Showing posts with label ছোট গল্প. Show all posts
Showing posts with label ছোট গল্প. Show all posts

Sunday, May 18, 2025

যে চিন্তায় দিশেহারা মানুষ

 যে চিন্তায় দিশেহারা মানুষ

                                                                                   মোঃ অলিউল্লাহ

সমস্ত পৃথিবীর মানুষের ভাবনার অন্যতম কেন্দ্রে অবস্থান যে বিষয়টির, তা হলো টাকা ও সম্পদ। শৈশব ও কৈশোর পেরোলেই যেন প্রতিটা মানুষের জীবনে তৈরি হয় স্বাভাবিক ভাবে বেঁচে থাকার আকাঙ্খা। আর জীবনে সুন্দরভাবে বাঁচতে গেলে অর্থ বা সম্পদের বিকল্প নেই। মানব জাতি ছাড়াও পৃথিবীর সকল প্রাণীরই বেঁচে থাকতে হলে খাদ্যের প্রয়োজন পড়ে সবার আগে। সর্ব শক্তিমান আল্লাহ তা’য়ালা প্রতিটা প্রাণীর জন্যই রিযিকের ফায়সালা করে রেখেছেন। সকল প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য মৌলিক যে উপাদনা গুলো তার মধ্যে অন্যতম হলো খাদ্য, বাসস্থান ও জৈবিক চাহিদা। 

যেহেতু আল্লাহ তা’য়ালার বিশেষ ও শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হচ্ছে মানব জাতি, তাই মানুষের জন্য রয়েছে কিছু বাড়তি উপাদান। যেমন:- খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বিনোদন। তবে প্রকৃতির সকল প্রাণীর সাথে মানুষের জীবনের সামঞ্জস্যতার বিবেচনায়, একটি মানুষের জীবনে যে আহা মরি কোন পার্থক্য নেই তা উপলোব্ধির সময় ও সুযোগ মানুষের হয় না। যদি কোন মানুষ চিন্তা করে একটি পাখিকে নিয়ে, পাখিটির বাঁচার জন্য দরকার খাবার, আর সেই খাবারের আহরণ করে ও সামান্য পরিশ্রম করে পাখি তার খাবার জোগায়। দয়াময় আল্লাহ তার  পাখির সেই সামান্য চেষ্টা ও শ্রমের উসিলায় তাকে রিযিক দান করেন। তেমনি পৃথিবীর প্রতিটা প্রাণীর আহারের ব্যবস্থা করেন মহান রাব্বুল আলামিন।

 

 মানুষের জীবনের সঠিক উদ্দেশ্য কি, তা বোধগম্য হয়ে ওঠে না মরার আগ পর্যন্ত বহু মানুষের। কেউ কেউ জীবনকে অনুসন্ধান করেন বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। সেই দৃষ্টিভঙ্গি কিছু মানুষকে সঠিক পথে হয়তো নিয়ে যায়। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষকে নিয়ে যায় ভ্রান্তির পথে, গোমরাহির পথে।


সম্পূর্ণ পড়ুন...

Sunday, June 12, 2022

সব মানুষই পাগল

 সব মানুষই পাগল

মোঃ অলিউল্লাহ্


প্রকৃতির প্রতিটা উপাদানেরই নির্দিষ্ট সীমারেখা বা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আর প্রকৃতির  এই নির্দিষ্ট সীমা যখন অতিক্রম করা হয়, তখনই ঘটে প্রাকৃতিক দূর্যোগ। কৃত্রিমতা বা আর্টিফিশিয়ালিটি সব সময়ই প্রাকৃতিক উপাদানের উপর একটা অতিরিক্ত প্রলেপন। যেমন- মহান আল্লাহ কোন মানুষকে নির্দিষ্ট আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন, অথচ একজনের মনে হলো আমার চেহেরায় মেকআপ করলে আমাকে আরও আকর্ষণীয় দেখাবে। আর তাই সে নিজেকে সব সময়ই কৃত্রিম সাজসজ্জার মাধ্যমে আকর্ষণীয় করে রাখতে চায়, কিন্তু নির্দিষ্ট একটা বয়সে কিন্তু ঠিকই তার এই আর্টিফিশিয়ালিটি আর কাজে আসেনা, তার চেহারায় বয়সের ছাপ পড়ে; এমনকি কখনো কখনো সেই কৃত্রিমতার জন্য তার স্বাস্থ্যহানি বা ক্ষতিও হয়ে থাকে। 


প্রকৃতি সর্বদাই নির্দিষ্ট রূপে ভারসাম্য বজায় থাকে, কিন্তু যখনই প্রকৃতিতে জোর করে কৃত্রিমতাকে চাপানোর চেষ্টা করা হয় তখন প্রকৃতি তার বিপরীতে প্রতিক্রিয়া দেখায়। সেটা কিছু আগে অথবা পরে। 


পৃথিবীতে মানুষের জন্য আল্লাহ তায়ালার যে বিধান রয়েছে, সেই আইন বা বিধান মেনে চললে কোন মানুষই ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারেনা। কোন জীবন ব্যবস্থায় যতক্ষণ সুশৃঙ্খল ও আইন মানার প্রবণতা থাকে, সে জীবন ব্যবস্থা সবদিক থেকে ভারসাম্য বজায় থাকে।


এবার আসি আসল কথায়, আসলে আমার এই ভাবনা অনেকের কাছে অতি তুচ্ছ মনে হতে পারে। অনেকে ভাবতে পারেন এসব পাগলের প্রলাপ, অথচ আমি সেসব মানুষের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি বা পাগলামি নিয়েই কথা বলছি।


দেখুন, একজন ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত স্বাভাবিক অবস্থানে থাকে যতক্ষণ সে তার সুনির্দিষ্ট প্রয়োজন পূরণে ঠিক যতটা তার দরকার ততটাই সে পায়।  অর্থাৎ প্রকৃত অর্থে কোন মানুষের যতটুকু যা প্রয়োজন, ততটুকু পেলেই তার যথেষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু যখন এর কম অথবা বেশি হয় তখনই বিপর্যয় ঘটে। ধরা যাক, একজনের পেটে ক্ষুধা লেগেছে, তার পেট ভরার জন্য যতটুকু খাবার দরকার ঠিক ততটাই তার জন্য যথেষ্ট। এর কম হলে পেট ভরবেনা অস্বস্তি লাগবে, আবার যদি পরিমাণের চেয়ে বেশি খায় তখন বদহজম হবে, আর তাতেও তার অস্বস্তি লাগবে। ঠিক তেমনি জীবন ধারনের জন্য মানুষের যা কিছু প্রয়োজন, ঠিক তা থাকলেই সুন্দরভাবে জীবন কেটে যাবে। এর কম-বেশি হলেই জীবনে ভারসাম্যহীনতা দেখা যায়। 


মানুষের মৌল মানবিক চাহিদার মধ্যে আবশ্যিক বিষয়গুলোর বাইরে যা আছে তা-ই কৃত্রিমতা। অর্থাৎ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা এইসব চাহিদা একটা মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অতি প্রয়োজন। আরোও স্পষ্ট করে যদি মৌলিক চাহিদার কথা বলি তাহলো ক্ষুধা, নিদ্রা, মৈথুন। এগুলোর মধ্যে কোনটির অভাব হলেই জীবনযাপনে বাধাগ্রস্থ হবে। আবার এসব চাহিদার পরেও যাদের আরো অনেক চাহিদা তৈরি হয় তা নেহাত বিলাসিতার শামিল। এর মানে হলো এই যে, কেউ খাবার খেতে বসল, আর তার সামনে বিশ-ত্রিশটি আইটেমের খাবার পরিবেশন করা হলো। হয় সে সবগুলো থেকে একটু একটু করে টেস্ট করবে, না হয় দু'য়েকটা আইটেম দিয়েই খেয়ে উঠবে। এখানে মুদ্দা কথা হলো একজন ব্যক্তির খাবারের জন্য ঠিক যতটুকু খাবার দরকার ততটুকুই পরিবেশন করাটা স্বাভাবিক, এর বেশি করাটা অস্বাভাবিক বা বিলাসিতা। আর একটা সহজ ব্যাপার হলো অপচয়ের পরিণতি অভাব। এই কথার অর্থ হলো যদি একজনের আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি হয়, তাহলে অচিরেই সে অভাবগ্রস্থ হবে। যা কিনা তার জীবন যাপনের জন্য একটি বিপর্যয় বা প্রতিবন্ধকতা। 


প্রাকৃতিকভাবে মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যা কিছু দরকার, তার বাইরে যে সকল বিষয়ের প্রয়োজন পড়ে তা হলো, চিত্তবিনোদন, সামাজিক পদমর্যাদা, ব্যক্তিত্ববোধ ও নিজেকে মানুষের চোখে শ্রেষ্ঠ করে তোলার একটা আপ্রাণ চেষ্টা। সেটা হতে পারে ক্ষমতার মাধ্যমে বা নিজের অবস্থান দ্বারা মানুষকে আকৃষ্ট করে লোকের চোখে নিজেকে জনপ্রিয় ভাবার মাধ্যমে আত্মতৃপ্তি। এই যে একধরনের চাহিদা, এটা খুবই মনস্তাত্ত্বিক ও মানুষের এক ধরনের ইলিউশান বা মোহ। আর এই মোহের কারনে মানুষ যারপরনাই ভূমিকা পালন করতে পারে। এক কথায়, এটা মানুষের একধরনের পাগলামি। ঠিক এই জায়গাটায় এসে সব মানুষই পাগল।


দেখেন, আপনার একান্ত মৌলিক চাহিদাগুলো যখন মিটে যায়, তখন আপনি স্বস্তিতে থাকেন। আর কথায় তো আছেই, সুখে থাকলে ভূতে কিলায়। যখন আপনার গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা মিটানোর পর স্বস্তিতে আছেন, তখন আপনার বিলাসী মন আরোও স্বস্তি বা ভালো থাকতে চাইবে। অর্থাৎ আরও কিভাবে ভালো থাকা যায় সেই চিন্তা আপনাকে অনবরত পোক করতে থাকবে। আর আপনি তখন আরও একটু বেশি ভালো থাকার কথা চিন্তা করে হয়তো অনেক পরিকল্পনা করবেন। এই যেমন- লোকের চোখে জনপ্রিয় হওয়ার জন্য কোন নেতা হলেন বা নিজের প্রতিভা দেখিয়ে হিরো কিংবা মডেল হলেন; যা আপনাকে একটা বাড়তি আত্মতৃপ্তি দেবে। তখন আপনি আহ্লাদে গদগদ হয়ে বলতেই পারেন, আরেহবাহ আমি তো বিশাল কাজ করে ফেলেছি। কিন্তু সত্যিকার অর্থে এটা একধরনের মোহ বা মায়া। মৌলিক চাহিদার বাইরে যে চাহিদাই আসে তা আপনার মধ্যে মোহ তৈরি করে। 


এই দুনিয়ায় একেকজন মানুষ একেকটা জিনিসের প্রতি পাগল। কেউ পাগল ক্ষমতার, কেউ ধনসম্পদ বা টাকার পাগল, কেউ কারো প্রেমে পাগল, কেউবা জনপ্রিয় হবার পাগল, কেউ আবার ভাবের পাগল। যাইহোক, আমার এসব কথা বলার উদ্দেশ্য হলো এই পাগলামি বা এইসব চাহিদা কেবল মানুষকে বস্তবাদী ও দুনিয়ামুখী করে তুলে। দুনিয়াতে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে কিংবা নিজের অস্তিত্বকে স্থায়ী রূপ দিতে আমরা কত কিছুই না করতে চাই। দুনিয়াকে পর্যাপ্তভাবে ভোগ করার মানসিকতার কারনে আমরা আমাদের আসল পরিচয় ভুলে যাই। মহান সৃষ্টিকর্তা কোন উদ্দেশ্যে আমাদেরকে এই দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন তার কথা ভুলে যাই। 


আমাদের এই ভোগবাদী মনোভাবের কারনে আমরা যারপরনাই খারাপ কাজে লিপ্ত হই। এই দুনিয়ায় চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, ঘোষ খাওয়া, সুদ খাওয়া, হত্যা, নির্যাতন, জুলুম ও অত্যাচার সবই সংগঠিত হয় এই ভোগবাদকে কেন্দ্র করে। যা প্রকৃতির প্রতিকূলে গিয়ে সামাজিক সমস্যা তৈরি করে। অথচ একজন মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য খুব বেশী কিছু দরকার পড়েনা। যদি কেউ ধর্মীয় বিধি বিধান মেনে চলে, তাহলে সে নিশ্চিত ভাবে সেই স্বাভাবিক জীবন ধারার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। একজন মুসলিম হিসাবে আমি ইসলাম ধর্মকে স্বয়ং সম্পূর্ণ মনে করি। আর আল্লাহ তায়ালা নিজেই বলেছেন, নিশ্চয়ই ইসলাম আল্লাহর মনোনীত ধর্ম। 


যেখানে ভোগবাদ মানুষের মধ্যে মোহ তৈরি করে তাকে দুনিয়া মুখী করে তুলে, সেখানে ধর্মীয় অনুশাসন ও ধর্মীয় মূল্যবোধ একজন মানুষকে সর্বোচ্চ  নৈতিক হতে সাহায্য করে। তার ভিতর কেবল দুনিয়ার প্রতি লোভ লালসা নয়, যেখানে মৃত্যুর পরে অনন্তকাল থাকতে হবে সেই ভাবনা তার মধ্যে কাজ করে। সে মৃত্যুকে ভয় করে, মৃত্যুর পরের জীবন সম্পর্কে ভয় করে, জান্নাত ও জাহান্নামের কথা স্মরণ করে দুনিয়ায় ভাল কাজ করে। 


যার ভিতর দ্বীনের প্রতি গভীর বিশ্বাস আছে, সে ভোগবাদী না হয়ে বরং দুনিয়াতে কোনভাবে বেঁচে থাকার কথা ভাববে। আর তাই এই বস্তুবাদ মানুষের ক্ষণিকের মোহ বা ইলিউশান ছাড়া কিছুই না। কারন প্রতিটা প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। আর একজন মানুষ যখন মরে যায়, তখন দুনিয়ায় তার কোন অস্তিত্বই থাকেনা। যদিও বস্তবাদীরা কিছু মৃত মানুষের ইহলৌকিক কৃতকর্মের জন্য তাদের স্মরণীয় বা অমর বলে দাবী করে। আর এটাও তাদের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি কিংবা মোহ মায়ার প্রতিফলন ছাড়া কিছুই না। 


কেনো একজন মানুষ মরে গেলে তার কোন অস্তিত্ব থাকেনা? 

কারন ব্যক্তি নিজেই নিজের উপস্থিতি দেখছেনা। যেখানে আমি নেই, সেখানে আমার অস্তিত্ব কি করে থাকতে পারে। যে পৃথিবীতে ভাল থাকার জন্য এতো কিছু করছি, কতদিন আমি এখানে থাকতে পারবো? প্রতিটা মানুষের একটা নির্দিষ্ট বয়সসীমা বা ভ্যালিডিটি দিয়ে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে, এই ভ্যালিডিটি ফুরিয়ে গেলেই চলে যেতে হবে দুনিয়া ছেড়ে। কোথায় যাবো আমরা মৃত্যুর পর? কী হবে আমাদের সাথে? আর মানুষকে আল্লাহ তায়ালা এতো সুন্দর চিন্তা শক্তি ও বিবেক দেওয়া সত্ত্বেও যখন মানুষ ভ্রান্ত পথে চলতে চলতে পথভোলা হয়ে যায়, তারা পাগল ছাড়া আর কি?  তাদের ভোগবাদ বা বস্তুবাদী মানসিকতা তাদের মধ্যে যে মোহ বা পাগলামির জন্ম দিয়েছে, সেই মোহে তারা অন্ধ। তারা তাদের জ্ঞানের সীমাকে সংকোচিত করে রেখেছে। আর সেজন্যই তাদের এই দুনিয়াপনা বা ভোগবাদ তাদেরকে পাগল হিসাবে সাব্যস্ত করেছে।


শেষ কথা হলো আমার এই লেখার প্রসঙ্গটিকে অনেকে ভুল ব্যাখা করতে পারেন। তারা হয়তো বলতে পারেন, শুধু যদি মৌলমানবিক চাহিদা পূরণ করেই মানুষ খান্ত হয়ে যায়, তাহলে তো মানুষের সৃজনশীলতার প্রকাশ পাবেনা। মানুষ একটা গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ হয়ে যাবে এবং মানুষ যদি কেবল আখিরাত নিয়ে ভাবে তাহলে দুনিয়ায় তো অচলাবস্থা তৈরি হয়ে যাবে। দেখুন, আমি আমার কথাগুলো দ্বারা শুধুমাত্র বুঝাতে চেয়েছি, কেউ যেনো ভোগবাদে এতটাই আসক্ত না হয়, যাতে করে সে আখেরাত বিমুখী হয়ে যায়। দুনিয়ায় সর্বোচ্চ নৈতিকতা ও ভাল কাজের মাধ্যমেই যেনো তার জীবন অতিবাহিত করতে পারে। কেউ যেনো দুনিয়ার মোহে পড়ে অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার, জুলুমের মতো অনৈতিক না হয়। পৃথিবীতে কেবল নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য যেনো বিনা দ্বিধায় কেউ পাপ না করে ফেলে এটাই বুঝাবার চেষ্টা করেছি।

সম্পূর্ণ পড়ুন...

Saturday, June 11, 2022

শিক্ষা বনাম সফলতা

 

জ্ঞান অর্জন বা পড়াশোনা কেনো করবেন?

(৫ম পর্ব)

শিক্ষা বনাম সফলতা 

মোঃ অলিউল্লাহ্

জাগতিক পৃথিবীতে যেসমস্ত সার্বজনীন বিষয় সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করা হয় তাই শিক্ষা। শিক্ষার মূল কাজ হলো সকল প্রকার সমস্যা সমাধান করা। যেখানে শিক্ষার মানেই হলো সমস্যা চিহ্নিত করে সুষ্ঠু সমাধান করা, সেখানে সফলতা নামক একটা আপেক্ষিক ব্যাপারকে তার প্রতিবন্ধকরূপে দেখাতে চান কিছু ভ্রান্ত ধারণার বাহক। শিক্ষার মৌলিক ধারণা হলো উপায়।  তেমনি সফলতা তখনই আসে যখন সফলতা পাওয়ার জন্য উপায় বের হয়। আর যেকোন প্রকার সফলতা শিক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। শিক্ষা ছাড়া সফলতাকে ভাবা অসম্ভব। 

অন্যদিকে সফলতা বিষয়টা কেবল একধরনের মানসিক প্রশান্তি। সফল হতে সবাই চায়; এমন একজনও খুঁজে পাওয়া যাবেনা যে জীবনে ব্যর্থ হতে চায়। আর তাই সফলতাকে মনিষীরা বলেছেন আপেক্ষিক। যার অর্থ হলো, এটি যেকোন উপায়েই হতে পারে। কথার কথা, একজন ব্যক্তি খুবই সাধারণ ; তার কোন বিত্ত বৈভব নেই, সে লোকের চোখে এতটা সমাদৃত না। সে খুব ধনী ও না, আবার সে জনপ্রিয়ও না। কিন্তু স্বাভাবিক জীবনযাপনে সে খুব বেশী সমস্যাগ্রস্থ, যেকোনভাবে তার জীবন কেটে যাচ্ছে। আর এই সাধারণ জীবনে তার অতৃপ্তি নেই, সে মনে করে আমার খুব বেশী কিছু না থাকলেও আমি অসুখী নই, আমার যা আছে তাই নিয়ে আমি ভাল আছি। এই যে তার জীবনে সে অতি অল্পতেই সন্তুষ্ট এটাই তার কাছে সফলতা। 

আবার অনেকে দাবী করে জীবনে অগাধ সম্পদ ও অর্থের মালিক হওয়াই সফলতা। কিন্তু ভালভাবে খোঁজখবর নিলে দেখা যাবে তার এত সম্পদ থাকা সত্ত্বেও সে পুরোপুরি সুখি না।
সম্পূর্ণ পড়ুন...

Monday, July 19, 2021

অর্থ যখন অনর্থ || মোঃ অলিউল্লাহ

সকল প্রশংসা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের। তাঁহার নামেই শুরু করছি। আমি তৌসিফ। আমরা তিন ভাই-বোন, অর্থাৎ দুই ভাই এক বোন। আমি মেঝো। আমার বড় ভাই আমার থেকে দুই বছরের বড় হলেও আমার বোন সুবর্ণা আমার থেকে সাত বছরের ছোট। আমার বাবা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। ছোট বড় কয়েকটা প্রতিষ্ঠানের মালিক তিনি। ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে মিলিয়ে আমাদের আটটা বাড়ি আছে। গাড়িও আছে চারটা। আশ্চর্য হলেও সত্যি আমি কোন গাড়ি ব্যবহার করিনা; এমনকি আটটি বাড়ির মধ্যে ছয়টি বাড়িতেই আমার কখনো যাওয়া হয়নি। স্থায়ীভাবে আমরা সবাই একই বাড়িতে বসবাস করছি। আমার বড় ভাই বাবার মতোই বিচক্ষণ আর উচ্চাবিলাসী। পড়াশোনায় খুব সুবিধা করতে না পারলেও তার বিচক্ষণতার ছাপ পাওয়া যায়, বাবার সাথে ব্যবসায় ক্ষেত্রে। কোন রকম ইন্টারমিডিয়েট সম্পন্ন করেই সে বাবার সাথে ব্যবসায়ের হাল ধরেছে। তার তুলনায় আমি পরিবারের সবার কাছে অকম্মার ঢেকি।

কারণ বাবার কোথায় কোন ব্যবসায় আছে, কোন কিছুই আমি জানি না। আমার বোনটিও অনেকটা বড় ভাইয়ের মতোই বিচক্ষণ এবং বিলাসী। বড় লোকের মেয়ে হিসেবে বিলাসী হওয়াটা তাকে মানায়। আমি তার এবং পরিবারের সবারই চক্ষুশূল। সকলের অপ্রিয় হওয়ার কারনটা পরে বলছি। আমার আরোও একটা পরিচয় আছে আমার পরিবারে ‘পাগল’। পরিবারের বাইরেও আত্মীয় মহলে এই নামের পরিচিতি আছে। আমাকে পাগল বলার কারনটা বলার আগে বলে নেওয়া ভাল যে, গল্পটি মূলত আমার বোন সুবর্ণাকে নিয়ে। সে এখন হসপিটালের আইসিওতে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রয়েছে। ডাক্তাররা বলছে বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম, মাথায় তীব্র আঘাতের কারণে অনেক বড় ফ্রেকচার হয়েছে। আমার বোনটির এই দশার জন্য দায়ী আমার বাবা অঢেল টাকা, মায়ের অত্যাধিক আধিক্ষ্যেতা এবং বড় ভাইয়ের পশ্রয়। যদিও এখন দায় সারাভাবে সবাই নিজের কর্ম নিয়ে ব্যস্ত। হসপিটালে কেবল আমিই আছি ওকে দেখার জন্যে।

দীর্ঘদিন ধরে একটা ছেলের সাথে তার রিলেশন ছিলো। মূলত ছেলেটা তার সৌন্দর্যে যতটা না তাকে ভালোবেসেছে, তার টাকাকে বেসেছে বেশি। বিষয়টা সুবর্ণা বুঝতো, কারন শুরু থেকেই বিভিন্ন সময় রৌনক তার কাছ থেকে হিসেব ছাড়া টাকা নিয়েছে কিন্তু তাকে হারানোর ভয়ে আমার বোন কখনো কোন এটেম্পট নেয়নি। সুবর্ণার টাকার প্রতি খুব ফেসিনেশন ছিলো, শৈশব থেকেই সে বিলাসী জীবন-যাপন করেছে। প্রয়োজনের চেয়ে অপ্রয়োজনেই অর্থ ব্যয় করেছে বেশি। তার বেশ কয়েকটা ভিসা ও ক্রেডিট কার্ড রয়েছে। বেশ কিছুদিন ধরে তার অযৌক্তিক অর্থ ব্যয় দেখে আমার মা কিছুটা সাবধান হতে চাইলেন, আর তার ক্রেডিট কার্ডগুলো লুকিয়ে রাখলেন।

ঠিক সেই মুহুর্তে রৌনক নাকি তার কাছে পঞ্চাশ লাখ টাকা চেয়েছিলো। সে জানে রৌনক টাকাটা পেলে আর দেশে থাকবেনা; এমনকি তার প্রতি যে রৌনকের কোন আন্তরিকতা নেই এটা অনেক আগেই বুঝেছে। কিন্তু তার প্রতি দুর্বলতার জন্য তাকে ছাড়তে পারেনি। পরশু দিন সকালে আমার স্ত্রীকে সুবর্ণা কেঁদে কেঁদে বলছিলো, “ভাবি, আমার সব শেষ হয়ে গেলো। রৌনক আর আমাকে চায় না। সে আমাকে ডিচ করেছে। আমার কাছে পঞ্চাশ লাখ টাকা চেয়েছিলো, আমি দিতে রাজি হইনি। তাই সে আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। আমি এখন কী করবো ভাবি?”


সুমি আমার স্ত্রী, তাকে বললো, “তুমি ধৈর্য ধরো। যে তোমাকে ভালোবাসবে সে টাকা নয়, যেকোন মূল্যে তোমাকেই চাইতো। সে তোমাকে চায় না এটা তুমি ভালো করে জানো। শান্ত হও। স্বাভাবিক জীবন-যাপন করো। হয়তো তোমার জন্য ভালোই হয়েছে।”

কিন্তু এতে সে কনভিন্স নয়। সকল বন্ধু-বান্ধবের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। কেউ ফোন দিলে রেসপন্স করেনা। সারাদিন ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমায় আর মাদক সেবন করে। এটা অবশ্য নতুন কিছু নয়। যখনই তার কোন সমস্যা হতো সে এমন করতো।

গতকাল সে মায়ের ঘরে গিয়ে তার সাথে চড়াও হয়। মাকে বলে- “আম্মু আমার কার্ডগুলো দিবে কিনা বলো?”

মা বলল- “কিছুদিন পরে দেবো।”

“আমার এখনই লাগবে। তুমি এখনি আমাকে আমার কার্ডগুলো দিবে।”

ওর দুর্ব্যবহারের মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ায়, মা তার কার্ডগুলো ফেরত দিলো। সে তখন মাকে বললো, “এখন থেকে আমি ধানমন্ডির আটতলা ভবনে থাকবো। আমি এখনই চলে যাবো সব কিছু নিয়ে।”

মা বললো, “কেনো কি হয়েছে তোর? এমন করছিস কেনো?”

“তোমাদের কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই।” 

এই বলে চলে গেলো। শুনেছি ব্যাংকে যত টাকা ছিলো সব টাকা তুলে নিয়ে বাসার সিন্ধুকে রেখেছে। ওর ফোন কল রেকর্ডার অন করা থাকতো। কল রেকর্ড থেকে জানতে পারি, সুশ্মিতা নাতে ওর এক বান্ধবী কল দিয়েছিলো। কল করে যা বলল- “সুবর্ণা চল ঢাকার বাইরে থেকে ঘোরে আসি।”

“নারে, আমি এখন কোথাও যাবোনা।”

সুশ্মিতা- “কেনো?’’

“রৌনক আমাকে ডিচ করেছে। আমার মন খুব খারাপ। এছাড়া আমি বাসা থেকে ধানমন্ডির বাসায় চলে এসেছি। কয়েকদিন যাবৎ কেউ একজন আমার ব্যাংক একাউন্ট হ্যাক করার চেষ্টা করছে। আমার ফোনে বারবার ওটিপি’র এসএমএস আসছে। ওটিপি কন্ফার্ম কনফার্ম করতে পারছেনা, তাই টাকা ট্রান্সফার করতে পারছেনা। কিন্তু আমার মনে হয় একসময় সে একাউন্ট হ্যাকও করে ফেলবে। তাই ব্যাংকের সকল টাকা তুলে সিন্ধুকে এনে রেখে দিয়েছি। এই অবস্থায় আমার ঢাকার বাইরে যাওয়া ঠিক হবেনা। তুই না হয় আমার বাসায় চলে আয়, দু’জন মিলে গল্প করবো।”

সুশ্মিতা- “ঠিক আছে আমি বিকালে আসবো।”

“ঠিক আছে।”

বাসার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে জানতে পারলাম, সুশ্মিতা চারটা বাজে বাসায় এসেছে। প্রথমে কিছুক্ষণ স্বাভাবিক কথা বলতে দেখলাম। এরপর উভয়ে উভয়ের সাথে চড়াও হয়ে কি যেনো বলছিলো। সুবর্ণা অন্য রুমে গেলো সুশ্মিতাকে বসিয়ে। এবার সুশ্মিতা সিন্ধুকের হ্যান্ডেল ধরে টান দিয়ে সিন্ধুুকের দরজা খুলে ফেললো, যদিও এটা সিকিউরলি লক করা ছিলো। সুবর্ণা পাশের রুম থেকে এসে দেখলো, সিন্ধুকটি খোলা এবং কোন টাকা এর ভিতর নেই। হঠাৎ করে রৌনক ভেসে উঠল তাদের মাঝে। তার হাতে ছিলো অনেক বড় ড্রিল মেশিন ও মাথায় হেলমেট। অর্থাৎ সে যেকোন উপায়ে বাসায় প্রবেশ করে সিন্ধুকের পিছন থেকে খুব সতর্কভাবে ড্রিল মেশিন ব্যবহার করে সকল টাকা সরিয়ে ফেলে এবং পরে সুবর্ণাকে জানায় সে কিভাবে সবকিছু করল।


সুবর্ণা তাদের হেন ঘটনায় চড়াও হলে রৌনকের হাতে থাকা ড্রিল মেশিন দিয়ে তার মাথায় আঘাত করে এবং সুবর্ণা রক্তাক্ত হয়ে  মাাটিতে লুটিতে পড়ল।। এরপর ওরা  পালিয়ে  গেলো। সুশ্মিতার ফোন ট্রেস করে জানা যায়, রৌনকের সাথে তার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ছিলো। এছাড়া রৌনক এই বাড়িতে এর আগেও দুইবার এসেছিলো, তা সিসিক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়। যেহেতু রৌনক আগে থেকেই বাসার অবস্থান জানতো, তাই সুশ্মিতার কাছ থেকে টাকার সন্ধান পেয়ে তা সরিয়ে নেওয়ার মাস্টার প্লান করে।  যদিও সব কিছুই প্রকাশ পেয়েছে এবং তাদের দু’জনকেই পুলিশ গ্রেফতার করেছে। কিন্তু মোটের উপরে আমার বোন হসপিটালে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।

এবার আসি মূল গল্পে। আমাকে বাসায় সবাই পাগল বলতো। খুব ছোটবেলা থেকেই আমি নিয়মিত নামাজ, রোজার প্রতি খুব আন্তরিক ছিলাম। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কখনো অর্থ অপচয় করতাম না। সকলর শ্রেণীর মানুষের সাথে মিশতাম এবং সাধারণ মানুষের মতো সারাদিন পড়াশোনার পাশাপাশি অনেক পরিশ্রমের কাজ করতাম। সুযোগ পেলেই মানুষের কাজে সাহায্য করতাম। সবাই আমাকে পছন্দ করতো। উচুশ্রেণীর চেয়ে নিচু শ্রেণীর মানুষের সাথেই আমি বেশি মিশেছি; এমনকি কখনো খুব দামী পোষাক ও পড়িনি। সাধারণ এই জীবনযাপনে আমার বাসার সবাই আমার প্রতি বেশ বিরক্ত হতো। এছাড়া বড় ভাইয়ের মতো আমিও যদি ব্যবসায় মনোযোগী হতাম তাহলে হয়তো আমাদের সম্পদ আরো বেশি হতো, এই ধারণা তাদের। স্কুল পাশের পর থেকেই আমি টিউশনি করে নিজের খরচ চালাতাম। বাবার কাছে খুব কম সময়ই টাকা চেয়েছি। কখনো টাকা দিতে চাইলে আমি নিতাম না, তাই তাদের কাছে আমাকে অস্বাভাবিক মনে হতো। 

যেহেতু আমার পরিবারের লোকজনের ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি অনিহা তাই আমার সবরকমের ইবাদত তাদের কাছে বাড়াবাড়ি মনে হতো। শিক্ষামূলক কোন কথা বললেই আমাকে বলতো আমি পাগল। আমি উন্মাদ। আমি মানসিকভাবে অসুস্থ; এমনকি দু’য়েকবার আামার মা আমাকে মানসিক ডাক্তার দেখাতেও নিয়ে গিয়েছিলেন। যখন রাগ করার মানে বুঝতাম না তখন কেউ আমায় পাগল বললে আমি খুব ক্ষেপে যেতাম। যখন বুঝলাম রেগে গিয়ে নিজের আচরণকে অসংযত ও উগ্র করে আমি বরং ভুল মানসিকতার পরিচয় দিচ্ছি, তখন থেকে রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছি। আমি শিখেছি ধৈর্য্যই মহত্তের লক্ষণ। যাকে আল্লাহ হেদায়াত না দেন, সে আমার কথায় কতটাইবা পরিবর্তন হবে। আর আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তিনি তোমাদের জন্যে দ্বীনের ক্ষেত্রে সে পথই নির্ধারিত করেছেন, যার আদেশ দিয়েছিলেন নূহকে, যা আমি প্রত্যাদেশ করেছি আপনার প্রতি এবং যার আদেশ দিয়েছিলাম ইব্রাহিম, মূসা ও ঈসাকে এই মর্মে যে, তোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত কর এবং তাতে অনৈক্য সৃষ্টি করো না। আপনি মুশরেকদেরকে যে বিষয়ের প্রতি আমন্ত্রণ জানান, তা তাদের কাছে দুঃসাধ্য বলে মনে হয়। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা মনোনীত করেন এবং যে তাঁর অভিমুখী হয়, তাকে পথ প্রদর্শন করেন।”-সুরা-আশ-শূরা, আয়াত-১৩

এবং আরোও বলেন, “আর যাকে আল্লাহ্‌ হেদায়াত করেন তার জন্য কোন পথভ্রষ্টকারী নেই; আল্লাহ কি পরাক্রমশালী, প্রতিশোধ গ্ৰহণকারী নন?” - সুরা- আয-যুমার, আয়াত-৩৭

আমার পরিবারের প্রতিটি মানুষ অর্থ, আভিজাত্য আর আধুনিক পৃথিবীর সাথে স্রোতে গা-ভাসিয়ে চলে। দুনিয়াটা তাদের কাছে কৃত্রিম স্বর্গ। কিন্তু তারা জানতে কিংবা বুঝতে চায় না, একদিন সন্ধ্যা হবে, আলো ফুরাবে, পাখিদের কোলাহোল স্তব্দ হবে, অন্ধকারে আবৃত হবে পৃথিবী। তখন তাকে দাড়াতে হবে চরম বাস্তবতায়। যেদিন নিশ্বাসটা বন্ধ হবে, এরপর থেকেই তাদের দুনিয়ার রংঢং শেষ হয়ে যাবে। শেষ হবে অবৈধ সম্পর্কের ও হারাম জীবিকার।

সুবর্ণা শৈশব থেকেই ছিলো খামখেয়ালি স্বভাবের। বিশেষ করে অপচয়ের ক্ষেত্রে তার জুড়ি নেই। জীবনে অভাব কী জিনিস জানেনি সে। দেখেনি বাহিরের জগতের বাসিন্দাদের। অহংকার, বিলাসীতা, অবাধ মেলামেশা এবং মাদক সবকিছুর মূলেই ছিলো প্রচুর টাকা পয়সার সহজলভ্যতা। ধর্মীয় মূল্যবোধ, ইসলামের অনুশাসন কখনোই পায় নি। সকলের বাড়তি আদর এবং শাসনের অভাবে যারপরনাই চলাফেরা করতো সে। অন্য সকলের মতো সে আমাকে পছন্দ করতো না আমি ইবাদত করি বলে। তার কাছে আল্লাহর উপাসনা করা পাগলামি ছাড়া কিছু না। মৃত্যুর পরে আখেরাতে নেই কোন বিশ্বাস। যদিও আমার পরিবারের অন্য সদস্যরা ওকেশনাল ধার্মিক; মানের ঈদ উদযাপন এবং লোক দেখানো ধর্ম পালন।

আজ সুবর্ণার এমন অবস্থার জন্য দায়ী আমার বাবা-মা ও বড় ভাই। ছোট শিশুর হাতে যেখানে খেলনা তুলে দেওয়ার কথা, তাকে দেওয়া হয়েছিল টাকা। সারাদিন টাকা নিয়ে খেলতো। দিনদিন যখন বড় হচ্ছিল তখনো তাকে টাকার সঠিক ব্যয় সম্পর্কে শিক্ষা দেয়নি, বরং দামি দামি ড্রেস, স্কুটি, গাড়ি, মোবাইল, ট্যাব ও ল্যাপটপ হাতে তুলে দিয়েছে শৈশবেই। যা পেয়ে সে মেতে থাকতো হৈ চৈ বিনোদন, সিনেমা, আড্ডাবাজি, ভিডিও গেমস এবং রোটিন বিহীন অনিয়মের জীবন। যেখানে অর্থের অভাবে মানুষ তার সামান্য শখ পূরণ করতে পারেনা, সেখানে অর্থ তার জীবনকে নরকে পরিণত করেছে।







সম্পূর্ণ পড়ুন...

Sunday, July 18, 2021

শেষ চিরকুট || মোঃ অলিউল্লাহ্

 মুখে না বললেও মনের ভিতরের মানুষটা কেন জানি চাইছিলো আমার অতি আদরে,যত্নে লালিত-পালিত সন্তানরা একবার আসুক; অন্তত জানালার বাইরে থেকে তাকিয়ে দেখে যাক আমার যাবার মুহুর্তটা। জানি কেউ আসবেনা, তবুও বিষণ আর্তনাদ নিয়ে তাদের এক মুহুর্তের জন্য দেখতে লোভাতুর চোখ দু’টো জানালা দিয়ে বারবার বাইরের দিকে তাকায়। এতোদিনে এই শূন্য ঘরটিতে একা থেকেও কষ্টের যন্ত্রণা, বুকের ভিতরের ব্যথা, শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম হলেও চোখের পানিগুলোকে বেড়িয়ে আসতে দেয়নি। যে মানুষটার সাথে পয়ত্রিশ বছর সংসার করেছি সেও পাশে নেই, প্রথম পরিচয়ের দিন থেকে শুরু করে শেষ দেখা অবদি সকল স্মৃতিগুলো চোখের সামনে যখন ভেসে আসছে; তখন অশ্রুগুলোকে ঝরে যেতে আর কিভাবে বাধা দেই। অতি আপনজন কেউ থাকলে; যে এই করোনার কোনো তোয়াক্কা না করেই  সকল বাধা উপেক্ষা করে আমার কাছে চলে আসতো, আদর করে কপালে চুমো খেতো আর সেবা দিয়ে সুস্থ্য করতে চাইতো, সেই মা আমায় ছেড়ে চলে গিয়েছে এক যুগ হয়ে গেলো। আজ আমার ষাট, কিছুদিন আগে-পরে তো চলে যেতেই হতো, ওইসব করোনা টরোনা কিছু না; শুধু চলে যাবার বাহানা। জীবনের রূপ দেখা হলো পুরোটাই, সকল খ্যাতি, ব্যাংকের সকল টাকা আর সকল সম্পত্তি ইতিমধ্যেই তোমাদের কাছে পৌছে দেবার ব্যবস্থা করে গেলাম। ভেবোনা তোমরা কেউ দেখতে আসোনি বলে আমি কষ্ট পেয়েছি, এমন পরিস্থিতিই হয়তো আমার জীবনের শেষ ফলাফল ছিলো। মনে হচ্ছে আর খুব বেশি সময় নেই, পৃথিবীটা ঘুরছে চোখের সামনে, শরীরটা কেমন নিথর বরফ খন্ডের ন্যায় পড়ে রয়েছে বিছানার উপর। মনটা এখনো বেঁচে থাকলেও মনের জোরটা এতক্ষণে মরে গেছে। যেই খাতা কলম দিয়ে কত কিছুই না লিখেছি সারাজীবন; আজ সেই প্রিয় কলমটাও বিট্রে করছে, আর লিখতে দিচ্ছে না কিছু। শরীরটার সাথে একরকম যুদ্ধ করেই এতটুকুন লিখতে পেরেছি। ভালো থাকুক পৃথিবীর সব মানুষ। বিদায়!!!

সম্পূর্ণ পড়ুন...

Thursday, July 15, 2021

জীবনের বাঁক

 জীবনের বাঁক

মোঃ অলিউল্লাহ্

কত দিন পর একটা সুন্দর সকাল দেখছো তাই না? মনে পড়ে ঠিক কত দিন হয়েছে ভোরে ওঠে ফজরের নামাজ পড়ে নির্জন পিচঢালা পথে হাটতে বের হওনি? বহুদিন আগে একবার তুমি আমি আমাদের গ্রামের পিচঢালা পথে এমন কাকডাকা ভোরে হাটতে বের হয়ে ছিলাম মনে আছে?

“আছে না আবার। অবশ্যই মনে আছে। তখন আমি বাড়ির নতুন বউ। আমি বাড়ির বাইরে যাবো না বলার পরও তোমার চাপাচাপিতে বোরকা পরে হাটতে বের হয়ে ছিলাম। রাস্তার দুই পাশে তাল গাছের সারি, মাঠ জুড়ে ফসল। স্তব্ধ সকালে নির্জনতায় আমরা দুজন ভোরের হাওয়ায় মাতোয়ারা হয়ে গিয়েছিলাম।”

 তোমার মুখটা আজ অন্যদিনের চাইতে প্রাণবন্ত লাগছে, মনে হচ্ছে লাবণ্যময়ী একটা মায়াবী বদন। 

অর্পিতা- হয়েছে, হয়েছে। এই সকাল বেলায় আমার প্রশংসা করে মন প্রফুল্ল করতে হবে না। আমি এমনিতেই খুশি।

আবিদ হাসান - আমি সেটাই বলছিলাম, কোন প্রশংসা না করলেও আজ তোমায় অন্যরকম দেখাচ্ছে। কিন্তু বললে নাতো?

অর্পিতা- কী বলবো?

আবিদ হাসান - এইযে তোমায় প্রশ্ন করলাম, কতদিন পর এমন একটা সুন্দর সকাল দেখছো?

অর্পিতা- মনে নেই। আর ভাবতেও ইচ্ছে করছেনা। এখন শুধু ইচ্ছে করছে, এই মুগ্ধ আবহাওয়ায় মিশে গিয়ে স্নিগ্ধ-সুভাষিত ফুলের ঘ্রাণ টেনে নেই নাক দিয়ে। পাখিদের কিচিরমিচিরে কান পেতে রাখি অনেকটা সময়, শুনতে চাই ও বুঝতে চাই ওরা কি বলা-বলি করছে। কীসে এত আনন্দ ওদের? ঠিক কী এমন আনন্দে ওরা প্রতিভোরে জেগে ওঠে আর মেতে ওঠে কিচিরমিচিরে? ঐ নদীর মাঝখান থেকে ছুটে আসা শীতল হাওয়াটা কেবল আমার মুখে এসে পড়েনা; আমার প্রশ্বাসকে থামিয়ে দিয়ে নিশ্বাসের সাথে দেহে প্রবেশ করে সমস্ত শরীরে একটা অলৌকিক অনুভূতির শিহরণ জাগায়। তুমিই বলো এমন পরিবেশে কী অন্য কিছু ভাবা যায়?

আবিদ হাসান - আমি কী জন্য প্রশ্ন করেছি, তা তুমি ভালো করেই বুঝে গেছো। তাই আমায় এড়িয়ে যাচ্ছো। আসলে প্রতিদিনই ভাবি বিষয়টা নিয়ে তোমার সাথে কথা বলি। কথা বলা উচিৎ। দেখো, জীবনটা কি? কেন আমরা দুনিয়াতে এলাম? জীবন ফুরিয়ে গেলে আমরা কোথায় যাবো? কী হবে আমাদের সাথে, সেটা কমবেশি আমরা সবাই জানি।

অর্পিতা- এই সাজ সকালে এসব নিয়ে কথা না বললে হয় না? কত সুন্দর একটা সকাল বলো। এই দেখো কতগুলো বকুল ফুল পরে আছে, আমাকে কিছু কুড়িয়ে দাও না। বাসায় গিয়ে মালা গাঁথবো।

আবিদ হাসান -  তুমি আর সিরিয়াস হবে না (মুচকি হেসে)। এই নাও তোমার বকুল ফুল। গাছের তাজা ফুল।

অর্পিতা- তুমি গাছ থেকে কেনো ছিড়তে গেলে। গাছের ফুল গাছেই সুন্দর।

আবিদ হাসান -আরে নাহ, ছিড়ি নি। ডাল ধরে ঝাকি দিয়েছি, আর অনেকগুলো ফুল ঝরে পড়লো। এমনিতেই ঝরে যেতো রোধ ওঠলে। চলো নদীর ঘাটে গিয়ে বসি। (হাটতে, হাটতে) একটা মজার ব্যাপার কী জানো, ঢাকা আসার পর আমি যতবারই বাসা পরিবর্তন করেছি, প্রতিটা জায়গাতেই একটা অসম্ভব সুন্দর আকর্ষণীয় জায়গা খুঁজে পেয়েছি; যেখানে আমি প্রায় প্রতিদিন গিয়ে বসতাম, অবসর সময় কাটাতাম, মন খারাপ হলেই চুপচাপ একাকী বসে ভাবনার জগতে হারিয়ে যেতাম। এখানে আসার পরও এই গোদারাঘাট ও নদীর পাড়টা আমার খুব ভাল লাগে। বিশেষকরে এই সকালবেলাটা। কারণ কিছুক্ষণ পর থেকেই এখানে হাট বসবে, প্রচুর লোকসমাগম হবে। তখন আর চাইলেও এই নির্জনতা উপভোগ করা যাবেনা। 

অর্পিতা- ঢাকা আর কোথায় কোথায় এমন জায়গা ছিল, যেখানে তুমি সময় কাটাতে? আমায় নিয়ে যাবে সেই জায়গা গুলোতে? আমার বিশ্বাস এই জায়গাটির মতো, অন্য জায়গাগুলোও মনোমুগ্ধকর হবে। বাই দ্য ওয়ে, তুমি কিন্তু আমায় সেই বিয়ের পর থেকেই, আশা দিয়ে যাচ্ছো কক্সবাজার নিয়ে যাবে, কিন্তু নিয়ে তো যাচ্ছো না। সুযোগ পেলেই ওখানকার এটা সুন্দর, ওইটা সুন্দর বলে আমায় লোভ দেখাও। নিজে তো বিয়ের আগেই গিয়ে ঘুরে ফিরে সব শেষ করে ফেলেছো।

আবিদ হাসান - হা, হা। কী যে বল, ঘুরাফেরার কী শেষ আছে? আরো কত বাকি। নিয়ে যাবো ইনশা আল্লাহ। ঢাকায় একটা জায়গার নাম ছিল বাসাবো বাগানবাড়ি। সেখান থেকে কিছুটা দূরেই একটা জায়গা ছিলো কালিবাড়ি মন্দির। বিশালাকারের একটি দিঘি ছিলো এবং চারিপাশে বিশাল বিশাল বটগাছ ও অন্যান্য গাছ ছিল। বসে সময় কাটানোর জন্য বেস্ট টাইম ছিল ভোর সকালে ও বিকাল বেলায়। আরেকটা জায়গা আমার খুব প্রিয় ছিল। বালুঘাট, ক্যান্টনমেন্ট এলাকার ভিতরে একটা জায়গা ছিল লাল দিঘির পাড় নামে। বিকেল বেলা টিউশনি শেষ করে সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়টা কাটাতাম সেখানে। ভীষণ ভালো লাগতো। সবাই যেতে পারতোনা সেখানে, সিভিলরা ঢুকতে পারতোনা। আমার বিশেষ পাশ ছিলো। আরোও অনেক সুন্দর জায়গা ছিল, যেখানে আমি সময় কাটিয়েছি। এখন আর আগের মত সেসব জায়গার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আছে কিনা জানা নেই। শুন, একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করবো, উত্তর দিবে?

অর্পিতা- আমি জানি যত গল্পই করিনা কেন, তোমার মাথার ভিতর যেই কথাটা ঘুরছে সেটা না বলা অবদি তোমার শান্তি নেই। আচ্ছা বলোতো জীবনের কোন সময়টা সব থেকে বেশি আনন্দের? মানে শৈশবকাল, কৈশোরকাল ও শেষ বয়সে। -(গুদারাঘাটে বেঞ্চে বসে।)

আবিদ হাসান - বিষয়টা আপেক্ষিক ও  কিছুটা মনস্তাত্ত্বিক।

অর্পিতা- কেমন? বুঝিয়ে বলোতো।

আবিদ হাসান - যেমন ধরো অধিকাংশ মানুষই উত্তর দিবে, সব থেকে আনন্দের সময় হলো শৈশবকাল। কারন ওই সময় জীবন নিয়ে কোন চিন্তা-ভাবনা, পিছুটান, ক্যারিয়ার কোন কিছু নিয়েই ভাবতে হয় না। মনের ডানা মেলে উড়ে বেড়ানো যায়, যা সারাজীবন স্মৃতির পাতায় পঞ্জীভূত থাকে। সব থেকে বড় ব্যাপার হলো কোন দায়িত্বই পালন করতে হয় না। কিন্তু জীবনের যোগ-বিয়োগের হিসাবে এই শৈশবের কোন মূল্যই নাই। তবে কৈশোরকালকে অনেকেই বলে জীবনের বেস্ট টাইম। এই কথাটাও আপেক্ষিক। যেমন কেউ বলল জীবনে সফল হওয়ার জন্য কৈশোরই শ্রেষ্ঠ সময়। এখন প্রশ্ন হলো- সফলতা কী? হাজারটা উত্তর আসবে, যার সুনির্ধারিত কোন উত্তর নেই। শেষ বয়সে মানুষ মূল্যহীন হয়ে যায়। গুরুত্ব হারায় সাথে হারায় সুদীর্ঘকালে গড়ে তোলা স্ট্রং পারসোনালিটিও। যে ব্যক্তি হিসাবে কম গ্রাহ্য তার ব্যক্তিত্ব আর কতটা। আবার অনেকে ডিফারেন্টও হয়। অনেকের শৈশব, কৈশোরের মতো শেষ বয়সটাও সমানতালে সুন্দর হয়ে থাকে। কিন্তু জীবনের শ্রেষ্ঠত্ব তখনই প্রকাশ পায়, যখন অনন্তকালের জীবনের বুনিয়াদ তৈরি করে নেওয়া যায়। জীবনের যে অংশে সত্যিকারের দায়িত্ব পালন করে, তার সঠিক ফলাফল লাভের যোগ্য হয়, সেই সময়টিই শ্রেষ্ঠ সময়।

আমি বলবো আমার জীবনের আসল সময় হলো একটা টার্নিং পয়েন্ট বা আমুল পরিবর্তনের সময়। এই সময়ে আমি চিনেছি নিজেকে অনেকটা। আমি জেনেছি এই দুনিয়ার পরেও আরো একটা জগৎ আছে। আমি উপলব্ধি করেছি এই পৃথিবী নেহাত সৃষ্টি করা হয়নি এবং পৃথিবীর সকল প্রাণীকেও অহেতুক সৃষ্টি করা হয়নি। সবকিছুর পিছনে একটা মোটিভ রয়েছে। আমার সব থেকে বড় যে পরিবর্তন, তা হলো আমার দৃষ্টিভঙ্গি; আমি জানতে শুরু করলাম প্রকৃত মানুষ কেমন আর জানলাম আমার আসল পরিচয় আমি মুসলমান। আর যখন জানলাম, আমি মুসলমান, তখন আমার দায়িত্ব বেড়ে গেলো। সেই দায়িত্ব আমাকে বলতে চাইলো, ‘You should do something different, Not like others; who doesn't care about after death. It does matter for me, how I treat my time and what will happen to me after ending the time’.

তুমি কি জানতে চাও আমার সে অবস্থার কথা?

অর্পিতা- হ্যা, বলো।

আবিদ হাসান - যখন আমি ভাসছিলাম একটা মাঝিহীন নৌকায়? গন্তব্য না জানা এক যাত্রায় আমি ভেসে বেড়াচ্ছিলাম। আমি ছিলাম এক উন্মাদ। আমি নিজের ক্যারিয়ার, প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির ঘূর্ণিতে চক্রাকারে ঘুরছিলাম। তখন কেউ একজন অথবা কোন এক দৈব ধমকা হাওয়া বেহেস্তের লোভ দেখিয়ে আমার দৃষ্টিকে অবনত করল, আমার উচ্চাভিলাষ গুলো একই রেখে শুধু ধরণটা দিলো পাল্টে অর্থাৎ দুনিয়ার অট্রালিকা, পাহারসম সম্পদ আভিজাত্য আর আত্মসম্ভ্রমের মিছে অহমিকার কথা গেলাম ভুলে। কী জানি হলো আমার মাথাটায়, সবকিছু কেমন ঘোলাটে লাগছিল, তারপর স্বচ্ছ চোখ দিয়ে আকাশটাকে দেখতে লাগলাম, কে এই আকাশে মালিক? কে এই সুবিন্নস্ত জমিনের মালিক? পৃথিবীর সকল প্রাণের পালনকর্তা কে? কোন সে ড্রাইভার যে সমস্ত বিশ্ব-ভ্রমান্ডকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন? কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন তিনি? কেন নিয়ে যাচ্ছেন?

অর্পিতা- সত্যি বলতে কী যখনই জীবনের মানে খুঁজতে চেষ্টা করি, মৃত্যু নিয়ে ভাবি এবং পরকালের কথা কল্পনা করি, তখনই আল্লাহর প্রতি অনেক ভয় জাগে। ভালো কাজ করতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে সামান্য হারামও যেন আমায় স্পর্শ না করে। কিন্তু পরক্ষণেই শয়তানের প্রলোভনে আটকে যাই। এক ওয়াক্ত/ দুই ওয়াক্ত নামাজ ছাড়তে ছাড়তে একটা সময় দীর্ঘ গ্যাপ হয়ে যায়। এমনটা কেন হয় জানিনা। কিন্তু তুমি যখনই আমায় অনুপ্রাণিত করো, আমি নতুন উদ্যম খোঁজে পাই। আবার নতুন করে শুরু করি।

আবিদ হাসান- মুসলমানের প্রধান শত্রু শয়তান। সে চাইবেই আমাদের ভুল পথে নিয়ে যেতে। কিন্তু আমাদের আসল চ্যালেঞ্জ হলো শয়তানের ধোকায় না পড়ে, বরং শয়তানকে ধোকা দেওয়া। আমাদের ঈমান খুব মজবুত নয়, তাই খুব সহজেই আমরা হেদায়াতের পথ হতে সরে যাই।

অর্পিতা- Exactly, মাঝে মাঝে মনে হয় আসলেই কি মৃত্যুর পর আখেরাত আছে? জান্নাত-জাহান্নাম আছে? নাকি নাই। লক্ষ-কোটি অমুসলিমরা সবাই কি জাহান্নামে যাবে? তারা সবাই কি ভুল? এমন সব প্রশ্ন মাথায় ঘোরপাক খায়।

আবিদ হাসান- সেজন্য ঈমানকে আগে মজবুত করতে হবে। একটা বহুতল ভবনের ভিত্তি যদি মজবুত না হয়, তাহলে তা অচিরেই দশে পরে যাবে। তেমনি মুসলমানের ঈমান যদি মজবুত না হয়, তাহলে সে প্রকৃত মুসলমান থাকবেনা। তোমার আশপাশে হাজারো মুসলমান দেখতে পাবে- কেউ নামধারী অর্থাৎ মুসলমান বাবা-মায়ের ঘরে জন্ম নিয়েছে বলে নিজেকে মুসলমান পরিচয় দেয়। কেউ আবার বছরে বা সপ্তাহে দু’য়েকবার নামাজ পরে আর ইসলামের অন্যসব বিষয় তোয়াক্কাই করেনা। কেউ কেউ আছেন নিয়মিত নামাজ, রোযাসহ ইসলামের সকল রোকনই সম্পন্ন করেন, কিন্তু তা যথাযথ ভাবে করেন না। আবার আরেক দল আছেন যারা খুবই পুঙ্খানোপুঙ্খভাবে ইসলামের প্রতিটা বিষয় নিয়ে গবেষণা করেন, বিশ্লেষণ করেন, জ্ঞানার্জন করে সঠিক বা উত্তম বিষয়টি গ্রহণ করেন আর সেই অনুরূপ আমল করার চেষ্টা করেন। যারা কালে-ভদ্রে ধর্মপালন করেন, তারা শয়তানের হাতের পুতুল। মাঝে মাঝে শয়তান অবসরে গেলে তাদের ভালো কাজ করতে মন চায়, এছাড়া যত হারাম কাজই করুক না কেন, তাদের বিবেক তখন ঘুমিয়ে থাকে।

আমাদের জীবনের দীর্ঘ একটা সময় পার হয়ে যায় কেবল দুনিয়া নামক ব্যাপারটা মাথায় ঘুরাফেরার মধ্য দিয়ে। যে বিদ্যা অর্জন করি সকল কিছু অন্য নয়নে দেখতে পাবো বলে, সেই বিদ্যান চোখ তো সাধারণ চোখের মতই দেখে সবকিছু। অর্থোপার্জন তো লেখাপড়া না করলেও করা যায়। সামান্য যেকোন কাজ শিখে নিয়েই বছরের পর বছর কাজ করে শ্রম দিয়ে টাকা উপার্জন করা যায়। তাহলে এত সময় দিয়ে শিক্ষালাভ করার দরকার কি? সতেরো-আঠারো বছর বিদ্যার্জন করে আমিও যদি সেই অনৈতিকভাবে অর্থ উপার্জন করি, মিথ্যে বলি, ঘোষ খাই, সুদ খাই, পরের হক নষ্ট করি, আমানতের খেয়ানত করি, গুরুজনকে অসম্মান করি, অধ:স্তনদের অবজ্ঞা করি, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি বেপরোয়া আচরণ করি, লোলোপ দৃষ্টি দিয়ে কাউকে স্ক্যান করে নেই এক মুহুর্তেই এবং সেই নেশার ঘোরে রাত্রি যাপন করে দেহ-মনের ক্রিড়ায় লড়াই করি, তাহলে এতো বছরের বিদ্যা থেকে কি গ্রহণ করলাম?

শৈশবের আদর্শলিপির আদর্শ আমাদের মাঝে কোথায়? আমরা কোথায় রক্ষা করলাম, আত্মীয়তার বন্ধন? কোথায় খোঁজ নিলাম প্রতিবেশীর? কোথায় কারো বিপদে এগিয়ে গেলাম? কবে অনাহারীকে আহার দিলাম? কবে অসুস্থকে সেবা করলাম? এসবইতো আমরা বইয়ে পড়েছি, কিন্তু বইয়ের পড়া গুলো আমাদের তো কিছুই দিলনা।

তাই অন্য নয়নে দেখা হলোনা সেই বিদ্যান নয়নের। 

তবে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,

“ ৩৮. এবং দুনিয়ার জীবনকে বেশী ভালো মনে করে বেছে নিয়েছিল,

   ৩৯. জাহান্নামই হবে তার ঠিকানা৷

   ৪০. আর যে ব্যক্তি নিজের রবের সামনে এসে দাঁড়াবার ব্যাপারে ভীত ছিল এবং নফসকে খারাপ কামনা থেকে বিরত  রেখেছিল 

   ৪১.তার ঠিকানা হবে জান্নাত ৷

   ৪৬) যেদিন এরা তা দেখে নেবে সেদিন এর অনুভব করবে যেন ( এরা দুনিয়ায় অথবা মৃত অবস্থায় ) একদিন বিকালে বা সকালে অবস্থান করছে মাত্র ৷” 

                                                                    ------- সুরা- আন নাযিয়াত, আয়াত-৩৮-৪১ এবং ৪৬


যদি একান্তই আমরা শিক্ষার মর্যাদা ও গুণাগুণ নিজের মধ্যে ধারণ করতে পারতাম এবং এক ভিন্ন ব্যক্তিত্বের অধিকারী হতে পারতাম, তাহলে সেই বইয়ের কথাগুলো আবার মনে করতাম। আল্লাহর বাণীগুলোকে সত্য বলে বিশ্বাস করতাম। দুনিয়ার ক্ষণিকের সময়টাকে বেশী ভালো না ভেবে আখেরাতের কথা ভাবতে শুরু করতাম। যে মেধা আমায় একজন ভাল ছাত্রে পরিণত করেছে, আমায় একজন  ভালো কর্মজীবী করেছে, সেই মেধার সঠিক প্রয়োগে যদি অনন্তকাল থাকার জায়গাটা বাছাই করতে না পারি অর্থাৎ এখনকার এই মৃদুমুগ্ধ সকালের চাইতে লক্ষ্য-কোটিগুণ উত্তম জায়গাটা না বাছাই করে , দুনিয়ায় উৎকৃষ্ট ভেবে পরকালের নিকৃষ্ট জায়গায় আশ্রয় পাই, তাহলে আমরা আমাদের মেধার সঠিক প্রয়োগ ঘটাতে পারলাম না। আমাদের বিদ্যা বা মেধা ও বিবেকবোধ দুইয়ে মিলে যদি পরকালের শ্রেষ্ঠ আশ্রয়স্থল না বাছাই করতে পারি, তাহলে সেই বিদ্যা পরিত্যাজ্য ছাড়া কিছুই নয়। 

 

 আমাদের প্রত্যেকের জীবনে একটা টার্নিং পয়েন্ট থাকা উচিৎ। আর সেই টার্নিং পয়েন্ট হবে জীবন বদলানোর মতো উদ্যোগ। সঠিক সময়ে আমাদের রবের ডাকে সারা না দিলে, বিশ্ব নবীর পথ অনুসরণ না করলে আমাদের ভবিষ্যত অন্ধকার। সামান্য জীবনের ক্যারিয়ার গড়তে আমরা ১৫-২০ বছরের প্রস্তুতি নেই। আর যেই স্থানে অনন্তকালের আবাস্থল সেই স্থানের জন্যে কী আমাদের দীর্ঘ প্রস্তুতির দরকার নেই?

আমাদের এই পরিবর্তন কেবল আখেরাতের পুঁজিই নয়, বরং দুনিয়াতেও আমরা খোঁজে পাবো চমৎকার এক জীবন। যা জীবনকে কতটা সুখ দিতে পারে, কতটা শ্রেষ্ঠ মনোসত্ত্ব তৈরি করতে পারে, তা কল্পনাই করা যাবেনা।

সারা জীবনে এতো জ্ঞানার্জন, পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা-ই যে বিষয়টিতে আমাদের কনভিন্স করাতে পারলোনা, সেখানে আমাদের বিবেকের নবজাগরন আমাদের কনভিন্স করল। সারাদিনে মহান আল্লাহর সামনে পাঁচবার দাড়াতে পারা। গিবত বা পরনিন্দা করা এটা কেবল পরচর্চা নয়; নিজের ব্যক্তিত্বের সংকটও তৈরি করে। বরং যেকোন মানুষের উপস্থিতিতে যতটা উত্তম আচরণে আর সামনে গুণান্বিত হওয়া যায়, তার পিছনে তেমনই হওয়া উচিৎ, এতে কেবল লোকের মুখেই ভালো হওয়া নয়; নিজের আত্মতৃপ্তির জায়গাটাও হয় সমৃদ্ধ। 

এটা একটা মজার অনুভূতি যে, আমরা সকাল থেকে রাতে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত কোন মানুষের সম্পর্কে সমালোচনা, নিন্দা, কটুকথা, হিংসা বা বাজে মন্তব্য না করেই একটি দিন পার করতে পারলাম। সারাদিন মিথ্যে না বলে একটা দিন কাটাতে পারলাম। সারাদিন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে পারলাম। একটা দিনে আমি অসংখ্যবার আমাদের খালিকের কথা স্মরণ করেছি, তাঁর শোকর গোজার করেছি, তাঁর প্রশংসা করেছি মনে মনে।

আমাদের দ্বারা যদি সারাদিনে কারো কোন ক্ষতি না হয়। কারো অপকার অনিষ্ট না হয়। বিপরীত লিঙ্গের এমন কারো দিকে না তাকানো, যাকে দেখা আমাদের জন্য হারাম; এমনকি একটি দিনে কোন প্রকার হারাম লেনদেন না করা। পারলে মানুষের উপকার করার চেষ্টা করা, অসহায়কে সাহায্য করার চেষ্টা করা আর অসুস্থ্য কেউ থাকলে সেবা করার চেষ্টা করা। আর এই সবই করে আমাদের পালনকর্তার ভয়ে ও তাঁকে সন্তুষ্ট করতে যা কিছু করা হয় সবকিছুর জন্য অন্তরে এক ধরনের প্রশান্তি কাজ করে। সত্যি বলছি, জীবনে এরচেয়ে ভালো অনুভূতি আর কখনো হয়না।

এভাবে একটা মানুষ নিজেকে বদলাতে পারলে, সে নিজেই পার্থক্য বুঝতে পারবে তার অতীত ও বর্তমানের অনুভূতি দ্বারা। যখন সে বেহিসেবি দিন কাটিয়েছিলো, এখনকার হিসেব করা দিনগুলোর তাৎপর্য বুঝতে পারবে। আর তখনি একজন সঠিকভাবে দ্বীনের ভিতরে প্রবেশ করতে পারবে। মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে শোকরিয়া করছি, যে তিনি আমাকে দয়া করেছেন, আমার ঘুমিয়ে থাকা বিবেককে জাগ্রত করেছেন। ‍বিশ্বনবী মোহাম্মদ (সঃ) এর দেখানো পথে চলবার মতো তৌফিক দিয়েছেন। আল্লাহ যেন, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেইভাবেই আমাদের সকলকে আমল করার তৌফিক দেন, আমিন।

অর্পিতা-  মাশা আল্লাহ্। আল্লাহ মেহেরবান। আলহামদুলিল্লাহ, তুমি একজন মুসলমান হিসাবে দ্বীনের পথে চলার চেষ্টা করছো। আল্লাহ হেফাযত করুন, আমিন।  আমিও চেষ্টা করি নিয়মিত আল্লাহর বিধি-বিধান মেনে চলার, যদিও মাঝে মাঝে অনমনস্ক হয়ে শয়তানের ধোকায় পড়ে সময় নষ্ট করি, বিপথে চলে যাই। কিন্তু তোমাকে পাশে পেয়ে আমার কাজটা অনেক সহজ হয়েছে। একজন ভালো সঙ্গীই পারে খুব সহজে তার সঙ্গিনীকে হেদায়াতের পথে নিয়ে আসতে। একজন খারাপ মানুষ যেভাবে কাউকে প্রভাবিত করতে পারে, তেমনি একজন ভালো মানুষের প্রভাবেও অপরজন ভালো হতে পারে। 

ঠিক বলেছো।

অর্পিতা-আমার ভালো লাগে, যখন তুমি নিয়মিত কোরআন ও হাদিসের বিধান অনুযায়ী নিজেকে পরিচালিত করো এবং আমাকেও সেইভাবে নির্দেশনা দাও। আলহামদুলিল্লাহ।

তুমি দ্বীনের প্রতি খুবই আন্তরিক, মাশা আল্লাহ। আলহামদুলিল্লাহ, আমি তোমাকে আমার স্ত্রী হিসাবে পেয়েছি এবং আমি আশা করছি ভবিষ্যতে আরো ভালোভাবে দ্বীনের পথে চলবে এবং দ্বীনের কাজ করবে, ইনশা আল্লাহ।

অর্পিতা- ইনশা আল্লাহ।
সম্পূর্ণ পড়ুন...

Wednesday, October 21, 2020

মুক্তির পথ || মোঃ অলিউল্লাহ

 স্বপ্ন তো প্রায় প্রতিরাতেই দেখি। কিছু স্বপ্ন থাকে যা ভালো লাগার, আর কিছু স্বপ্ন থাকে যা অপ্রত্যাশিত। স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানার আগ্রহ আমার আছে। কিন্তু কে খুব ভালো ব্যাখা দিতে পারে সেটা জানা নাই। কিন্তু আজ শেষরাতের স্বপ্নটা আমায় এতটাই উদাসীন করে তুলল, খুব কৌতুহলী হলাম এবং সিদ্ধান্ত নিলাম কোন বিজ্ঞ আলেমের কাছে গেলে হয়তো উনি আমায় ভাল একটা ব্যাখা দিতে পারবে। সারাদিন অনেক কিছুই ভেবেছি। কিন্তু ব্যাখ্যা যতটুকু নিজে করতে পেরেছি, সেটা নিজের কল্যাণের কথা চিন্তা করে ইতিবাচকভাবেই করেছি। তথাপি একজন আলেমের সাথে দেখা মিলল। সালাম দিয়ে উনার কাছে কিছুটা সময় চাইলাম। কিছুটা কৌতুহল দেখতে পেলাম উনার চোখে-মুখে।

‘কি বলতে চান? একটু সংক্ষেপে বলবেন। আমার কিছু কাজ আছে।’

কিভাবে বলা শুরু করবো ভাবছি। কিন্তু মনে হচ্ছে আমার বলতে একটু বেশি সময় লাগবে। আমি কি অন্য কোন দিন আসবো?

‘কত সময় লাগতে পারে? ত্রিশ মিনিটে হবে?’

হ্যা আশা করছি এর মধ্যে শেষ করতে পারবো। তবে আরো কিছু সময় লেগে গেলে...।

‘আচ্ছা বলুন। কি বলতে চান।’

আমি আসলে আজ শেষ রাতে একটা স্বপ্ন দেখেছি। স্বপ্নটা নিয়ে সারাদিন ভেবেছি। নিজের মতো দু’য়েকটা ব্যাখাও দাড় করিয়েছি। কিন্তু এতে আমি তৃপ্ত নই। আমি চাইছি, কেউ একজন আরো ভাল কোন ব্যাখ্যা আমায় দিতে পারবে, সেজন্যেই...।

‘দাড়ান দাড়ান। আপনি ভুল করছেন। আমি আসলে স্বপ্নের এতো ভাল ব্যাখ্যা দেওয়ার জ্ঞান রাখিনা। আপনি বরং অন্য কারো সাথে কথা বলতে পারেন।’

তবে আমার মনে হচ্ছে, কথাগুলো শুনে কিছু একটা আমায় বলবেন, যা থেকে আমি শিক্ষা নিতে পারবো।

‘দেখুন আমারও ইচ্ছে হচ্ছে আপনার কথাগুলো শুনি। কিন্তু আপনার কোন কাজে আসবো কিনা জানিনা। আচ্ছা বলুন, কী দেখেছেন স্বপ্নে।’

আমি দেখলাম আমি একটা অচেনা দেশের অচেনা এক শহরে কাজে কাজ করতে গিয়েছি। যেদিন সেখানে পৌছলাম, সেদিনই সেখানে একটা দূর্যোগ শুরু হলো। আগে শহরের বর্ণনা দিয়ে নেই। শহরটা খুবই ছোট একটা দ্বীপ এর মতো। একতলা বিশিষ্ট কিছু বাড়ি ও কিছু টিনের ঘর দেখতে পাচ্ছিলাম। বাড়ি গুলো একটা অন্যটা থেকে দূরবর্তী ছিলো। কিন্তু প্রত্যেকটা বাড়িই আধুনিক স্টাইলে ডেকোরেট করা, অর্থাৎ দেখে মনে হবে অভিজাত বা রুচিশীল মানুষের শখের বাড়ি। কিন্তু শহরে যে খুব ধনী মানুষ আছে এমন নয়। আমার স্বপ্নটার সাথে দু’য়েকটা কাহিনীর মিল আছে। প্রথমত আমি নূহ (আঃ) জীবনী পড়ে যা জানতে পেরেছি তার সাথে কিছুটা মিল আছে। দ্বিতীয়ত আমাদের দেশের একটি চলচ্চিত্রের একটা অংশের সাথে মিল খোঁজে পাই। কিন্তু যেই ব্যাপারটা জন্য আমি কোন আলেমের কাছে স্বপ্নের ব্যাখা চাইছি সেটা খুব আশ্চর্যজনক।

এবার বলছি কি ঘটছিলো সেখানে। কোথা থেকে যেনো পানির ঢল এসে সবকিছু প্লাবিত করে দিচ্ছিল। চারিদিকে কান্নার রোল পড়ে গেলো। অসংখ্য মানুষের চিৎকার যেনো এক মুহুর্তের মধ্যে পানির সাথে মিলিয়ে গেলো। ঘর-বাড়ি, আসবাবপত্র, গৃহপালিত প্রাণীসহ সবকিছু এক মুহূর্তের মধ্যে পানির নীচে তলিয়ে যাচ্ছিল। অনেক দূরে দেখতে পেলাম মসজিদে যে গালিচা বা প্লাস্টিকের যে জায়নামাজ থাকে, সেগুলো ভেসে ভেসে আসছে। অলৌকিকভাবে কিছু মানুষ সেই গালিচার উপর দাড়িয়ে রয়েছে স্থিরভাবে। কিন্তু তারা ডুবে যাচ্ছে না। তারা সবাই নামাজে দাড়ানোর মতো খুবই শৃংখলভাবে লাইনে দাড়িয়ে আছে। গালিচা গুলো সব ভেসে ভেসে একজায়গায় এসে একত্রিত হলো।

‘তখন আপনি কোথায় ছিলেন?’

দুঃখিত আমি আমার অবস্থানের কথা বলতে ভুলে গিয়েছি। আমি অনেকটা দূরে একটা উচুঁ  টিলার উপর দাড়িয়ে দেখতে লাগলাম। দেখলাম তখনো সেই টিলায়  পানি পৌছায়নি। টিলার চূড়ায় একটা টিনের ঘর রয়েছে। ঘরে অনেক পুরাতন আসবাবপত্র। কৃষ্ণবরে্ণর দুইজন ব্যক্তি বিছানায় শুয়ে আছে। বাহিরে কী হচ্ছে সেসব নিয়ে তাদের মধ্যে কোন উদ্বেগ দেখতে পায়নি। তবে ঘরের ভিতর থেকে বেড়িয়ে এলো আমার দুঃসম্পর্কের এক মামা। উনি আমায় বলল- ‘তুমি এই বিপদের মধ্যে এখানে কেন আসছো? আমরাও বিপদের বাইরে না। যেকোন সময় আমাদের বাড়িও ডুবে যেতে পারে।’


আমি ওনাকে অনেক অনুরোধ করলাম এই ঘরে আমাকে আশ্রয় দিতে। উনি প্রথমে ইতস্তত করছিল, পরে বলল- ‘টাকা পয়সা আছে তোমার কাছে?’

আমি বললাম- টাকা পয়সা যা ছিলো এদেশে আসার পথেই খরচ হয়ে গেছে। কিন্তু আমি আপনাদের ঘরের সকল কাজ করে দেবো। দয়া করে আমাকে থাকতে দেন। উনি রাজি হলো। এরপর যা দেখলাম, তা আরো বেশি লোমহর্ষক। দূরের সেই গালিচায় যারা রয়েছে, সেখানে বিভিন্ন বর্ণের মানুষ দেখতে পেলাম। তাদের মধ্যে কয়েকজন অনেকগুলো খাবার নিয়ে প্রত্যেকের কাছে যাচ্ছে, আর বলছে ‘যার যার কাছে টাকা আছে দাও এবং খাবার কিনে খাও।’

দূরে হলেও কী করে যেনো আমি তাদের সকল কথা শুনতে পাচ্ছি। একজন লম্বা ব্যক্তি তার শিশু পুত্রকে কুলে নিয়ে কাঁদছে। হয়তো তার স্বজনরা পানিতে তলিয়ে গেছে।

‘আচ্ছা এখানে আপনাকে একটু থামতে বলছি। আর জানতে চাইছি, আপনি গত কয়েকদিনে আর কোন আজব স্বপ্ন দেখেছেন কিনা?’

হ্যা দেখেছি। দুইদিন আগে যে স্বপ্নটা দেখলাম,  সেটা কিছুটা আশ্চর্যজনক ও অনেকটা ছাড়া ছাড়া স্বপ্ন ছিলো। 

‘সেই স্বপ্নটা কি ছিলো? সংক্ষেপে বলেন।’

কিন্তু আপনার তো দেড়ি হয়ে যাবে।

‘আচ্ছা আপনি সময় নিয়ে ভাববেন না। আমার যে কাজটা ছিলো তা পরে করলেও চলবে।’

ঠিক আছে, তাহলে বলছি। সেই স্বপ্নটায় আমি আমার শৈশবের বয়সে ফিরে গিয়েছি। আমার এক বন্ধুকে নিয়ে হিন্দুদের পূজা দেখতে যাচ্ছিলাম। যাওয়ার পথে অনেক সুন্দর সুন্দর দৃশ্য দেখলাম। আকাশে ঝলমলে বাজি ফুটতে দেখে খুব আনন্দিত ছিলাম আমরা। সেটা ছিল রাতের বেলা। অনেক রাত পর্যন্ত আমরা সেখানে নাচ-গান, সার্কাস, বিভিন্ন মূর্তি দেখেছি। কিন্তু বাড়ি ফেরার সময় আমরা অন্ধকারে পথ ভুলে যাই। তখন আমরা দুজনেই হাটতে হাটতে অনেক ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। আর কোনমতেই হাটতে পারছিলাম না। পা ব্যথা হয়ে এসেছিল। ওহ আমার বন্ধু প্রথমে সেখানে যেতে চাইছিলনা। সে বলছিল হিন্দুদের পূজোয় গেলে, তার মা জানতে পারলে তাকে বকা দিবে। কিন্তু আমি তাকে জোর করে নিয়ে যাই। পথ হারাবার পর ধীরে ধীরে সব কিছু খুব ভৌতিক হতে শুরু করে। চারিপাশে নানা প্রকার শব্দ হচ্ছিল। ভূতুরে কিছু দৃশ্যও দেখে খুব ভয় পেলাম।  একটা সময় দুজন  কাঁদতে কাঁদতে একস্থানে বসে পড়লাম। তখনই ঘুমটা ভেঙ্গে যায়। ফজরের আযান শুনতে পেলাম। তারপর আমি ফজরের নামাজ আদায় করে নেই।

‘আপনি নিয়মিত নামাজ পড়েন?’

চেষ্টা করি। যদিও আগে নিয়মিত ছিলাম না।

‘তারপর কি হলো বলেন।’

আগের স্বপ্নের কথা বলবো? নাকি আজকেরটা?

‘হ্যা আজকে যেটা দেখেছেন, সেটা বলুন।’

তারপর আমি দেখলাম, যারা খাবার নিয়ে যাচ্ছিল তাদের খাবার শেষ হয়ে গেলো। কিন্তু পরবর্তীতে আর খাবারের কোন জোগান নেই। এটা নিয়ে অবশ্য তাদের কোন অনুতাপ নেই। আমি ঘরে ভিতর গেলাম। দুই/তিন এভাবে কেটে গেল। তারপর বাহিরের আর কোন শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম না। দেখতেও পাচ্ছিলাম না কিছু। সবকিছু অদৃশ্য হয়ে গেলো। এরপরেই শুরু হলো প্রচন্ড বৃষ্টি। আমি যেই ঘরে ছিলাম সেই ঘরের লোকজন প্রথমে খাবার না পেয়ে ছটফট করছিল এরপর অদৃশ্য হয়ে গেলো। আমি বিষণ ভয়ার্ত চোখে দেখতে লাগলাম বৃষ্টির কী তান্ডবলীলা। ধীরে ধীরে ঘরের চাল ফোটা হয়ে পানি পড়তে শুরু করলো। বৃষ্টির পানিতে সারা ঘর ভিজে গেল এবং বাহিরে পানির ঢল ভিতরে আসতে শুরু করল।

ভয়ে আর আর্তনাদে আর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়ার মতো অনুভব করলাম। লাফ দিয়ে ঘুম থেকে ওঠলাম। ঘড়িতে সময় তখন ৫:১০ মিনিট। ফজরের নামাজ আদায় করলাম।

‘আপনি বলছিলেন আপনার স্বপ্নের কিছু ব্যাখ্যা করেছেন। কী ব্যাখ্যা করেছেন সেটা শুনতে চাই।’

না তেমন গুরুত্ববহ কিছু না।

‘তবুও বলুন।’

আমার মনে হয়েছে প্রথম স্বপ্নের সাথে দ্বিতীয় স্বপ্নের যোগসূত্র আছে।

‘কীভাবে?’

প্রথমত পূর্বের স্বপ্নের সময় ও পরবর্তী স্বপ্নের সময় খুব কাছাকাছি। প্রথম স্বপ্নে অতিপ্রাকৃত বিষয়বস্তু ছিলো, তেমনি দ্বিতীয় স্বপ্নেও সুপারন্যাচারাল অনেক কিছু দেখলাম। প্রথম স্বপ্নে আমরা যাচ্ছিলা মূর্তিপূজা দেখতে এবং ফেরার পথে আমরা অনেক ভয় পাই ও বিপদে পড়ি। দ্বিতীয় স্বপ্নেও অনেক বিপদ ও ভয় পেয়েছি। 

‘আপনি বলছিলেন কোন এক বিষয়ের কারনে আপনি স্বাভাবিক কোন স্বপ্নের ব্যাখ্যাকারীর কাছে না গিয়ে বিজ্ঞ আলেম খোঁজ করছিলেন। সেটা কেন?’

ও হ্যা, সেটা মূলত স্বপ্ন দেখার সময়ের কারণে এবং বেশ কিছুদিন যাবৎ আমি অলৌকিক ধাচের কিছু স্বপ্ন দেখছি। আমি অনেক ভেবে চিন্তে দেখলাম, যেদিন থেকে আমি আমার জীবনের কিছু বাজে অভ্যাস ও খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে চাইলাম এবং নিজের মধ্যে কিছুটা পরিবর্তন বোধ করলাম, সেদিন থেকেই এই ধরনের স্বপ্ন এমনকি বাস্তবেও অনেক ঘটনা যেগুলো আমার সাথে ঘটছে সেসবের মিল খোঁজে পেলাম। আমি ধরে নিলাম ব্যাপারটা ভালো কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে। 


হতে পারে এটা আমার জীবনের পরিবর্তনের কারণে হেদায়াতের ইঙ্গিত, যাতে করে আমি জীবন যাপনের সকল ব্যাপারে আরো বেশি সাবধান হতে পারি। জীবনকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও মহৎ উদ্দেশ্য দ্বারা চালিয়ে নিতে পারি। আমার প্রথম  স্বপ্ন আমার জন্য অনেকটা সাইরেনের মতো বোধ করছি, আমি নিজেকে ও নিজের আচরণ এবং দৃষ্টি ভঙ্গির পরিবর্তন করার চেষ্টা চালিয়ে গেলেও আমার সামনে অনেক বাধা আসবে। আদৌ আমি আমার সরল পথে কতদূর যেতে পারবো সে বিষয়ে আমি সন্ধিহান। আমার পূর্বেকার যাপিত জীবনের অনেক কিছুই অভ্যাসে পরিণত হওয়ায়, সেসব বাহ্যিক ‍দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ ঘটতে চায়। আমি সেটাকে আরো প্রবলভাবে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পরবর্তী স্বপ্নকে অভিজ্ঞতা হিসাবে গ্রহণ করতে পারি। এটা কেবল আমার স্বপ্নের ইতিবাচক দিক, যা আমার কল্যাণের উদ্দেশ্যে ভেবেছি।


আরেকটা হলো নেতিবাচক দিক। সেটা নিয়ে আমি খুব ভীতসন্ত্রস্ত। যেহেতু দু’টো স্বপ্নই অতিপ্রাকৃত উপাদান নির্ভর এবং দূর্যোগ কবলিত, তাই আমি জীবনে অনেক বড় বিপদ আশঙ্কা করছি। এমনকি সেই বিপদ থেকে উৎরানোর কোনো সুযোগও না থাকতে পারে। 

‘বুঝলাম। আমি জানি আপনি আমার বলার অপেক্ষায় রয়েছেন যে আমি কী বলবো। আমি আসলে বিশেষ কিছু বলতে পারবো না। কিন্তু আপনার ধারণাগুলোতে কিছুটা সহমত পোষণ করবো। তবে আপনাকে বলবো, যে জীবন থেকে আপনি পরিত্রান পেতে চান, সে জীবন পরিহার করুন। আপনার বিশ্বাসের খুটিটা আরো মজবুত করেন। জীবনের আসল উদ্দেশ্য, দুনিয়া ও আখিরাত, জন্ম-মৃত্যু ও দুনিয়ার সকল সৃষ্টির প্রতি অবলোকন করে সৃষ্টিকর্তার নিদর্শনের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করুন। গতানুগতিক বা স্বভাব ধর্ম পালন না করে, কেবল পরকালের কথা হিসাব করে আরো বেশি যত্নবান হয়ে ইবাদত করুন।

মনে রাখবেন, শয়তান প্রতিনিয়ত আপনাকে ধোকা দিতে চাইবে। আপনার নামাজ পড়া, সকল ইবাদত সম্পন্ন করার পরও আপনাকে ইসলামের আদর্শ বহির্ভূত কাজ করার জন্য শয়তান আপনাকে উস্কানি দেবে।’

কী রকম?

‘এই ধরুন আপনি সবই করছেন, কিন্তু মনে মনে ভাবলেন নামাজ তো একটু পরেও পড়া যাবে। সবই তো করছি, দ ‘য়েকটা গান শুনলে বা একটা সিনেমা দেখলে কী এমন পাপ হবে? ইসলামের আদর্শ মতোই তো চলছি, কিন্তু আপনার মনের অজান্তেই কিছু ছোট ছোট মিথ্যে বলছেন, টাকনোর নিচে কাপড় পরিধান করছে। কুরআন ও হাদিসের নিষেধ অমান্য করে খামখেয়ালি জীবন যাপন করছেন। তার মানে আপনি নামাজ রোজা করলেও ধর্মীয় বন্ধনে অটুট নন। আপনার বিশ্বাস এখনো অনেক নড়বড়ে।’

আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু আরোও তাৎপর্যপূর্ণ কিছু বলবেন কী?

‘হ্যা, বলবো। আপনি এখন থেকে সর্বদাই মৃত্যুর কথা স্মরণ করবেন। পরকাল নিয়ে অনেক বেশী ভাববেন। দুনিয়াবী চাহিদার মতো করেই পরকালের চাহিদাকে গুরুত্ব দিন। বেশি বেশি নৈতিক শিক্ষা, সততা ও নিষ্ঠার সাথে জীবন যাপন করার চেষ্টা করুন। নিজে দোযখের আগুন থেকে রক্ষা পাবার চেষ্টা করুন এবং পরিবার পরিজনদের রক্ষা করার চেষ্টা করুন। আমার উপদেশ আপনার কাছে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ নাও হতে পারে। তবে আমার ভাবনায় যতটুকু আসলো আপনাকে বললাম। তবে আপনি আরোও বড় কোন বুজুর্গ ব্যক্তির স্বরণাপন্ন হতে পারেন।’

সম্পূর্ণ পড়ুন...

Monday, October 19, 2020

অন্তর্দ্বন্দ্ব

অন্তর্দ্বন্দ্ব

--মোঃ অলিউল্লাহ 


জীবনের স্বাদ গ্রহণ করতে গিয়ে বিষাদগ্রস্থ হবো তা কে জানত। এটা ঠিক যে আমার কৃত কর্মের কোন নতুন আগাছা জন্ম নেয়নি। কিন্তু আমার সব থেকে বড় প্রতিকূলতা বা প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাড়িয়েছো তুমি। আমি মানছি জীবনের গতিপথে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে কয়েকটা মারাত্মক ভুল করে ফেলেছি। আর সেজন্যে আমি অনুতপ্ত।

-সরি? ভুল? এটাকে তুমি ভুল বলবে?

তাহলে কী অন্য কিছু বলা উচিৎ?

-     -এতগুলো পাপকে তুমি কেবল ভুল বলে ইতি টানতে চাইছো?

আমি দুঃখিত। আমি লজ্জিত। আমি জানি ভুল আর পাপের মধ্যে পার্থক্য কতটুকু হওয়া উচিৎ। আর আমি এও জানি যে ভুলের সীমা আমি অতিক্রম করেছি। আমি পাপী। কিন্তু আমি এর গ্লানি আর নিতে পারছিনা। তুমি এমন কেন? তুমি কেন আমায় সামান্য সান্ত্বনা দেবার স্থলে বারবার আমার অতীতকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে আমাকে কাঠগড়ায় দাড় করাও? কেন তুমি আমার আর্তনাদ শুনতে পাওনা? কেন তুমি দেখতে পাওনা যে প্রায়শ্চিত্ত আমি করে যাচ্ছি দিনের পর দিন?

-    প্রায়শ্চিত্ত? হা হা হা, হাসালে বন্ধু। তুমি কী প্রায়শ্চিত্ত কাকে বলে এর সংজ্ঞা ও ভুলে গেছো?

কেন? আমি প্রতিনিয়ত সৃষ্টিকর্তার সান্নিদ্য পাবার চেষ্টা করছি। আমি প্রতিদিন প্রার্থনা করছি। আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করে ক্ষমা চাইছি আমার কৃত কর্মের জন্য। আমার জীবনে হারাতে হারাতে আর কিছুই বাকি নাই। এখন আমি নিঃশ্ব। আমি কারো সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত নই। কারো ক্ষতি করতে চাইনা। কারো প্রতি হিংসা, বিদ্বেষ বা কোন প্রকার জিঘাংসাও কাজ করেনা। আমার মধ্যে কোন লোভ নেই, লালসা নেই, উচ্চাকাঙ্ক্ষাও নেই। আমি একেবারে সাদামাটা জীবন যাপন করছি।



-     তো? তাতে কি হয়েছে?

তবুও বলবে আমি প্রায়শ্চিত্ত করছিনা?

-     না। শুন। তুমি শিক্ষিত হতে পারো। সুশীল হতে পারো। কিন্তু তুমি ভুলে গেছো তুমি যা করেছো, তা কোন দিন ক্ষমা পাবার নয়। আর তুমি যাকে প্রায়শ্চিত্ত বলছো, সেটা আসলে নিজেকে সান্ত্বনা দেবার ছলে তোমাকে নির্দোষ ভাবার অভিপ্রায়। তুমি এখন যা যা করছো, সেটা করাকে প্রায়শ্চিত্ত না বলে, বলা উচিৎ তোমার মানবিক দায়িত্ব। আর সৃষ্টি কর্তার আরাধনা করা, নামাজ পড়া, রোযা রাখা, সত্য কথা বলা, সৎ পথে চলা এগুলো তো একজন আদর্শ মুসলমানের প্রধান দায়িত্ব। যা তোমার নাবালক থেকে সাবালক হওয়ার সাথে সাথেই করা উচিৎ ছিল। বরং তুমি এতোদিন এসব না করে, এখন করছ। তোমার এতো দিনের না করা সকল কাজের যে অপূর্ণতা, সেগুলোই তো এখনো পরিপূর্ণ হয়নি। আর তোমার যে শূন্যতা বা হারানোর কথা বললে সেসবের উত্তর একটাই, এসব হবার ছিলো। কেন নয়? তুমি যদি মুসলিম হও, তোমার তো জানার কথা যে তুমি যা অর্জন করবে বা যা কিছু হারাবে সবকিছুই সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক পূর্ব নির্ধারিত। সেসবকে তুমি প্রায়শ্চিত্ত বলতে পারো না।

আচ্ছা তুমি কি একটিবারের জন্যও আমার হয়ে কথা বলতে পারো না। মানে আমাকে এতো নিরোৎসাহিত না করে, কিছুটা তো আশা জাগাতে পারো। বলতে তো পারো তুমি এমন কিছু করো, যা করলো তোমার সকল পাপ মোচন হয়ে যাবে? আর তুমি যে আমায় এতো দোষারোপ করছ, আমি কী সব কিছু নিজে থেকেই করেছি? তুমি কিছু করনি? তুমি আমাকে বাধ্য করনি এসব কাজ করতে? আমি কী তোমার কথা শুনে কিছুই করিনি?

-     অবশ্যই পারি তোমাকে উপায় বলতে। আমি হয়তো তোমাকে কিছুটা পাপ মুক্ত হওয়ার উপায় বলে দিতে পারি। তবে তোমাকে যা করতে বলবো তা তুমি করতে পারবে না। তোমার সেই সাহস নেই। নিজেকে নিষ্কলংক ও নিষ্পাপ করতে যা তোমার করা দরকার, তা তুমি করতে পারবেনা। আর যদি পারো তাহলে আমায় নিশ্চিত করে বলো। আমাকে দোষ দিওনা, কারণ তুমি যা কিছু করেছ সেই সময়টা তোমার শিশুকাল নয়। তুমি প্রাপ্ত বয়স্ক, শিক্ষিত ও হিতাহিত জ্ঞান সম্পন্ন একজন মানুষ। তুমি তোমার জৈবিক চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারনি। তোমার ইচ্ছাগুলোকে পূরণ করতে সদা তুমি উৎসাহী ছিলে। তুমি ভালো মন্দ বিচার না করে কেবল ক্ষণিকের সুখ ভোগ করতে এসব অপকর্ম করেছো। যৌবনের ভার বহন করতে না পেরে তুমি কি না করেছো বলতে পারো? বাবা-মায়ের পাঠানো টাকা পেয়ে বন্ধুদের নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছো, মদ্যপান করেছো, গান-নাচ, অশালীন জীবন যাপন ও নারীদের ভোগ করা তোমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। আর তুমি কিনা আমায় দোষ দিচ্ছ?

ঠিক আছে বলো আমি কী করবো? কী করলে আমার এ অন্তর্দ্বন্দ্ব থেকে আমি মুক্তি পাবো? আমি পারবো যা তুমি বলবে, তা করতে। আমাকে যে পারতেই হবে। বলো আমায়। প্লিজ একটিবার বলো।

-     তাহলে ছুটে তোমার সেই ফুফাতো বোনের কাছে। যাকে ভালোবাসার প্রলোভন দেখিয়ে তার সাথে দৈহিক মিলনের সূচনা করেছিলে। যদিও সেক্ষেত্রে তোমরা দু’জনেই পাপী, তবে তুমি প্রথমে তার কাছে তোমার দোষ স্বীকার করে বলো কোন উদ্দেশ্যে তার সাথে মিলিত হয়েছিলে? ক্ষমা চাও তার কাছে এবং দু’জন মিলে সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। হয়তোবা খোদা তায়ালা তোমায় ক্ষমা করে দিতেও পারে।

 


-     তারপর যাও সেই সোফিয়ার কাছে, যার মা তোমাদের বাসায় কাজ করতো। তাকে তুমি ধর্ষণ করতে চেয়েছিলে, সঠিক সময়ে তার মা চলে আসায় তোমার হাত বেঁচে যায়। কিন্তু তাকে তুমি কম কিছু করনি। তার ও তার মায়ের কাছে ক্ষমা চাও।

প্রথমটা মেনে নিলাম আমার দোষ ছিলো। আর ইচ্ছে করলে তাকে খোঁজেও পাবো ও ক্ষমা চাইতে পারবো। কিন্তু দ্বিতীয় অভিযোগটি আমি মেনে নিতে পারছিনা। কারণ আমাদের বাসায় যে মহিলা কাজ করতো তার মেয়ে প্রায়ই আমাকে দৈহিকভাবে উস্কানি দিতো, সে চাইতো আমি তার সাথে কিছু করি। এমনকি সে আমার রোমমেট এর সাথে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন করেছিল। আর সব থেকে বড় কথা- সে ও তার মা এখন ঠিক কোথায় আছে তা জানা কোনভাবেই সম্ভব নয়। কারণ সেই বাসা ছেড়েছি পনেরো বছর হয়ে গেলো। কী করে জানবো তারা কোথায় আছে?

-     শুন এসব তোমার মনগড়া যুক্তি। এসব বলে পার পাবেনা বুঝলে? তারপর যাও সেই নিলোফারের কাছে। যার সাথে তুমি দিনের পর দিন ও রাতের পর রাত ফোনালাপ করেছো। প্রেমের অভিনয় করেছো। আর যখনি তাকে সামনাসামনি দেখেছো, তাকে অপছন্দ করে, তিরস্কার করে তুমি চলে আসো। তাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কোন মূল্যায়ন করোনি। সে তোমাকে পাবার জন্য বহুকাল চেষ্টা করেছে। হতে পারে সে অসুন্দর কিন্তু তার সুন্দর একটা মন ছিলো। তুমি তাকে কষ্ট দিয়েছো। ক্ষমা চাও তার কাছে এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও কোন এক বেগানা নারীর সাথে সম্পর্ক করা ও মিথ্যে আশ্বাস দেবার জন্য।

এটা করতে পারবো। আমি তার খোঁজ হয়তো পাবো এবং তার কাছে আমি ক্ষমা চাইবো।

-     -এরপর যাও শরীফুন্নেছার কাছে ও রিমার কাছে। যাদের তুমি জীবন সঙ্গী করবে বলে দিনের পর দিন তাদের সাথে অবৈধ দৈহিক মিলনে সংঘঠিত হয়েছো। যদিও এতে তারাও সমান  অপরাধী। কিন্তু তুমিই ছিলে সবকিছুর নাটেরগুরু। তোমার প্রলোবনে পড়ে মেয়ে দু’টো তাদের সকল সম্ভ্রম ভুলে তোমার হাতে সব কিছু সপে দিয়েছিলো। কী মর্যাদা দিয়েছো তাদের বিশ্বাসের? এমনকি শরীফুন্নেছা যখন নিজেকে শুধরে নিয়ে ভালো হতে চেয়েছিলো তখনো তার সাথে ছলনা করে তুমি তাকে ধর্ষন করেছো। কত পাপ করেছো তুমি নিজে হিসাব করতে পারবে?

কেন এসব স্মরণ করিয়ে দিচ্ছো আমায়? কেন এতো লজ্জা দিচ্ছো আমাকে। আর কোন মুখ নিয়ে আমি ওদের সামনে দাড়াবো? আমি কি পারবো এখন ওদেরকে বিয়ে করতে? আমি প্রতিশ্রুতি কি আমি পারবো ফিরিয়ে দিতে? ওরা কারো না কারো ঘরে সংসার করছে। আমি কিভাবে এখন?

-     যা বলছি তা করতে পারলেই তুমি নিজের কাছে নিজেকে নির্দোষ ভাবতে পারবে। আর তুমি পারবেনা বলেই আমি তোমায় বলেছিলাম, সবই বৃথা চেষ্টা। তোমার সাহস নেই তা করার। তবুও যদি পারো, যাও সেসব মেয়েদের কাছে যাদের তুমি পথে-ঘাটে, ফোনে ও পরিচয় গোপন করে বিরক্ত করতে। ক্ষমা চাও সেই সব দেহবিক্রি করা নারীদের সাথে মিলিত হবার জন্যে। পারবে? জানি পারবে না।

আমি কি করবো বলো। তুমি যা বলছো, তা কিভাবে করবো। এসব কাজ তো মোটেই সহজতর নয়।

-     কিন্তু এখানেই তোমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত হবে তা ভেবো না। তোমার সকল কৃতকর্ম যথাযথ ধর্মীয় আইনের আওতায় অথবা গতানুগতি আইনের কাছে আত্মসমর্পন করে সকল অপরাধ স্বীকার করার পর, তোমার বিরোদ্ধে বিচারের যে সিদ্ধান্ত হবে তা মেনে নিলে হয়তো তুমি তোমার বিবেকের কাছে নির্দোষ বলে প্রমাণ করতে পারবে। এখন তোমার হাতেই তোমার দায়বদ্ধতা কিংবা মুক্তি।

এসব তুমি কীভাবে বলতে পারো? তুমি কী আমার নও? আর যদি তুমি আমার অস্তিত্বকে অস্বীকার করো, তবে কাকে আমি এতকাল আপন ভেবেছি? কাকে আমি আমার জীবন দিয়ে অনুসরণ করেছি? কাকে সন্তুষ্ট করার জন্য আমি এত কিছু করেছি?

-     তোমার কান্না আজ দেখার কেউ নেই। তোমার এ কান্নার জন্য তুমিই দায়ী। একদিন আমি তোমাকে অনেক ভয় দেখানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু তুমি আমার কথায় কর্ণপাত না করে নির্ভয়ে এতসব অপরাধ করেছো। আজ তুমি আমায় যতই আপন ভাবো, আমার জন্য বা আমাকে সন্তুষ্ট করতে তুমি কিছুই করনি। তোমার দেহ, তোমার যৌবনের তাড়না, তোমার জিগাংসাই তোমার কাল হয়ে দাড়িয়েছে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তুমি যতই ভাল কাজ করো না কেন, তোমার এই অপরাধবোধ তোমাকে অপরাধী করে রাখবে। কারণ তুমি প্রকৃত অর্থেই অপরাধী ও পাপী। তোমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত যে তোমাকেই করতে হবে।

সম্পূর্ণ পড়ুন...

Tuesday, February 18, 2020

সেদিনের দুরন্তপনা || মোঃ অলিউল্লাহ্


সেদিনের দুরন্তপনা

আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। আমার বন্ধু রোমেন আমার থেকে দুই-তিন বছরের ছোট হবে। সে তখন ক্লাস সিক্স এ পড়ে। আমাদের বন্ধুত্বে যতটা ঘনিষ্ঠতা ছিল, ততটা প্রতিযোগিতা মূলক ছিল আমাদের পড়াশোনায়। সব সময় আমরা ভাল রেজাল্ট করতে চাইতাম। আরো মজার ঘটনা আছে আমাদের পড়াশোনা নিয়ে।

আমি যখন  ক্লাস থ্রিতে পড়ি ও পড়তো ক্লাস ফোরে। আমার বাবা-মা হয়তো ঠিক সময়ে আমাকে স্কুলে ভর্তি করাতে ভুলে গিয়েছিল। আমি একদিন ওকে রিকুয়েস্ট করলাম ও যেন ইচ্ছে করে এক ক্লাস ফেল করে। তাহলে আমরা দুজন একসাথে এক ক্লাসে পড়তে পারবো। কিন্তু সে বাবা-মায়ের ভয়ে রাজি হলো না। এরপরেই ঘটলো দারোণ ঘটনা। অনেকটা কচ্ছপ আর খরগোশের গল্পের মতো। আমার বাবা-মা ধীরে ধীরে আমায় যখন বাড়িতে হাতে খড়ি দিচ্ছিল, তখন রোমেন স্কুলে শিক্ষকদের কাছ থেকে হাতে খড়ি নিচ্ছিলো। কিন্তু ক্লাস ফাইভের পর তার বাবা-মা ভাবলো আমার ছেলে খুব দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে, ওর একটু জিরিয়ে নেওয়া দরকার। তাই তাকে দুই বছর স্কুলে পাঠায়নি। আর এই সুযোগে আমি গেলাম ওর সিনিয়র হয়ে।

এক ক্লাস সিনিয়র, চাট্টিখানি কথা নয় কিন্তু।যা হবার হয়েছে, বন্ধুত্বে কিন্তু নো জুনিয়র সিনিয়র।কে আমরা আরো বেশি ঘনিষ্ঠ হলাম।  প্রতিদিন একসাথে স্কুলে যাওয়া আসা আর স্কুল শেষে নানা রকম খেলাধুলা করতাম।

একদিন স্কুল ছুটি ছিলো শবে বরাত উপলক্ষে। রোমেন আমায় এসে বলল, কিরে কি করছিস?
আমি তখন আমার বাড়ির আঙ্গিনায় ফুলবাগানে গাছের পরিচর্চা করছিলাম। ওকে দেখে মনে হলো কোন একটা প্লান নিয়ে আসছে। 

আমি জিজ্ঞাসা করলাম কেনরে, কিছু বলবি?
ও বলল চল ঘুরতে যাই।
আমি বললাম কই যাবি?
ও বলল- অনেক দূরে।
কিন্তু কিভাবে?
কেন তোর তো সাইকেল আছে।
হ্যা, কিন্তু এক সাইকেলে দুজন বেশি সময় ধরে চালাতে থাকলে পরিশ্রম বেশী হবে।
ও তখন বলল- আচ্ছা আমি তাহলে আলামিনের সাইকেলটা নিয়ে নেই।
পারবি নিতে? দিবে তো?
অবশ্যই দিবে। ঠিক আছে আমি নিয়ে আসছি।

যেই কথা সেই কাজ। একটু পরেই রোমেন সাইকেল নিয়ে হাজির। ওকে কানে কানে বললাম, তুই সাইকেলটা নিয়ে স্কুলের সামনে যা। আমি মা কে বলছি একটু ঘুরে আসি।
মা, ওমা।
কিরে?
আমি রসুলপুর যাবো, কিছু ফুলগাছ কিনে আনবো।

এতো দূরে যাওয়ার দরকার নেই। তোর বাবার সাথে বাজারে গিয়ে নিয়ে আসিস।
না না। বাজারে সব ফুল গাছ পাওয়া যায় না। আমি গেলাম, চলে আসবো তারাতাড়ি। একথা বলে বেরিয়ে গেলাম। কিরে কোন দিকে যাবি? চল উত্তর পাড়া হয়ে রসূলপুর যাই।
রসুলপূর কেন যাবো?
তাহলে আর কোথায় যাবো?
তুই না বললি অনেক দূরে যাবি?
হ্যা, কিন্তু বেশি দূরে গেলে মা চিন্তা করবে।

তুই বেশি দূরে গেলে, তোর মা জানবে কী করে? তোর মা কে কী সঙ্গে নিয়ে আসছিস?
আরে তা নয়, দূরে গেলে তো দেড়ি হবে বাড়ি আসতে। তখন মা চিন্তা করবে।
করলে করুক। মাঝে মাঝে ছেলেকে নিয়ে চিন্তা করা অনেক ভাল কাজ। আমরা কোম্পানীগঞ্জ থেকে সিলেট রোডে উত্তর দিকে যেতে লাগলাম। অনেক দূর গিয়ে একটা ব্রিজের উপর ওঠলাম। রোমেন জানতে চাইলো, কীরো আমরা এখন কোথায়?

কাউকে জিজ্ঞাসা কর। আচ্ছা করছি।
ভাই এই জায়গার নাম কি?
দোকান্দার- এইডা দো সিম্বি (সিএন্ডবি)। তোমরা কই যাইবা?
রোমেন- আমরা রসুলপুর যাবো। দোকান্দার- হেই জায়গা দো বহুত দূরে, তোমরা এত দূরে যাইবা কেমনে?
আমি বললাম, আমরা পারবো। একথা বলে সাইকেল চালাতে শুরু করলাম। অনেকক্ষণ চালানোর পর পৌছলাম গোপালনগর।

রোমেন বলল- চল, এদিক দিয়ে দক্ষিণ দিকে একটা রাস্তা গেছে। ওই রাস্তা ধরে রসুলপুর যাওয়া যায়।
আমি বললাম, রসুলপুর যাবো না।
তার মানে? কই যাবি তুই? আমি এদিক দিয়ে আর চিনিনা।
তোকে চিনতে হবেনা। আমরা ইন্ডিয়া যাবো আজ।
হ্যা, কী বলছিস! তোর মাথা ঠিক আছে? আমরা এতক্ষণে আট-দশ  কিঃমিঃ চালিয়ে আসছি। চল বাড়ি যাই। বাড়িতে কাউকে কিছু বলিনি?

কিছু হবে না। তুই ভাবিস না।
কিন্তু তুই চিনিস ইন্ডিয়া কিভাবে যেতে হয়?
তুই ভাবিস না। আমার বাবা চিনে।
কী আজব কথা বলছিস? তোর বাবা কি আমাদের সাথে আসছে নাকি?
বাদ দে তো। চল।
এটা কই আসলামরে?

একজন লোককে জিজ্ঞাসা করলাম- এটা কোন জায়গা?
পথিক- এইডা নব্বুর (নবীপুর)। তোমরা কইত্তে আইছো? কই যাইতাছো?
ভাই আমরাও জানিনা কই যামু।
দুস্ত আমার খুব পিপাসা লাগছে। আচ্ছা চল, সামনে একটা বাড়ি আছে, ওই বাড়িতে গিয়ে পানি খাবো।
আচ্ছা ঠিক আছে। ধীরে আরো অনেক পথ চলতে লাগলাম। তখনো আমরা একটু হাঁপিয়ে ওঠিনি। আরো ৮-১০ কিলোমিটারের মতো পথ গেলাম।

বিকাল চারটা বেজে গেছে। ঘন তরু ছায়ায় ততক্ষণে চারিপাশ রোদের উপর খানিকটা আবরণ ফেলে দিয়েছে। একজন বয়স্ক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম এখন আমরা ব্রাহ্মণপাড়া নাইঘর আছি। সাইকেল চালাতে চালাতে হরিমঙ্গল বাজার রোড ধরে কিছু দূরের পথ পাড়ি দিলাম দুই বন্ধু। হরিমঙ্গলের আগেই ঘুঙঘর নদী পার হয়ে হরিমঙ্গল রেল ক্রসিং এ কিছুক্ষণ থামলাম। সাইকেল দুটো রেললাইনের পাশে রেখে দুই বন্ধু প্রথমবারের মতো রেললাইনে কিছুক্ষণ হাটলাম। রেলগাড়ি এর আগে দেখা হয়নি আমাদের। আমি ওকে বললাম কিছুক্ষণ দেড়ি করলে মনে হয় একটা রেলগাড়িও দেখতে পাবো।

রোমেন বলল-আরে নাহ। রেলগাড়ি কখন আসবে তার কোন ঠিক আছে নাকি। আর বেশি দেড়ি করলে আমরা ইন্ডিয়ার বর্ডার পার হয়ে পাহাড় দেখতে পাবো না।
এখানে বলা রাখা ভালো: আমরা দু’জনেই জানতাম ইন্ডিয়া বর্ডার পার হলেই অনেক উঁচু উঁচু পাহাড় দেখতে পাবো। কারণ লোকের মুখে শুনেছিলাম ইন্ডিয়ায় অনেক উচুঁ পাহাড় আছে। বইয়ে ও পড়েছি। কিন্তু কোন বইয়ে পড়েছি মনে নাই। এতোকিছু মনে থাকে নাকি। আমাদের মাথায় গেঁথে গিয়েছিল ইন্ডিয়া মানেই পাহাড়ের দেশ। ভাগ্য খুবই ভালো ছিল, পাঁচ মিনিট পরেই ইয়া বড় এক রেলগাড়ি বেপু বাজিয়ে আসছিল। আমরা দু’জন খুশিতে আত্মহারা হয়ে একজন অন্যজনকে দেখছিলাম। আরো দেখছিলাম রেলগাড়িতে বসে থাকা লোকগুলোকে।

রোমেন আমাকে বলল- এই রেলটা মনে হয় ইন্ডিয়া থেকে আসছে।
আমি বললাম- আরে নাহ, এইটা বাংলাদেশী রেলগাড়ি। অনেক দূর থেকে আসছে।
ও আবার জিজ্ঞাসা করলো কতদূর থেকে আসছে?
আমি কিছুটা রেগে গিয়ে বললাম- তুই অনেক প্রশ্ন করিস। আমি এতো কিছু জানি নাকি? ও কিছুটা চুপ হয়ে গেলো, আর সরল চোখে আমার দিকে তাকালো। সাইকেল চালাতে চালাতে দু’জনের চেহেরাই রোদের আলোতে কালো হয়ে গেলো। আর পরতে পরতে ঘাম ঝড়েছে যে কতটা তা আর কী করে বোঝাই। 

তারপর গিয়ে পৌছালাম হরিমঙ্গল বাজার। সকালে দু’টো রুটি খেয়ে বের হয়েছি। খুব ক্ষিধা লেগেছে। ওকে বললাম কীরে তোর পেটে ক্ষিধা লাগেনি?
অনেক আগেই লাগছে। তোকে বলিনি। টাকা নিয়ে আসিনিতো। তুই তো বলিসনি এতো দূরে আসবি। বললে কিছু টাকা নিয়ে আসতাম।
ইশ! কত যে দিতো তোর মা তোকে টাকা।
দিতো না। আম্মা কেমন জানি। টাকা চাইলে দিতে চায়না। কিন্তু ঘরে নতুন চাল এসেছে। এক কেজি চাল চুরি করে এনে বিক্রি করে দিতাম। তাহলেই তো কিছু টাকা হয়ে যেতো।

থাক থাক। মন খারাপ করিস না। আমার পকেটে কিছু টাকা আছে। চল বাটারবন আর চা খেয়ে নেই।
হ্যা, চল।
ছোট একটা চায়ের দোকানে গিয়ে বললাম- বাটারবন আছে?
-হ, আছেদো। কয়ডা দেয়াম?
-দুইডা দেন। আর লগে চা ও খায়াম।
- আইচ্চা বও দিতাচ্ছি।

চা ও বাটারবন খেয়ে আবার শুরু হলো সাইকেল চালানো। ততক্ষণে পায়ে কিছুটা ব্যথা অনুভব করছি। কিন্তু রোমেনকে বলছিনা, বললে ও আবার আমাকে লজ্জা দিবে, যে আমি এতো তাড়াতাড়ি ক্লান্ত হয়ে গেছি। আমার মনে হয়, সেও ক্লান্ত হয়েছে, কিন্তু বলেনা। আমি লজ্জা দেবো সেইজন্য। আমি কী ওর মতো নাকি, কথায় কথায় লজ্জা দেবো। কতকিছু যে চলছে মনের ভিতর। সাইকেল চালাচ্ছি আর দু’জন কথা বলছি।

চারিদিকে গাছপালা ও পাখিদের কিচিরমিচির শুনছি। সারাদিনের রোদের পর গাছের ছায়ায় সাইকেল চালাতে চালাতে ভাবনাদের উস্কানি গেলো বেড়ে। কী দেখবো বর্ডার পেরিয়ে? আদৌ বর্ডার পেরোতে পারবো কিনা? কত বড় বড় পাহাড়, শুধুই কী দেখে চলে আসবো- নাকি পাহাড় বেয়ে উপরে ওঠবো? আরো কত কী চিন্তা খেলা করছিলো মাথায়।

হরিমঙ্গলের পর নবীয়াবাদরোড এর মাঝামাঝি একটা জায়গায় গিয়ে থামলাম। রাস্তার দুইধারে ছোট ছোট কিছু দোকান। ওখানকার লোকজনের মধ্যে অনেকেই আদিবাসী। একটি বটগাছের তলায় দু’জন বসে অল্পসময় রেস্ট করছিলাম। সাইকেল দু’টো স্ট্যান্ড করানো ছিল। এমন সময় একদল চোরাচালানকারী ব্যক্তি সাইকেলে করে চিনির বস্তা বহন করে অতিদ্রুত ভারত থেকে বাংলাদেশে চিনি চালান করছিল। এদের মধ্যে একজন, রোমেনের বন্ধুর সাইকেলটিতে তার সাইকেল দিয়ে ধাক্কা দিলো। সাইকেলের চাকাটা গেলো একদম বাকা হয়ে। কিন্তু সেই ব্যক্তি ধাক্কা মেরে আর দাড়ায়নি আরো বেশি গতিতে সাইকেল চালিয়ে চলে গেলো। কিন্তু আমাদের টেনশন গেলো বেড়ে। রোমেন তো প্রায় কাঁদতেছিলো।

আমার বন্ধুর সাইকেল। কী করবো এখন? ওকে আমি কী জবাব দেবো?
আমি বললাম, যা হবার হয়েছে। এখন তো মন খারাপ করে কিছু হবে না। চল দেখি সামনে কোন মেকানিকের দোকান পাওয়া যায় কিনা।
ও বলল, মেরামত করাবো কিভাবে? আমার কাছে তো কোন টাকা নাই।
আরে ভাবিস না, আমার কাছে আরো ত্রিশ টাকা আছে।

ত্রিশ টাকা দিয়ে কী সাইকেল মেরামতের কাজ করবে? আর সন্ধ্যাও হয়ে আসতেছে। বাড়ি যাবো কীভাবে?
এতো ভাবিস না চল আমার সাথে। কিছুদূর গিয়ে একজন মেকানিকের খোঁজ পেলাম।
ওনি বলল- এইডা ঠিক করাদো বহুত ঝামেলার। অনেক সময় লাগব। তোমরা ঘুইরা আইয়ো গিয়া।
আমি বললাম, কাকা আমাদের বাড়ি অনেক দূরে। আমরা ইন্ডিয়ার পাহাড় দেখতে এখানে আসছি।

এই কথা শুনে, ওনি বলল- বাড়ি কই তোমরার? আর এইখানে তো পাহাড় নাই। পাহাড় দেখতে অইলে ইন্ডিয়ার বর্ডার পারইয়া আরো বহুত মাইল দূরে যাইতে অইবো। তোমরাদো বর্ডার পারইতে পারতানা। বর্ডারে কাটাতার দেওয়া থাকে। ইন্ডিয়ার পাহারাদাররা পাহারা দেয়।

রোমেন বলল- আর পাহাড় দেখা লাগবেনা। আপনি শুধু আমাদের সাইকেলটা ঠিক করে দেন। তাহলে  বাড়ি যেতে পারবো। আমাদের বাড়ি অনেক দূর। গুঞ্জর আমাদের গ্রামের নাম।
ওইডা আবার কোয়ানো?
কোম্পানীগঞ্জ চিনেন?
হ, কোম্পানীগঞ্জ চিনি।
ওখান থেকে খুব কাছে।

তারপর শুরু হলো বিপদের দ্বিতীয় পর্ব। বিশাল আয়োজন করে বিদ্যুৎ চমকাতে শুরু করলো আকাশে। চারিদিক কালো অন্ধকার হয়ে আসতে লাগলো। একটার পর একটা বিকট শব্দের বাজ পড়তে লাগলো। মেকানিক কাকাকে খুব অনুরোধ করলাম, তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করতে। আবার মনে মনে আরেকটা ভয় কাজ করছে, ওনি সাইকেল মেরামত করে কত টাকা চাইবে সে কথা ভেবে।

আধঘন্টা পর সাইকেল মেরামত করা হলো। বৃষ্টিও কমে এলো। কিন্তু ততক্ষণে সন্ধ্যা ভারি হয়ে আসলো। ওনাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কাকা আপনাকে দেবার মতো তো খুব বেশি টাকা নেই। মাত্র ত্রিশ টাকা আছে। কিন্তু আপনি এতো কষ্ট করে মেরামত করলেন।
ওনি আমাদের দিকে চোখ বড় করে একমুহুর্তো তাকিয়ে রইলো। আমরা দু’জন দু’জনার দিকে দেখাদেখি করছি আর ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে আছি। ওনি পকেট থেকে দশ টাকা বের করে বললেন, ওই যে চায়ের দোকানডা দেখতাছো, ওইখান থাইক্কা আমার লাইগ্গা একটা চা আর একটা ইস্টারফিল্টার সিগারেট লইয়া আইয়ো। আমি টাকাটা নিয়ে চা ও সিগারেট নিয়ে আসলাম। চা তিন টাকা আর সিগারেট দুই টাকা। পাঁচটাকা ফেরত দিলাম। তারপর পকেট থেকে ত্রিশ টাকা বের করে ওনার হাতে দিয়ে বললাম, কাকা রাগ করবেন না। আমাদের কাছে আর টাকা নেই।

ওনি একটু মুচকি হাসলেন আর বললেন, তোমরার বয়সী আমার একটা পোলা আছে। স্কুলে পড়ে। মাসাল্লাহ ব্রেইন্ডা অনেক ভালা। টেয়া লাগদোনা। তোমরা জ্বলদি কইরা বাড়ি যাও। অনেক অনুরোধ করার পর ওনি বলল- পাঁচটেয়া দাও। ওই যে চা সিগারেট খাইলাম, ওইডা ধরো তোমরার টেয়া দিয়া খাইলাম আরকি।

আমি দিলাম এবং অনেক খুশি হলাম। তার শুরু হলো বিপদের তৃতীয় পর্ব। কাচা রাস্তা বৃষ্টিতে হাটু অবদি কাদা হয়ে আছে। অনেক দূর পর‌্যন্ত পায়ে হেটে সাইকেল ঠেলে রাস্তা পার হলাম। তারপর পেলাম পিচঢালা রাস্তা। দু’জন সাইকেলে উপর ওঠে চালাতে শুরু করলাম। কিন্তু আধাঘন্টা চালানোর পর আর শক্তি পাচ্ছিলাম না পায়ে। পেডেল দিতে গেলে পায়ে ব্যথা হয়। কিন্তু কিছু করার নেই। কিছুক্ষণ পায়ে হেটে কিছুক্ষণ সাইকেল চালিয়ে বহু কষ্টে বাড়ির কাছে আসলাম।

এখন আশঙ্কা বিপদের চতুর্থ পর্বের। বাড়িতে নিশ্চয়ই এতক্ষণে হুলোস্ছুল পড়ে গেছে। আসলে এর আগমুহুর্তেও বাড়ির কথা মনে পড়েনি। রোমেন বিদায় নিল আর বলল দুস্ত দোয়া করিস বাড়ি গিয়ে যেনো মায়ের হাতের মার না খাই। আমি বললাম, যা আল্লাহ্ ভরসা। আমার জন্যও একটু দোয়া কর। বাড়ি ঢোকলাম। কারো কোন সারাশব্দ নাই। রাত সাড়ে দশটা। সবাই শবে-ই-বরাতের নামাজ পড়ছে। আমি কিছুটা ফ্রেশ হয়েই বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ পরেই আমার চিৎকারে সারা বাড়ি মাথায় ওঠে গেলো। না না মায়ের হাতের মার খেয়ে নয়, সারাদিন সাইকেলের পেডেল মারার কারণে, পা ফুলে কলা গাছ হয়ে গেছে। পা থেকে ব্যথা ক্রমেই সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে।

আমার চিৎকার শুনে মা নামাজ ছেড়ে ওঠে এসে মন্ত্রের মতো একগুচ্ছ গালাগাল দিলো। তারপর অর্ধেক রাত পর্যন্ত হাত-পা মালিশ করে দিলো ও প্যারাসিটামল খাওয়ালো। জীবনে প্রথমবার আমার এমন দুরন্তপনা। যা সারাজীবন স্মৃতিতে গাথা হয়ে রইলো।

সম্পূর্ণ পড়ুন...