনটা আনন্দে নেচে উঠলো আর উৎফুল্লতায় আত্মহারা হয়ে গেলাম, যখন সে আমার দেওয়া সবগুলো ফুল আমার হাতে দিল,  সেই শুকনো ফুলগুলো।”

অন্তু- “সত্যি তোমার কাক ডাকা ভোরে আর আমার পড়ন্ত বিকেল বেলায় কথাগুলো যেন হৃদয়ের কোন এক কোণে নাড়া দিয়ে গেল।  তবে জানতে ইচ্ছে করে কে সেই সৌভাগ্যবান বন্ধু যে তোমার বালিকাবেলার সেই কোমল হাতটি স্পর্শ করার সযোগ পেয়েছে? ”

নিশান্তিকা-“সেই সপ্তম শ্রেণীর পর হতে তার সাথে আর দেখা হলোনা,  কোথায় হারিয়ে গেল মেঘের মতো কিছুই বুঝতে পারলাম।  একবার বলেও গেল না আমাকে।  যখন সে আমার পাশে হাটতো আমার মনে হতো সে আমার অতি পরিচিত,  অতি কাছের মানুষ।  অথচ আজ সে কোথায় আছে,  কেমন আছে তা বলা বড়ই কঠিন।  চলে যাওয়ার আগে পর্যন্ত সে আমার অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল।  আর যখনই সে চলে গেল,  মনে হয়েছিল সে শুধু আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুই নয় তার চেয়ে বেশী কিছু।”
   
প্রিয় পাঠক, আপনাদের বুঝার স্বার্থে বলে রাখা ভাল যে,  নিশান্তিকা যে বন্ধুটির কথা বলছে সে আর কেউ নয়।  সে-ই অন্তু,  রেহমান অন্তু।  তবে নিশান্তিকার কাছে যদিও অন্তু এখন অপরিচিত,  কিন্তু অন্তুর কাছে পুরোপুরিই পরিচিত।   কিন্তু তা নিশান্তিকার কাছে অজ্ঞাত।  কিভাবে তাদের দূরত্ব তৈরি হলো তা নিয়ে পরে কথা হবে।  

অন্তু – “একটা মানুষের মনে এত নগন্য একটা স্মৃতি এতদিন স্থায়িত্ব হয়,  তা জানা ছিল না।”
নিশান্তিকা- “এটাকে তুমি নগন্য বলছো?”
অন্তু-হেসে বলল,   “তাহলে কি জগন্য বলবো?”
নিশান্তিকা – “তা অবশ্য ঠিকই বলেছো,  তোমার কাছে নগন্য অথবা জগন্য দু’টো-ই হতে পারে।  কারন তুমিতো সেই স্মৃতির সাথে কোন ভাবে সম্পৃক্ত না।”

অন্তু,   মনে মনে হাসে আর ভাবে,  আমি শুধু সম্পৃক্তই নই বরং তোমার মনের অনুভূতিগুলো যেমন তোমাকে তাড়া করে প্রতিনিয়ত,  তার চেয়ে কোন অংশে আমাকে কম তাড়া করেনা।  আর তাইতো এতগুলো বছর হন্নে হয়ে খুজেছি তোমার ঠিকানা।  কিন্তু কোন ভাবেই যখন পাচ্ছিলাম না।  তারপর থেকে খুজতে শুরু করলাম অনলাইনে আর অবশেষে তোমার হদিস পেলাম আটটি বছর পর।  তবুও তোমার কাছে আজ আমি বড়ই অচেনা।  

অন্তু-“একি তুমি রাগ করলে?”
নিশান্তিকা-“না।   এখন রাখছি পরে কথা বলবো।”
হঠাৎ সেই নিগুঢ় ভাবনারা স্তম্বিত হয়ে ফিরে এলো বর্তমানের সঙ্কটাপন্ন মুহুর্তে।  ইমার্জেন্সি রুম থেকে বের হলো ডাক্তার।  দৌড়ে গেল অন্তু ডাক্তারের কাছে।  
গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো- “কি অবস্থা নিশান্তিকার?”
পাশেই দাড়িয়ে নিশান্তিকার বান্ধবীরা।  কিছুটা সন্ধিহান চোখ মেলে তাকিয়ে রইলো অন্তুর দিকে।  একে অপরকে চোখে ইশারা করে জানতে চাইছে, কে সে? 

ডাক্তার বলল- “দেখেন এখনই আমরা নিশ্চিত না যে কি হয়েছে।তবে এটুকু বলতে পারি সে ফিজিকাল্লি অনেক উইক।  হয়তো অনেক দিন ভালোভাবে খাবার খায় নি ও নিয়মিত ঘুমায় নি।  যার কনসিক্যুয়েন্স এ উইকনেস।  ঘন্টা খানেক পর জ্ঞান ফিরতে পারে।  আপনারা এখন এক কাজ করেন,  কিছু ঔষধ লিখে দিচ্ছে আর শরীরে অনেক রক্তের অভাব রয়েছে রক্তের ব্যবস্থা করতে হবে।  তারপর ডাক্তার সবকিছু লিখে দিলেন। অন্তু নিশান্তিকার বান্ধবীদের কে বলল আপনারা আমাকে চিনবেন না। আমি আজই নিউইয়র্ক থেকে এসেছি।  আর এসেই বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে যাই,  গিয়ে শুনলাম ওকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে।  সেখান থেকে ছুটে এসেছি এখানে।  

এক বান্ধবী- “ও আপনিই তাহলে রেহমান অন্তু?”
অন্তু- “হ্যা।আমিই রেহমান অন্তু।নিশান্তিকার সাথে আমার সর্বশেষ কথা হয়েছিল ১৫ ডিসেম্বর ২০১৩ এ।কিন্তু সেদিন আমাদের মাঝে ছোট একটি ভুল বোঝাবুঝি হয়।এরপর নিশান্তিকা আমাকে কল করেনি, আমি অনেকবার চেষ্টা করেও তাকে পাইনি।ওর সাথে আমার সম্পর্ক কিভাবে হয়েছিল তা আমি বলছি।নিশান্তিকা এবং আপনারা জানেন আমি রেহমান অন্তু।  কিন্তু রেহমান অন্তুর বাহিরেও নিশান্তিকার সাথে আমার আরেকটি সম্পর্ক রয়েছে।  

নাজিম মাহমুদ,  আমার বাবা।  সে ঢাকায় থাকতো । উচ্চ শিক্ষিত একজন ভদ্র সুশীল সমাজের মানুষ তিনি।  বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ছিলেন তিনি।  ছোটবেলা থেকেই নিজের চেষ্টা ও দক্ষতার ফলে সাফল্যের মুখ দেখেছে বারবার।  সুদর্শন দেখতে ছিলেন।  তাই লেখাপড়া শেষ করার আগেই একটি সুন্দরী মেয়ের সাথে ভাব হয়।  পরে বিয়ে হয়।  বিয়ের কয়েক দিন পরই সে একটি ভাল চাকরি পায়।  একটা বছর যেতে না যেতেই তাদের সংসারে আসে ছোট্ট বেবি যার নাম রাখা হয় রেহমান অন্তু রেমন।  আমার জন্মের দু’ বছর পর আমার মা চিরতরে বিদায় নেয় পৃথিবী থেকে।

তারপর থেকে আমার বাবা আমাকে নিয়ে খুব সমস্যায় পতিত হয়।  আমার বাবা অফিসে চলে গেলে কাজের মেয়ে বাসায় আমার দেখাশুনা করতো।  তবে সেটা ছিল খুবই অবহেলা পূর্ণ।  সে সময়-অসময় শুধু ঘুমাতো।  আমি কিছু খেতে চাইলে সে আমাকে দিতনা তেমনটা; বরং সে আমার খাবার খেয়ে ফেলত।  আমি কিছু বললে আমাকে অনেক মারতো এবং বলত,  আমি যেন বাবাকে কিছু না বলি।  বললে বাবা যখন বাসা থেকে চলে যাবে সে আমাকে দূরে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দিবে।  সেই ভয়ে বাবাকে কিছুই বলতাম না।  এভাবে আমার দিন কাঁটতে লাগলো।  

পাঁচ বছর বয়সে ঢাকার একটি ভালো স্কুলে ভর্তি করা হয় আমাকে।   আমি লেখাপড়ায় অত্যন্ত ভালো ছিলাম ।  স্কুল এ যখন আমি ক্লাস ফোর এ পড়ি তখন নিশান্তিকা একই স্কুলে ৩য় শ্রেণিতে ভর্তি হয়।  কয়েকদিন  পর থেকেই আমাদের বন্ধুত্বের শুরু হয়।  সে ছিল আমার স্কুলের  বেস্ট ফ্রেন্ড।  কিন্তু নিশান্তিকা আমার এক ক্লাস নিচে পড়তো।  আমাদের মধ্যে এ বিষয়টি কখনো চোখে পড়েনি কারো।  একটা সময়ে আমাদের মধ্যে তৈরি হয় শৈশবের ভাললাগার ফিলিংস।  

আমাদের প্রতিটা দিন ছিল খুবই আনন্দের।   যখন আমি ক্লাস ফাইভ এ পড়ি তখনের কিছু ঘটনা বলি,  প্রতিদিন খুব সকাল সকাল আমি স্কুলে চলে আসতাম।  বাসা থেকে বেশী দূরে ছিল না আমাদের স্কুলটি।  তাই আমি একাই আসতাম স্কুলে।  এসে অপেক্ষায় থাকতাম কখন নিশান্তিকা আসবে।  তাকে দেখার পর আমার খুব ভালো লাগতো।  যদি কোন দিন সে না আসতো সেদিন আমার খুবই কষ্ট হতো।  আমার কোনকিছুতেই ভালো লাগতো না।  

নিশান্তিকার একটা বদভ্যাস ছিল,  সে প্রায় প্রতিদিনই আমার সামনে তার চুলের বেনী খুলে চুলগুলো এলোমেলো করে ফেলত।  যা দেখতে খুবই খারাপ দেখাতো ওকে।  তারপর আমি নিজ হাতে ভাল করে চুল আচড়িয়ে তার চুলে বেণী করে দিতাম।  এরপর সে অনেক খুশি হতো।  ধীরে ধীরে সেই বদ অভ্যাসটি একটি ধারাবাহিক অভ্যাসে পরিণত হয়।  

আমার বাবা প্রতিদিন ভাল ভাল খাবার নিয়ে আসতেন বাসায়।  আর আমি স্কুলে নিয়ে গিয়ে দু’জন মিলে খেতাম।  নিশান্তিকাও আমার জন্য নানা ধরনের খাবার নিয়ে আসতো।  

যান্ত্রিকতার এই শহরটাতে আমাদের দু’জনের ছিল একটি স্বর্গরাজ্য।  তা হল আমাদের স্কুলের পিছনে থাকা বিশাল বটগাছ,  তার নিচেই আমাদের সময়টা কাঁটতো।  ওর যদি কোন দিন মন খারাপ থাকতো তা আমি সহজেই বুঝতে পারতাম।   যদিও সে আমাকে বলতে চাইতো না।  

আমি বাসায় গিয়ে আমার পড়া শেষ করতাম ।   তারপর যখন আর কোন কাজ থাকতো না,  তখন বসে বসে নিশান্তিকার জন্য বিভিন্ন ধরনের ছবি আঁকতাম।  নিশান্তিকা আমার সব ছবিগুলো তার একটি ডায়রিতে আঠা দিয়ে লাগিয়ে রাখতো।  টানা একবছর পর সে আমাকে দেখালো তার ডায়রিটা।  খুলে দেখলাম সেটা যেন হাতে আঁকা একটি ছবির বই।  আমি অনেক অবাক হয়ে ছিলাম সেদিন।  

আনন্দঘন মুহুর্তগুলো ঘিরে থাকতো সর্বদা আমাদের দু’জনকে।  এভাবেই কেটে গেল চারটা বছর।  আমি অষ্টম শ্রেণিতে আর নিশান্তিকা সপ্তম শ্রেণিতে।  তখনকার অনুভুতি গুলো আরো মধুর ছিলো।  ওর কাছে যাওয়ার সাথে সাথে আমি যেন অন্য এক জগতে হারিয়ে যেতাম।  ওর গাঁ থেকে বেড় হওয়া সেই মিষ্টি ঘ্রাণ যেন পৃথিবীর কোন পারফিউমে নেই।  তার হাতে যখন আমার হাত রাখতাম,  তখন মনে হতো আমি এমন কিছুতে হাত রেখেছি যা একটি যাদুর তৈরি বস্তু,  যাকে স্পর্শ করলে মুহুর্তেই স্বর্গে চলে যাওয়া যায়।  

আমাদের সময় গুলো যে শুধু হাঁসি-খুশিতেই গেছে তা নয়।  তার মাঝখানে ছিল সঞ্চিত অভিমান,  ছোট ছোট রাগ আর মধুর অনুভূতি।  মাঠে চড়া মেষ শাবকেরা যখন দলবেধে চলার আনন্দ উপভোগ করে,  ঠিক তেমনি পবিত্র একজোড়া মেষ শাবক ছিলাম আমরা দু’জন।   প্রকৃতি যেন সর্বোপুরি আমাদের অনুসরণ করতো প্রতিটা মুহুর্ত,  আমাদের পিছু পিছু।  
আমরা দু’জন যখন আকাশটাকে দেখতাম মনে হতো এই বুঝি আকাশের ছামিয়ানা,  কিছু দূরেই মিশে গেছে মাটির সাথে।  

রাতের বেলায় বাসার ছাদে গিয়ে যখন ধ্রুবতারা দেখতাম চাঁদের অদূরে,  ধরে নিতাম সে চাঁদ আর আমি ধ্রুবতারা।  আমার মতো সেও একই সময়ে ছাদে যেত তার মায়ের সাথে,  গিয়ে চাঁদ কে দেখিয়ে বলতো “মা এইযে চাঁদটা দেখছো না,  এটা কে জানো?  তার মা বলতো নাতো।

একটু খিলখিল হেসে বলতো “মা এটা আমি,  বুঝছ?”
পরক্ষণে,  আকাশের ঐ ধ্রুব তারাটাকে দেখিয়ে বলতো “এটা কে জানো?” তখন মা বলতো এটা আবার কে?  আবারো একটু হেসে বলতো, “এটা আমার বন্ধু,  রেমন।” মা মেয়ের এই পাগলামিকে বড় যতন করে অনুভব করতো।  পরদিন স্কুলে এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করতো, “কাল রাতে ছাদে গিয়ে চাঁদ আর ধ্রুবতারাকে দেখেছিলে? ”

আবেগের গভীর বন্ধনে আবদ্ধ ছিল আমাদের প্রতিটা নিঃশ্বাস।  মনে বড় ভয় ছিলো যদি কোন দিন আমাদের মাঝখানে বিয়োগ চিহ্নটি বসে,  যদি বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হয় আমাদের মাঝে,   তাহলে হয়তো এই নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়া ছাড়া উপায় থাকবেনা।  তবে যদিও নিঃশ্বাস বন্ধ হয়নি,  তথাপি আমাদের মাঝে বিয়োগ চিহ্নের উদয় হলো।  সেই দিনটির কথা মনে হলে চোখের কোণে জল না এসে পারে না।  তখন আমার অষ্টম শ্রেণির প্রায় শেষ।  

একটা সকাল বেলা,  বাবা ঘুমিয়ে আছে।আমি স্কুলে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম।  এমন সময় কলিংয়ের শব্দ বাজলো।  দরজা খুলে দেখি অনেক গুলো বড় বড় লোক,  কারো হাতে লাঠি,  কারো হাতে রাম দা,  কারো হাতে অন্যান্য সব ভয়ংকর জিনিস।  তাদের দেখে আমি দৌড়ে গেলাম বাবাকে ডাকতে।  বাবা ঘুম থেকে জাগার সাথে সাথে বাবাকে একজন একটা চর মারলো,  আর বলল- “তোকে না বলে ছিলাম এই শহর ছেড়ে চলে যাবি, এখনো যাস নি কেন?

ওরা বাবাকে কোন কথা বলার সুযোগ দিল না।  অনেক মারতে লাগলো।   আমি বাঁধা দিতে গেলে আমাকেও মারলো।এরপর আমরা আমাদের এক দুঃসম্পর্কের চাচার বাসায় গিয়ে ওঠি।এরমাঝে আর আমার স্কুলে যাওয়া হল না।  বন্ধ হয়ে গেল আমার পড়াশুনা।একমাস পরেই জানতে পারলাম বাবার কাছে,  আগামি কাল আমরা নিউইয়র্ক যাচ্ছি।আমার চোখে অঝড়ে জল ঝড়তে লাগলো।  আমি কোন ভাবেই নিশান্তিকাকে ভুলতে পারছিলাম না।  বাবা আমাকে বলল,  আমাদের কোন পথ নেই এছাড়া।বাবা সম্পূর্ণ ঘটনাটি আমাকে তখনই বলল না।  আমরা চলে গেলাম নিউইয়র্ক।  

কিন্তু নিশান্তিকার প্রতিটা স্মৃতি,  তার কন্ঠধ্বনি কানের মাঝে বাজতে শুরু করলো,  তার সেই স্পর্শ যেন আমাকে উদাস করে দিচ্ছে।  ঠিক এমন সময় বিভিন্ন ভাবে তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি।  কারণ আমি নিজেও বুঝতে পারি নি আমাদের সম্পর্কটা শুধু যে বন্ধুত্বের তা নয়,  এখানে মিশে আছে লোকানো প্রাণের আকুতি,  নিঃশ্বাসের মোহ মায়া আর প্রবল অনুভূতি,  যার আকর্ষনে আমরা ছুটে গিয়েছি একে অন্যের কাছে।

মনের অগোচরে ভালবাসা নামক অকৃত্রিম অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল আমাদের মাঝে।  যা ছিল দু’জনেরই অজানা।  আমরা শুধু বন্ধুত্বের বাহ্যিক রূপটাকে সদা দেখে এসেছি,  ভালবাসার ভেতর যেই বন্ধুত্বের পদচিহ্ন তা কেবল ঘুমন্ত অবস্থায় ছিল।  রিক্ত হস্তে চলে গিয়েছিলাম সেখানে,  যেই রিক্ততার যন্ত্রণা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল আমাকে।  

আমি কোন দিন ওদের বাসায় যাই নি আর জানতেও চাইনি ওদের বাসার ঠিকানা।  মোবাইল ফোনের প্রচলনও তেমন একটা ছিল না বললেই চলে।  অবশেষে খুজতে শুরু করি ইন্টারনেট মাধ্যমে।  দীর্ঘ ৮ বছর পর ফেইছবুকে খুজে দেখতে পাই নিশান্তিকার প্রোফাইল পিকচার।  খোদাকে ধন্যবাদ দেবার ভাষা তখন আমার জানা ছিল না।  

তারপর থেকে কথা বলা শুরু হয়।কিন্তু আমার আসল নাম জানতো না সে, রেমন আমার ডাক নাম।  এই নামেই জানতো নিশান্তিকা আমাকে।আমি তাকে পরিচয় না দিয়ে কথা বলা শুরু করলাম। প্রায়ই নিশান্তিকা রেমনের কথা বলতো।  আমি শুনতাম খুব মনোযোগ দিয়ে। কিন্তু একটা কথা একদিকে যেমন মজার অন্য দিকে কিছুটা কষ্টের। আমার নিউইয়র্ক চলে যাওয়ার পর এক বছর আমাকে সে খুব মিস করেছে।তারপর লেখাপড়ার ব্যস্ততায় আমার কথা কখন যে ভুলে গিয়েছিল।এরপর যখন সে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হল তখন,   সে একরাতে আমাকে স্বপ্ন দেখল।  

স্বপ্ন দেখার পর নাকি কোন ভাবেই আমার চিন্তা মাথা থেকে মুছতে পারলো না।  সেও পাগলের মতো আমাকে খুজতে শুরু করলো।কোন পথ না পেয়ে সে কারো একজনের পরামর্শে ফেইছবুক চালাতে শুরু করে।আর এভাবে দিনের পর দিন আমি কথা বলতে থাকি।  তবে তাও একজন ভাল বন্ধু হিসেবে।  সে আমার সাথে একদিনও কথা না বলে থাকতে পারতোনা।আমার মনে পড়ে,  গত বছর মার্চ মাসের ২৪ তারিখ,  সেই দিনটি ছিল তার সবচেয়ে বড় খুশির দিন।  কারণ সেই দিনটি তার জন্মদিন ছিল। আমি সেই স্কুল বয়সে আমার ডায়রিতে লিখে রেখে ছিলাম সেই তারিখটি।স্কুলে তার জন্মদিনের দিনটিই ছিল তার আর আমার শেষ দিন।  এরপর আর দেখা হয় নি। ঠিক যখন ১২টা বাজলো আমি তাকে কল দিয়ে বার্থডে উইশ করলাম।  নিশান্তিকা বলল-
“তুমি কি করে জানলে আজ আমার বার্থডে?”

অন্তু- “প্রথমে কি বলবো বুঝতে পারলাম না,  পরে মাথায় এলো ফেইছবুকের কথা।  বললাম,  তোমার ফেইছবুকে আছে তো।”
নিশান্তিকা- “আজ আমি অনেক খুশি অন্তু।  কিন্তু আরো খুশি হতাম যদি আমার রেমন কে খুজে পাইতাম।”
অন্তু-“আমার মনে হয় একদিন না একদিন তুমি তাকে ফিরে পাবে।”

নিশান্তিকা-“জানো এই দিনটি ছিল তার আমার দেখা করার শেষ দিন।সেদিন খুব মজা হয়ে ছিল।  একটা কথা মনে করলে আমার এখনো খুব হাসি পায়।  সেদিন সে আর আমি যখন আমাদের স্কুলের বটগাছটার নিচে বসে ছিলাম।  আমি ব্যাগ থেকে একটি কেক বাহির করলাম।  ও কোন কিছু না জিজ্ঞাসা করে আমার হাত থেকে কেকটি নিয়ে পুরোটা খেয়ে ফেলল,  আর বলল-তুমি কি করে বুঝলে আমার পেটে অনেক ক্ষিদে পেয়েছে? তখন আমি বললাম বুদ্দু আজ আমার জন্মদিন।  তাই কেক নিয়ে এসেছি।

এরপর ও লজ্জায় লাল হয়ে গেল আর আমাকে বলতে থাকলো আমার খুব ভুল হয়ে গেছে।আমাকে মাপ করে দাও প্লিজ।আমি আবার একটি কেক নিয়ে আসবো এখনই।  এরপর আমি ওকে বললাম কোন দরকার নেই।তুমি খেয়েছো এতেই আমি অনেক খুশি কারণ এটি আমি তোমার জন্যই এনেছি। ”

আমার সেই দিনটির কথা ভেবে সেদিন বড় লজ্জা পাচ্ছিল।  তারপর আমি তাকে বললাম-
“নিশান্তিকা,  তোমাকে আজ আমি একটা কথা বলবো,  জানি না তুমি কথাটা কিভাবে নিবে।”

নিশান্তিকা-“বল,  কি বলবে।”
অন্তু – “দেখ তোমার কথা-বার্তা,  তোমার কেয়ারিং আমার খুব ভাল লাগে।   আর সবকিছু মিলিয়ে আমি তোমার কথা ছাড়া কিছুই ভাবতে পারিনা।  তাই আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
নিশান্তিকা-“কি সিদ্ধান্ত?”
অন্তু-“আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি।  ”

নিশান্তিকা অনেকক্ষণ কিছুই বলল না।  তারপর আমি তাকে বললাম “কি হল তুমি কি রাগ করলে?  ওর নিরবতা আমাকে বলে দিল সে আজো সেই রেমনকেই ভালবাসে।  আজকের অন্তুকে নয়।  তারপর আমি তাকে বললাম-আরে বোকা আমি তো তোমার সাথে মজা করলাম।  আমি তো জানি তুমি আজো রেমন কে ভালবাসো।”

তখন সে মৃদু স্বরে বলল-“দেখ বেদনার আড়ালে যে শান্তি খুজে সেও কিন্তু কিছুটা সুখ খুজে পায়।কিন্তু সেই সুখটা খুব একটা স্থায়ী হয়না।  যেটা আজ আমার বেলায় হলো।তোমার উপস্থিতি তে আমি ভাল থাকার চেষ্টা করি, কিন্তু তাই বলে আমি রেমন কে যে ভুলে গেছি তা নয়। আর তুমিই তো বললে, সে একদিন না একদিন ফিরবে।  তখন কি করবো আমি?”

অন্তু- “আমি আর কোন কথা বললাম না।  অনেক বার সরি বলে রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা করলাম।  তবে নিশান্তিকা রাগ করলে এত সহজে রাগ ভাঙ্গেনা।”

আমি আমার জীবনের সব কথাই বাবাকে বলতাম।  সেখানে আমার সবচেয়ে কাছের ও সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ছিল আমার বাবা।  কিন্তু তাকে মুখ লজ্জার কারনে এই কথাটি বলা হয়নি।  একদিন কৌতুহল বসত বাবার কাছে জানতে চাইলাম,  বাবা তোমাকে কেন সেদিন সেই লোকগুলো মারতে এসেছিল? আর কেন-ই বা তুমি চুপচাপ দেশ ছেড়ে বিদেশ চলে আসলে? 

বাবা আমাকে বলল- “এখন তুমি অনেক কিছু বুঝ, তাই আজ তোমায় বলছি। আমি ছিলাম একজন সরকারি কর্মকর্তা।  অফিসের উচ্চপদস্থ স্থানটা ছিল আমার।  দেশের উন্নয়নের জন্য ও বিভিন্ন ধরনের সরকারি কাজের চুক্তির কাগজ পত্র আমিই দেখতাম। কিছু অর্থলোভী লোক ছিল যারা এসব কাজ কন্টাক্ট করবে বলে কাগজ জমা দিত।  আর টাকা হাতে পাওয়ার পর ৩০ পার্সেন্ট ব্যয় করে,  ৭০ পার্সেন্ট নিজেদের পকেটে নিত।”
অন্তু- “বাবা সেই কাজ গুলো কি কি ছিল?”

বাবা- “যেমন-রাস্তা নির্মাণ, ব্রীজ নির্মাণ, এছাড়াও সরকারি বিভিন্ন উন্নয়নমুলক কাজ । তো ওরা আমাকে ঘুষ দিতে চাইলো এবং চুক্তিটা ওদের নামে করতে চাইলো। আর আমি ছিলাম তাদের প্রধান বাধা।  কিন্তু আমি আর শেষ পর্যন্ত কিছুই করতে পারলাম না। কারন ওরা ছিল তৎকালীন সরকার দলীয় উপনেতা।  উপরের মহল থেকে কার্য সিদ্ধি করে চুক্তি পাশ করিয়ে নেয়।
এরপর একদিন আমাকে হুমকি দেয়,  যেন আমি এক মাসের মধ্যে শহর ছেড়ে চলে যাই।  এরই মাঝে আমার ভাল একটা জব অফার আসলো নিউইয়র্ক থেকে,  আমি সেটা পেন্ডিংএ রাখলাম।  আর এর মধ্যেই ওরা হামলা করলো বাসায়।  তারপর নিউইয়র্ক আসার সকল প্রস্তুতি নিলাম।”

অন্তু-“বাবা এই সব লোক কি সব সরকারের ক্ষেত্রেই থাকে।  ”
বাবা-“হ্যা।  ”

যদি কখনো গল্প রচনা করা হয় সেই গল্পের সিকুয়্যান্স থাকে একটি সীমাবদ্ধতায়,  তেমনি থাকে নাটক,  উপন্যাস আর প্রবন্ধে।  কিন্তু মানব জীবনের বাস্তবতার যে নাটকীয়তা সেখানে কোন সিকুয়েন্সই সেসবের সাথে মিলেনা।আমার প্রবাস জীবনে অনেক মানুষের সাথেই চলাফেরা করেছি।  দেখেছি সেখানকার পরিবেশ, তাদের সংস্কৃতি,  অর্থনীতি ও রাজনীতি। এদেশ আমার জন্মভূমি।  এই মাটি আমার মা,  আর এই মাটিতেই মিশে আছে আমার মা।প্রবাস জীবনের সুখোল্লাসেও মন কেঁদেছে এই দেশে ফেরার জন্য।  নিউইয়র্কের কোন পটভূমিকাই আমার এ দেশের সমাজ-সংস্কৃতির উর্ধ্বে নয়।  

কিন্তু আমার এই দেশটাতে আজ মিশে আছে কিছু অসাধু রাজনৈতিক।  যারা নিজের সার্থের পক্ষে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।  নিজেদের ক্ষণস্থায়ী সুখ ও সম্মানের জন্য শত শত মানুষের জীবন নিয়ে খেলা করছে।  দলীয় কোন্দলের কারনে প্রতিদিন বহু সাধারণ মানুষের প্রাণনাশ ঘটে।  আর সেইসব মানুষের মৃত্যুর কথা শুনে প্রতিটা টেলিভিশনের ও পত্রিকার নিউজ হেড লাইনে লিখে দেন আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত।  কিন্তু আমার প্রশ্ন এই জাতির কাছে,  একবারো কি তাদের অন্তরে দুঃখবোধ হয়?  

যদি দুঃখবোধ হতই তাহলে আর কোন সাধারণ মানুষের জীবন নির্বিচারে দিতে হতো না।  
আমাদের নেতাদের চিন্তাধারাটা হয়ত এরকম,  সাধারণ মানুষের চিন্তা গোল্লায় যাক,  আমার আসনটা আমারই থাক।   

নিশান্তিকা প্রায়ই বলত এদেশের কথা। তার মুখ থেকে শুনে মনে হতো আমি যেন আমার এই দেশেই বিচরণ করছি।আমার কানে যেন বাতাসের ধ্বনির সাথে সেই ছোট্টবেলার স্কুলে গাওয়া অন্তরাটির সুর প্রতিধ্বণিত হত, “আমার সোনার বাংলা,  আমি তোমায় ভালবাসি।”

এরপর থেকে কখনো নিশান্তিকাকে কখনো কষ্ট দিতে চাইনি।  প্রতিদিন সময়ে-অসময়ে কথা বলেছি তার সাথে।  তার মনের ভিতরের সকল অনুভূতিগুলো পুনরায় যেন ছেলেবেলার মতো আমার সাথে শেয়ার করছে। এভাবেই চলে গেল একটা বছর।  গত বছর অর্থাৎ ২০১৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর।  নিশান্তিকার মাঝে কিছুটা পরিবর্তন অনুভব করলাম।  তার কথাগুলো কেমন যেন ছাড়া ছাড়া।  
আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম- “নিশান্তিকা তোমার কি কিছু হয়েছে?”
নিশান্তিকা- “কি হবে আমার?  আর তোমাকে এতকিছু আমি কেন বলব,  তুমি আমার কে?”
অন্তু- “আমি তোমার কেউ না তা জানি।  একজন পর মানুষ হিসাবে তো ভালভাবে কথা বলো।”
নিশান্তিকা- “আমার এখন তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছেনা।  তুমি আমাকে আর কোন দিন কল করোনা।”
অন্তু- “ঠিক আছে কল করবোনা।  কিন্তু একটাবার বল আমি কি কোন অপরাধ করেছি”  
এরপর সে ফোনটা রেখে দিয়ে সুইচট অফ করে দেয়। পরে কয়েক দিন আমি কথা বলার চেষ্টা করি,  কিন্তু সুইচট অফ থাকায় কথা বলতে পারি নি।কিছু দিন যাবার পর আমি আর সহ্য করতে না পেরে বাবা কে সব খুলে বললাম।  

বাবা আমাকে বলল- “আজ আমি বড় হতাশ,  তোমার কৃত কর্মে।  আমি ব্যর্থ আজ।  আমি ভেবেছিলামা জীবনের প্রতিটা কথাই তুমি আমার সাথে শেয়ার করবে।  আর এত বড় একটা কথা তুমি এত বছর আমার কাছে গোপন করে গেলে? আমি কি এতই পর তোমার? যে নিজের ভাগ্যকে দূরে রাখতে চায় সে কোন দিন ভাগ্যবান হতে পারে না।  যেই মেয়েটি সাড়াটা জীবন তোমার আশায় পথ চেয়েছিল,  তার সাথে তুমি এমন করলে?”

অন্তু- “বাবা,  আমি কি করেছি সেটা এখনো নিজের কাছে অস্পষ্ট।  আর তোমাকে তো বললাম আমি আমার মুখদিয়ে বের হচ্ছিল না কথাটা যদিও বহুবার চেষ্টা করেছি তোমায় বলতে। বাবা, দোহাই তোমার আমার প্রতি রাগ করোনা।আজ আমি বড় অসহায়।  তুমি ছাড়া আর কে আছে আজ আমাকে একটা ভাল পরামর্শ দিবে।”

বাবা- “দশ/পনের দিন আগে তোমার ফোনে কয়েকটা সর্ট মেসেজ এসেছিল,  আমার ফোনে ব্যালেন্স না থাকায় তোমারটা ইউজ করতে গিয়ে ভুলক্রমে সেগুলো পড়া হয়।  সেখানে নিশান্তিকা বলেছিল ‘অন্তু আমার জন্মদিনে তুমি আমাকে উইশ করেছিলে আর বলেছিলে আমার ফেইছবুক একাউন্ট থেকে তুমি আমার বার্থ ডেট জেনেছ।  পরে যখন আমি ভালভাবে দেখলাম,  তখন দেখি আমি আমার অরিজিনাল বার্থডেট দেই নি।  তারপর মনে পড়লো,  একদিন আমার বান্ধবীর ফোন থেকে তোমায় কল করেছিলাম,  তখন সেই নম্বরটি সেইভ করে রেখেছিলে আর তার কাছেই জেনে নাও আমার বার্থডেট।  তুমি আমার খবরাখবর আমার বান্ধবীর কাছ থেকে নাও।  আমি কি পছন্দ করি না করি সব তুমি তার কাছে জেনে নিয়েছ।  কেন আমাকে জিজ্ঞাসা করলে কি আমি বলতাম না।  এছাড়াও তুমি অনেক বড় একটা সত্য আমার কাছে গোপন করেছো।  তা হলো,  তুমি আমার জন্মদিনে আমাকে বলেছিলে তুমি আমায় অনেক ভালবাসো।  কিন্তু তা আমাকে সরাসরি প্রকাশ করনি।  আমি রেমন কে ভালবাসতাম,  হয়তো এখনো তাকে ভালবাসি।  কিন্তু তোমার সাথে কথা বলে বুঝতে পেরেছি তুমি অন্য এক রেমন।  তাই তোমার সাথে আমার সব অনুভূতির কথা বলেছি।কিন্তু তুমি শতবার আমাকে ভালবাসার কথা বলতে গিয়েও বল নি। কেন,  তোমার কি আমার ভালবাসা পাওয়ার অধিকার নেই? যাকে ভালবাসে তার কাছে থেকে ভালবাসা আদায় করে নিতে হয়।  যা তোমাকে দিয়ে হয় নি।তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোমার সাথে আর কথা বলবো না।  কারণ পৃথিবীতে রেমন একটাই হয়,  দ্বিতীয় নয়।  সেই আমার প্রথম এবং শেষ মানুষ।প্রয়োজন হলে চিরদিন তার অপেক্ষায় থাকবো।’ এখন ভেবে দেখ কি করা উচিৎ।”

অন্তু- “বাবা আমি বুঝতে পারছিনা আমি কি করবো?”
বাবা- “তার মানে তুমি আমার সাহায্য চাচ্ছ? ”
অন্তু- “হ্যা বাবা।  প্লিজ হেল্প মি।”
বাবা- “তুমি আজই ঢাকায় রওয়ানা হও।”
অন্তু- “আমি বাবাকে বললাম, কিন্তু বাবা তার কাছে তো আমি রেহমান অন্তু।  আর যখন আমি তার সামনে যাবো সে দেখবে রেমন কে।রেমন কে দেখার পর কি সে আমাকে বিশ্বাস করবে?”

বাবা- “সে দু’জনকেই এখন ভালবাসে।এখন সে যাকেই পায় তাকেই হয়তো অনেক ভালবাসবে। তবে আমার ধারনা সে তোমাকে অনেক ভালবাসে। তাই তোমার যাওয়া উচিৎ।  সেখানে যাও গিয়ে সবকিছু খুলে বল তাকে।”

তারপর বাবা সবকিছু ঠিক করে দিলেন।রাতের ফ্লাইটে আমি ঢাকা আসি। সকালে একটি হোটেল এ ওঠি। কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে তারপর রওয়ানা হলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে।যেতে যেতে কত ভাবনাই না আমাকে তাড়া করেছে, তার কোন ইয়ত্তা নেই।  অতিদূর সময় অতিক্রমের পর আকাক্সিক্ষত আশার আলোর সন্ধানে বড় ব্যাকুল চিত্তে যাত্রা করলাম। জানা নেই কি হবে তার প্র্রতিক্রিয়া,  কিরূপ হবে তার মানসিক অবস্থা। আবার মনে জাগে এতদিন পর হয়তো আমাকে চিনতে তার অনেক কষ্ট হবে।  

সে দেখতে যে কেমন হয়েছে এখন।  আমাকে দেখে যে এখন আগের মতো ভালবাসবে কিনা এমন সব প্রশ্ন মনে জাগতে শুরু হল।  সারা রাত জার্নি করে চেহেরা খুব বিমর্ষ মনে হচ্ছিল। তাই বার বার নিজের চেহেরাটা দেখতে লাগলাম বিভিন্ন দোকানের সামনের গ্লাসে।  শৈশবে যখন স্কুলে যাইতাম, যাবার পথে বার বার বিভিন্ন দোকানের গ্লাসে তাকিয়ে দেখতাম।  মনে হতো অন্য একটি ছেলে আমার পাশে পাশে হেটে আমার সঙ্গী হয়েছে।  

সকল কল্পনার ক্লান্তিলগ্নে পৌছালাম যথা স্থানে।  তবে সময় যে আমার জন্য সদাই অপ্রস্তুত তা বুঝতে বড় কষ্ট হল।  হলের সামনে যেতে না যেতেই কানে আসলো কয়েকদিন একটা মেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল হলে।  আজ সকালে নাকি অজ্ঞান অবস্থায় তাকে গ্রীন হসপিটালে এডমিট করানো হয়েছে। যখন বিস্তারিত জানতে গেলাম তখন মনে হলো না জানাই হয়তো ভাল ছিল।কারন এতদিন পরে যার জন্য এতদূর এসেছি সেই কেন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে থাকবে।  মনে একবার ভেবে নিলাম, না শেষ পর্যন্ত তাকে আর পাওয়া হলো না আমার।  হয়তো সেই রিক্ত হস্তেই ফিরতে হবে গন্তব্যে।  আমার উপর অভিমান করে তার আজ এই দশা।  


সবশেষে দ্রুত ছুটে আসলাম হাসপাতালে।  এসেই দেখি নিশান্তিকা ইমার্জেন্সি রুমে।  
নিশান্তিকার বান্ধবীরা বলল-“সত্যিই জীবন নাটকের চেয়ে অনেক বেশী নাটকীয়।কারন এই জীবনের উত্থান-পতন বুঝা বড়ই দায়।  আপনি ভাববেন না।আপনার ভালবাসা যেহেতু এত গভীর,  সেহেতু আপনার ভালবাসার আকর্ষণেই নিশান্তিকা সুস্থ হয়ে ওঠবে।  
অন্তু-“নিশান্তিকার বাবা-মা কি জানে?”

এক বান্ধবী- “আপনি হয়তো জানেন না,  ওর বাবা মা পাঁচ বছর আগে ওদের গ্রামের বাড়িতে,   বগুড়ায় চলে যায়।  আমরা তাদের খবর দিয়েছিলাম।  কিন্তু এখন সারাদেশে হরতাল ও অবরোধ চলছে।  সেজন্য তারা আসতে পারছেনা।  আমাদের বলেছে আমরা যেন,  ওর দেখাশুনা করি।”

জ্ঞান ফিরলো নিশান্তিকার। ওর বান্ধবীরা সব বাহিরে আর নিশান্তিকা কেবিনের ভিতরে।  অন্তু পাশেই দাড়িয়ে।  নিশান্তিকা তাকিয়ে দেখল তার পাশে একটি ছেলে দাড়িয়ে,  অনেকটা চেনা চেনা মনে হলো।  অবশেষে চিনতো পারলো সে রেমন।  সে প্রথমে অনেক খুশি হলেও পরে আবার সেই খুশিটা দুঃখের আড়ালে মিশে গেল।  কারন এতক্ষণে সে অপরিচিত অন্তু কে মনে প্রাণে ভালবেসে ফেলেছে।  কিন্তু এখন সে কি করবে।  নিশান্তিকা আবার অজ্ঞান হয়ে যায়। ডাক্তার বললো তার জন্য ইমিডিয়েটলি মেডিসিন ও ব্লাড প্রয়োজন।  অন্তু এসব আনতে গেল,  কিন্তু কোন দোকান খোলা পাচ্ছিল না,  তাই বহুদুরে গিয়ে একটি ফার্মেসী দেখল এবং মেডিসিন কিনল।  কেনার পরই শুনতে পেল চারিদিকে ককটেল আর গুলির শব্দ।

দোকান্দার বলল ভাই প্রাণে বাঁচতে চাইলে পালান,  কিন্তু অন্তু দেশের বর্তমান পরিস্থিতি তেমন বুঝে ওঠতে পারলো না। কারন সে দেশের রাজনৈতিক পরিস্তিতির বর্তমান প্রেক্ষাপট সমন্ধে শূন্যজ্ঞান ছিল।  এমন সময় অন্তুর মৃত্যু আশঙকা করে এক অপরিচিত যুবক তাকে বাঁচাতে ছুটে আসলো।  

এসে বললো ভাই পালাও, আমি তোমার পিছনে আছি, তানাহলে তোমাকে গুলি করবে।  তারপর দুজন দৌড়াতে শুরু করলো।  একসময় পুলিশ সন্দেহবসত গুলি ছুড়ে।  সেই গুলিতে অন্তুর মস্তকটা ফোটা করে দিল না,  বরং যে তাকে বাঁচাতে ছুটে আসলো তার মাথায় লাগলো।  

অন্তু খুব  কষ্ট করে তার বডিটা হাসপাতালে নিয়ে গেল কিন্তু ততক্ষণে সে আর নেই। অন্তুর জীবনে প্রথম কোন ট্রাজেডি নিজের চোখে দেখল।  সে কোন ভাবে মেনে নিতে পারলো না এই ঘটনাটি।অত:পর জানতে পারলো এই ছেলেটি নিশান্তিকাকে খুব ভালবাসতো,  কিন্তু কোন ভাবেই যখন তাকে পাচ্ছিল না তখন তার কাছে জানলো যে সে ছোট বেলার পরিচিত রেমন নামের একটি ছেলেকে ভালবাসে।সে তার জন্য অপেক্ষা করছে।ছেলেটি হাসপাতালে এসেছিল নিশান্তিকাকে দেখতে,  এসেই নিশান্তিকার বান্ধবীদের কাছে জানতে পারলো এই সেই রেমন,  যে নিউইয়র্ক থেকে এসেছে। তারপর থেকে সে তাকে কৌতুহল বসত তার পিছু পিছু অনুসরণ করেছে।আর যখনই দেখল সে বিপদাপন্ন অবস্থায়, তখন নিজের জীবন বিপন্ন করে তার জন্য মৃত্যুর কোলে ঝাপিয়ে পড়েছে।  

আর অন্য দিকে নিশান্তিকার জ্ঞান ফেরার পর যখন জানতে পারলো ফারিয়ান রেমনের জীবন বাঁচাতে গিয়ে মারা গেছে,  তখন সে রেমন কে বলল –“তুমি এতদিন কোথা থেকে কাল বৈশাখী ঝড় হয়ে ফিরে আসছো? কেন আসছো আমাদের সর্বনাশ করতে।”  

অন্তু কিছুই বলল না।  
অবাক হয়ে প্রিয় মানুষটার দুই ঠোট নড়াচড়া দেখল।  অনুভূতির অন্য এক জগতে যেন সে হারিয়ে গেল।  প্রিয়ার কন্ঠটা যেন তার কানে শত বছর পূর্বের   এক যাদুকরী বাশরীর সুরের মতো মনে হতে লাগলো।  কিন্তু নিশান্তিকা যখন দেখল তার এত বকার পরও সে কোন কর্ণপাত করলো না তখন সে হাতের কাছে গ্লাস টা নিয়ে রেমনের বুকে ছুড়ে মারলো।  এখন রেমন কিছুটা অবাক না হয়ে পারলো না।  

সে ভাবলো নিশান্তিকা তো আমাকে বার বার ফিরিয়ে দিয়েছে  তার ছোট বেলার রেমন কে ভালবাসে বলে।  আর আজকের আমি তো তার ছোট বেলার রেমন,  তবে কেন সে আমাকে এত অপবাদ দিচ্ছে।  তাহলে কি সে ফারিয়ান কে ভালবেসেছিল? 

এমন সব প্রশ্ন যখন তাকে তাড়া করছিল তখন নিশান্তিকার এক বান্ধবী বাহির থেকে দেখলো সে রেমনের ওপর গ্লাস ছুড়ে মেড়েছে।  
সে এসে বলল- “এটা কি করলি নিশান্তিকা?  যে তোর জন্য সুদূর নিউইয়র্ক থেকে ছুটে এসেছে,  জীবনের পরোয়া না করে তোর জন্য ঔষধ আনতে ছুটে গেছে,  তোর পাশে থেকে সেবা করছে,  আমাদের কে আসতে দেয়নি কাছে।  সে নিজেই সব কিছু করছে।  তাকে তুই আঘাত করতে পারলি?”

নিশান্তিকা-“ ও নিউইয়র্ক থেকে এসেছে?  কে বলল তোকে? এই –ই সেই ব্যক্তি যে ছোট বেলা থেকে আমার মনের ভিতরে বসেছিল।  যখন পাগলের মতো দিশেহারা হয়ে খুজেছি,  তখন তার কোন দেখা মিলেনি।  অনেকগুলো বছর একটা পথে হেটে হঠাৎ হারিয়ে যায়।  কিন্তু হারায়নি আমার এই মনটা থেকে।  কিন্তু যখনই আমি ‘রেহমান অন্তু’র প্রতি আসক্ত হতে শুরু করেছি তখনই আমার সামনে এসে দাড়িয়েছে।”
তখন ওর বান্ধবী মোর ঘুরিয়ে বলল- “কেন তুই তো বলতিস,  তুই আজো সেই রেমনকেই ভালোবাসিস?”
নিশান্তিকা- “বাসতাম তবে এখন আর বাসিনা।  ওকে চলে যেতে বল।  আর এরকম প্রতারণা করার কি আছে যে নিউইয়র্ক থেকে এসেছে?  নিশ্চয়ই তোরা ওকে ‘রেহমান অন্তুর’ কথা বলেছিস,  তাই না? 
তখন ওর বান্ধবী বলল- “ হ্যা। 
রেমন কে ইশারা করে বলল,  যাও তুমি চলে যাও।”  
রেমন বের হয়ে গেল।  তারপর ওরা সবাই নিশান্ততিকা কে সব কিছু খুলে বলল।  

নিশান্তিকা অজ্ঞানের মতো দৌড়াতে শুরু করলো।  কিন্তু এতক্ষণে আর রেমন নেই,  সে হয়তো বিমানে ওঠবে বলে।  হতাশা আর গ্লানি নিয়ে ফিরে গেল নিশান্তিকা হাসপাতালে।  যখনই চিৎকার করে ওর বান্ধবীর হাতটা ধরলো,   দেখল হাতটা কেমন একটা ছেলেদের হাতের মতো।  চেহেরার দিকে তাকিয়ে দেখল,  রেমন ওর বান্ধবীর পিছন থেকে হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছে।  আর বলছে- “এত দূর হতে কাছে এসেছি কি চলে যাওয়ার জন্য?”
 যারা প্রকৃতিতে প্রাকৃতিক নিয়মের অন্তঃপুরে অবস্থান করে প্রাকৃতিক মনের সঞ্চিত প্রবল অনুভূতির বিচরণ ঘটাতে চায় দু’টি মনের অভ্যন্তরে,  জয় তাদেরই।  আর মধুময় এই পৃথিবীটা তাদের পবিত্র ভালোবাসারই চারণভূমি।  সেখানে প্রকৃতি সর্বদা তাদের অনুসরণ করে খুব কাছে থেকে।  ভালবাসার রাজ্যে কেবল তাদেরই বসবাস,   যারা প্রকৃত ও পুত পবিত্র ভালোবাসার যোগ্য প্রতিনিধি।   

(-!-)  আজকের মতো শেষ  (-!-)
সম্পূর্ণ পড়ুন...

বাংলা নাটক_ ব্যবহার || মোঃ অলিউল্লাহ্

ব্যবহার
মোঃ অলিউল্লাহ্



[প্রথম অঙ্ক- দৃশ্য এক]


মামা জুতাটা সেলাই করে দাও তো।
কেন আপনার মায়ের আপন ভাই নেই?
আছে। কিন্তু কেন?
তাহলে কি পৃথিবীতে নেই?
হ্যা। পৃথিবীতেই আছে। কেন বলতো?
মামা আছে। পৃথিবীতেও আছে। তো আমাকে এত মামা ডাকতে স্বাদ হলো কেন? আমি টাকার জন্য জুতা সেলাই করি, মামা ডাকেন-চাচা ডাকেন আর ফুফা ডাকেন টাকা ছাড়া কাজ করবো না।

এই তুমি কি ঢাকায় নতুন এসেছো? আর এত বেশি কথা বল কেন? আমি কি তোমায় বলেছি আমি টাকা দেব না?
তো টাকা-ই যদি দিবেন মামা ডাকার কি দরকার? বেশি কথা আমরা কইলে দোষ। নেতারা যখন মঞ্চে ওইঠা মিথ্যা মিথ্যা বক্তিতা দেয়। মানুষকে উস্কানি দেয় আর দেশে যত খারাপ কাজ আছে ওদের লোক দিয়া করাইয়া নেয়,ওইগুলা দোষের কিছুনা।

এই দাও আমার জুতা দাও। তোমাকে আমার জুতা সেলাই করতে হবে না।
আরে ঠিক আছে কইরা দিতাছি। কিযে ভাব দেখান আপনেরা! পারেন আমাগো সাথেই। কোন ভদ্রলোকের সাথে তো পারেন না এমন করতে।

আমি রাসেদ। মায়ের হোটেলের একমাত্র খরিদ্দার। বাবা পাঁচ বছর আগেই হোটেল চালানোর দায়িত্ব ছেড়ে, যে দুনিয়া চালায় তার সাথে সাক্ষাৎ করতে গেছেন। এরপর থেকে হোটেলের দায়িত্ব পরে মায়ের ওপর। মা বেশ ভালই চালাচ্ছে। আমার কোন টাকা লাগে না। প্রতিদিন অনেক ভাল ভাল খাবার খেতে দেন আর খাবারের পর কোল ড্রিংকস হিসেবে গালাগাল দেন। সকালে বের হয়ে ছিলাম মায়ের আসির্বাদ নিয়ে, চাকরি খুজবো বলে। তখনও খেয়ে বের হয়েছিলাম, খাবার নয়; লাথি। সকাল ৯টা পর্যন্ত ঘুমাচ্ছিলাম আর জিমের গাইড ভেবে পাঞ্চ খেয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু ঘুম ভাঙতেই দেখি মা লাথি মেরে আমায় ঘুম ভাঙাচ্ছে। এটাই আমার প্রত্যেকদিনের আসির্বাদ।

[চলুন দেখে আসি-

(মায়ের পার্ট- (ছেলে ঘুমুচ্ছে)
রাসেদ, ও রাসেদ ঘুম থেকে ওঠবিনা। কত বেলা হয়েছে তার কোন খবর কি আছে? বলদের বাচ্চা বলদ, বলদের মতো শুধু ঘুমাবে। (থুক্কু এটা কি বললাম। তা কি সম্ভব?)
গেট আপ, গেট আপ। অনেক বেলা হয়ে গেছে।

ছেলে- (ওঠে বসে চোখ মুচরাচ্ছে। তারপর আবার শুয়ে পরলো।) নাহ আরেকটু ঘুমাই।
মা- (রেগে) বুঝছি তোরে লাথি মাইরা বাপের নাম না ভুলাতে পারলে তুই ওঠবিনা। (নিচু স্বরে- ওহ বাপের নাম ভুলে গেলে লোকে কি বলবে? থাক বাপের নাম ভুলতে হবে না।)

ছেলে- (শুয়ে) মা, বাবাকে তোমার ইদানিং পছন্দ হচ্ছে না?
মা- (নিচু স্বরে) কেন বলতো?
ছেলে- (হাসির ছলে) না মানে, কথায় কথায় তুমি বলো আমার বাপের নাম ভুলিয়ে দিবে। আচ্ছা তোমার কি কাউকে পছন্দ, আই মিন তুমি কি কারো প্রেমে পড়েছো?
মা- (রেগে) ওরে বদের বাচ্ছা। (একথা বলেই লাথি)


[দৃশ্য-দুই]

এক অফিসে গেলাম ইন্টারভিউ দিতে। সেখানে গিয়ে দেখি আমার এক বন্ধুও সেখানটার কেন্ডিডেট। বন্ধু হলেও সে কোনদিনই আমার ভাল চাইত না। আমায় দেখেই তার চোখ কপালে উঠার চেষ্টা করল। তার নাম গালিব। তবে আমরা সবাই গালি বলেই ডাকি। তবে গালি বলে অন্যদের কাছে পরিচয় দিতে দিতে অনেকে আবার মিসগাইড হয়ে ওকে নানান ভাবে গালমন্দ করে।

দেখুন তাহলে

ইমরান- এই সালা,ভার্সিটি যাবি না? (গালিব চুপ) ওই বলদ। ওই ভোদাই। আমার কথা শুনিস না?
গালিব- (রেগে গিয়ে ) ওই তোরা আমায় সবসময় গালি দিস কেন?
ইমরান- (উত্তরে বলে) আরে সবাই তো জানে তোর নাম গালি। তাই আমরা গালি দেই।
আসলে ওর এই অবস্থার জন্য আমিই বেশি দায়ী। কারণ এই কথাটা আমিই ছড়িয়েছি। আর একারণেই ও আমায় সহ্য করতে পারে না। তো ওকে ইন্টারভিউ এর জন্য ডাকলো। সে ভাল ইন্টারভিউ দিল এবং ওর চাকরি হয়ে যাওয়ার পসিবিলিটি নব্বইভাগ।

 [ইন্টারভিউ বোর্ড (জাকারিয়া,গিয়াস, একজন মেয়ে)- ওকে ইউ আর সো স্মার্ট এন্ড  স্কিল্ড। সো ইউ আর হায়ার্ড।ইউ ক্যান জয়েন এট আওয়ার কোম্পানী।]

তারপরেই আমার ডাক পড়লো। আমি ভিতরে গেলাম।
(ইন্টারভিউ বোর্ড এ) বসতে বলল না, কিন্তু আমি এত ভদ্রতা না দেখিয়ে বসে গেলাম।
(ইন্টারভিউ বোর্ড এ) আমায় জিজ্ঞাসা করলো- কিছু বলেন।
আমি বললাম- কিছু।

ওনারা আমার কথা বুঝল না, বলল হ্যা কিছু।
আমি আবারো বললাম- কিছু।
কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করে একজন বলল- হ্যা । কিছু বলেন।
আমি তখন একটু জোরেই উত্তর দিলাম- বললাম তো কিছু।

তখন আরেকজন বলল- এক্সকিউজ মি, আপনাকে বলেছি আপনার সম্পর্কে কিছু বলতে। এবার বুঝতে পেরেছেন?

আমি কিছুটা থতমত হয়ে বললাম, আমি রাসেদ। আমার বাবার নাম অমুক চৌধুরী। আমি কইয়া যা মডার্ন ইউনিভারসিটি থেকে এমবিএ কমপ্লিট করেছি।

(ইন্টারভিউ বোর্ড ) একভদ্রলোক আমায় থামিয়ে দিয়ে বললেন-‘আপনি যা বলেছেন, তা আমরা সিভিতে দেখেছি। নতুন কিছু বলেন।

আমি (মনে মনে নিচু সুরে বললাম), সালা সিভিতে দেখলে আবার প্রশ্ন করতে হয় নাকি। তারপর বললাম- নতুন কি বলবো। আমার সম্পর্কে সবকিছুই তো কোথাও না কোথাও বলেছি। নতুন কিছু নাই । আর যদি পরে খুঁজে পাই তাহলে জানাবো।

(ইন্টারভিউ বোর্ড ) আমায় তখন বললো- আমরাও আপনাকে জানাবো চাকরির ব্যাপারে এবার আসুন।
আমি জানি আমার চাকরি হবে না। তাই আমার বন্ধু চাকরি পেয়ে যাবে এটাতো হতে পারে না।
আমি বললাম, স্যার আরেকটা কথা ছিলো।

(ইন্টারভিউ বোর্ড ) কি কথা?
আমার আগে একটা ছেলে এসেছিল, নাম গালিব?
(ইন্টারভিউ বোর্ড)- হ্যা, এসেছিল। কিন্তু কেন?

স্যার, ও আর আমি একই ভার্সিটিতে পড়েছি। আমার ভিতরে প্রবেশের আগে গালিব আমায় বলল আমি যেন আপনাদের তার সম্পর্কে অনেক ভাল কিছু বলি। তাকে যেন চাকরিটা দিতে বলি। আচ্ছা আপনারাই বলেন আমি কি ওর চাকরির জন্য কিছু করতে পারি বলেন? এই যে আমি একটা ভাল ইন্টারভিউ দিলাম।

ও যদি এইভাবে দিতে পারতো তাহলে তো ওর চাকরিটা হয়ে যেত। বেচারা।
সবাই খুব বিরক্ত হলো ওর কারণে। দুজনেরই চাকরিটা হলো না।


[দ্বিতীয় অঙ্ক- দৃশ্য এক]

ইন্টারভিউ শেষে আমি এক পার্কে বসেছিলাম, দেখা হলো এক ব্যক্তির সাথে তার নাম সোহাগ।
সোহাগ- (হাসি মুখ করে) ভাই আপনার নাকি মন খারাপ?
রাসেদ- আপনাকে কে বলল?
সোহাগ- না আপনি নাকি প্রেমে ব্যর্থ?
রাসেদ- আরে আজব তো, আপনার কি কোন সমস্যা আছে?
সোহাগ- আপনার নাকি অল্পতেই অনেক গরম হয়ে যায়?
রাসেদ- মানে?

সোহাগ- না, মানে আপনার নাকি অল্পতেই খুব মাথা গরম হয়ে যায়?
রাসেদ- দেখুন, এসব বাজে কথা না বলে, আপনার মতলব কি বলেন তো?
সোহাগ- আমার মতলব থানা। (রাসেদের দিকে তাকিয়ে। রাসেদ অবাক হয়ে) বুঝলেন নাতো? মানে আমার বাড়ি,চাঁদপুর । মতলব থানা।
রাসেদ- হ্যা, তো আমি কি করবো?

সোহাগ- না না, আপনাকে কিছু করতে হবে না। আপনার সাথে একটু গল্প করতে চাই।
রাসেদ- ও আচ্ছা, নিশ্চয়ই অবসর সময়টাকে কাজে লাগানোর জন্য আমাকে ব্যবহার করছেন?
সোহাগ- ব্যবহার?

রাসেদ- ওহ ,ব্যবহার কি বুঝলেন না? যেমন ধরেন, রাজনীতিতে নেতারা সাধারন মানুষকে ব্যবহার করে। কর্মস্থানে উচু পদের লোকেরা নিচুপদের লোকদের ব্যবহার করে। বড় দেশ ছোট দেশকে সুযোগে ব্যবহার করে। একবন্ধু কোন প্রয়োজনে অন্য বন্ধুকে ব্যবহার করে। গার্ল ফ্রেন্ড উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য বয়ফ্রেন্ড কে ব্যবহার করে। কোন কোন বয়ফ্রেন্ড আবার সুপ্রিয় কথা বলে, গালফ্রেন্ডকে পটিয়ে জৈবিক ক্রিয়া সাধনের জন্য মেয়েটিকে ব্যবহার করে। শুধু তাই নয়, পৃথিবীর সকল মানুষ কোন না কোন ভাবে অন্যদের ব্যবহার করছে।

তবে জিনিস পত্র ব্যবহারে বিষয়টা তো আছেই। মজার ব্যাপার কি জানেন, কাউকে ব্যবহার হয়ে গেলে না, পরে আর তার কথা কারো মনে থাকে না। আর এটাই বড় তিক্ত ঘটনা।




------সমাপ্ত-------
সম্পূর্ণ পড়ুন...