জীবনের বাঁক
মোঃ অলিউল্লাহ্
কত
দিন পর একটা
সুন্দর সকাল দেখছো তাই না? মনে পড়ে ঠিক কত দিন হয়েছে ভোরে ওঠে ফজরের নামাজ
পড়ে নির্জন পিচঢালা পথে হাটতে বের হওনি? বহুদিন আগে একবার তুমি আমি আমাদের
গ্রামের পিচঢালা পথে এমন কাকডাকা ভোরে হাটতে বের হয়ে ছিলাম মনে আছে?
“আছে
না আবার। অবশ্যই মনে আছে। তখন আমি বাড়ির নতুন বউ। আমি বাড়ির বাইরে যাবো না
বলার পরও তোমার চাপাচাপিতে বোরকা পরে হাটতে বের হয়ে ছিলাম। রাস্তার দুই
পাশে তাল গাছের সারি, মাঠ জুড়ে ফসল। স্তব্ধ সকালে নির্জনতায় আমরা দুজন
ভোরের হাওয়ায় মাতোয়ারা হয়ে গিয়েছিলাম।”
তোমার মুখটা আজ অন্যদিনের চাইতে
প্রাণবন্ত লাগছে, মনে হচ্ছে লাবণ্যময়ী একটা মায়াবী বদন।
অর্পিতা- হয়েছে, হয়েছে। এই সকাল বেলায় আমার প্রশংসা করে মন প্রফুল্ল করতে হবে না। আমি এমনিতেই খুশি।
আবিদ হাসান - আমি সেটাই বলছিলাম, কোন প্রশংসা না করলেও আজ তোমায় অন্যরকম দেখাচ্ছে। কিন্তু বললে নাতো?
অর্পিতা- কী বলবো?
আবিদ হাসান - এইযে তোমায় প্রশ্ন করলাম, কতদিন পর এমন একটা সুন্দর সকাল দেখছো?
অর্পিতা-
মনে নেই। আর ভাবতেও ইচ্ছে করছেনা। এখন শুধু ইচ্ছে করছে, এই মুগ্ধ আবহাওয়ায়
মিশে গিয়ে স্নিগ্ধ-সুভাষিত ফুলের ঘ্রাণ টেনে নেই নাক দিয়ে। পাখিদের
কিচিরমিচিরে কান পেতে রাখি অনেকটা সময়, শুনতে চাই ও বুঝতে চাই ওরা কি
বলা-বলি করছে। কীসে এত আনন্দ ওদের? ঠিক কী এমন আনন্দে ওরা প্রতিভোরে জেগে
ওঠে আর মেতে ওঠে কিচিরমিচিরে? ঐ নদীর মাঝখান থেকে ছুটে আসা শীতল হাওয়াটা
কেবল আমার মুখে এসে পড়েনা; আমার প্রশ্বাসকে থামিয়ে দিয়ে নিশ্বাসের সাথে
দেহে প্রবেশ করে সমস্ত শরীরে একটা অলৌকিক অনুভূতির শিহরণ জাগায়। তুমিই বলো
এমন পরিবেশে কী অন্য কিছু ভাবা যায়?
আবিদ
হাসান - আমি কী জন্য প্রশ্ন করেছি, তা
তুমি ভালো করেই বুঝে গেছো। তাই আমায় এড়িয়ে যাচ্ছো। আসলে প্রতিদিনই ভাবি
বিষয়টা নিয়ে তোমার সাথে কথা বলি। কথা বলা উচিৎ। দেখো, জীবনটা কি? কেন আমরা
দুনিয়াতে এলাম? জীবন ফুরিয়ে গেলে আমরা কোথায় যাবো? কী হবে আমাদের সাথে,
সেটা কমবেশি আমরা সবাই জানি।
অর্পিতা-
এই সাজ সকালে এসব নিয়ে কথা না বললে হয় না? কত সুন্দর একটা সকাল বলো। এই
দেখো কতগুলো বকুল ফুল পরে আছে, আমাকে কিছু কুড়িয়ে দাও না। বাসায় গিয়ে মালা
গাঁথবো।
আবিদ হাসান - তুমি আর সিরিয়াস হবে না (মুচকি হেসে)। এই নাও তোমার বকুল ফুল। গাছের তাজা ফুল।
অর্পিতা- তুমি গাছ থেকে কেনো ছিড়তে গেলে। গাছের ফুল গাছেই সুন্দর।
আবিদ হাসান -আরে নাহ, ছিড়ি নি। ডাল ধরে ঝাকি দিয়েছি, আর অনেকগুলো ফুল ঝরে পড়লো। এমনিতেই ঝরে যেতো রোধ ওঠলে। চলো নদীর ঘাটে গিয়ে বসি।
(হাটতে, হাটতে) একটা মজার ব্যাপার কী জানো, ঢাকা আসার পর আমি যতবারই বাসা
পরিবর্তন করেছি, প্রতিটা জায়গাতেই একটা অসম্ভব সুন্দর আকর্ষণীয় জায়গা খুঁজে
পেয়েছি; যেখানে আমি প্রায় প্রতিদিন গিয়ে বসতাম, অবসর সময় কাটাতাম, মন
খারাপ হলেই চুপচাপ একাকী বসে ভাবনার জগতে হারিয়ে যেতাম। এখানে আসার পরও এই
গোদারাঘাট ও নদীর পাড়টা আমার খুব ভাল লাগে। বিশেষকরে এই সকালবেলাটা। কারণ
কিছুক্ষণ পর থেকেই এখানে হাট বসবে, প্রচুর লোকসমাগম হবে। তখন আর চাইলেও এই
নির্জনতা উপভোগ করা যাবেনা।
অর্পিতা- ঢাকা আর কোথায় কোথায় এমন জায়গা
ছিল, যেখানে তুমি সময় কাটাতে? আমায় নিয়ে যাবে সেই জায়গা গুলোতে? আমার
বিশ্বাস এই জায়গাটির মতো, অন্য জায়গাগুলোও মনোমুগ্ধকর হবে। বাই দ্য ওয়ে,
তুমি কিন্তু আমায় সেই বিয়ের পর থেকেই, আশা দিয়ে যাচ্ছো কক্সবাজার নিয়ে
যাবে, কিন্তু নিয়ে তো যাচ্ছো না। সুযোগ পেলেই ওখানকার এটা সুন্দর, ওইটা
সুন্দর বলে আমায় লোভ দেখাও। নিজে তো বিয়ের আগেই গিয়ে ঘুরে ফিরে সব শেষ করে
ফেলেছো।
আবিদ হাসান - হা, হা। কী যে
বল, ঘুরাফেরার কী শেষ আছে? আরো কত বাকি। নিয়ে
যাবো ইনশা আল্লাহ। ঢাকায় একটা জায়গার নাম ছিল বাসাবো বাগানবাড়ি। সেখান
থেকে
কিছুটা দূরেই একটা জায়গা ছিলো কালিবাড়ি মন্দির। বিশালাকারের একটি দিঘি ছিলো
এবং
চারিপাশে বিশাল বিশাল বটগাছ ও অন্যান্য গাছ ছিল। বসে সময় কাটানোর জন্য
বেস্ট টাইম ছিল ভোর সকালে ও বিকাল বেলায়। আরেকটা জায়গা আমার খুব প্রিয় ছিল।
বালুঘাট,
ক্যান্টনমেন্ট এলাকার ভিতরে একটা জায়গা ছিল লাল দিঘির পাড় নামে। বিকেল বেলা
টিউশনি শেষ করে সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়টা কাটাতাম সেখানে। ভীষণ ভালো লাগতো।
সবাই যেতে পারতোনা সেখানে, সিভিলরা ঢুকতে পারতোনা। আমার বিশেষ পাশ ছিলো।
আরোও অনেক সুন্দর জায়গা ছিল, যেখানে আমি সময় কাটিয়েছি। এখন আর
আগের মত সেসব জায়গার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আছে কিনা জানা নেই। শুন, একটা
গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করবো, উত্তর দিবে?
অর্পিতা-
আমি জানি যত গল্পই করিনা কেন, তোমার মাথার ভিতর যেই কথাটা ঘুরছে সেটা না
বলা অবদি তোমার শান্তি নেই। আচ্ছা বলোতো জীবনের কোন সময়টা সব থেকে বেশি
আনন্দের? মানে শৈশবকাল, কৈশোরকাল ও শেষ বয়সে। -(গুদারাঘাটে বেঞ্চে
বসে।)
আবিদ হাসান - বিষয়টা আপেক্ষিক ও কিছুটা মনস্তাত্ত্বিক।
অর্পিতা- কেমন? বুঝিয়ে বলোতো।
আবিদ হাসান - যেমন ধরো অধিকাংশ মানুষই উত্তর দিবে, সব থেকে আনন্দের সময় হলো শৈশবকাল। কারন ওই সময় জীবন নিয়ে কোন চিন্তা-ভাবনা, পিছুটান, ক্যারিয়ার কোন কিছু নিয়েই ভাবতে হয় না। মনের ডানা মেলে উড়ে বেড়ানো যায়, যা সারাজীবন স্মৃতির পাতায় পঞ্জীভূত থাকে। সব থেকে বড় ব্যাপার হলো কোন দায়িত্বই পালন করতে হয় না। কিন্তু জীবনের যোগ-বিয়োগের হিসাবে এই শৈশবের কোন মূল্যই নাই। তবে কৈশোরকালকে অনেকেই বলে জীবনের বেস্ট টাইম। এই কথাটাও আপেক্ষিক। যেমন কেউ বলল জীবনে সফল হওয়ার জন্য কৈশোরই শ্রেষ্ঠ সময়। এখন প্রশ্ন হলো- সফলতা কী? হাজারটা উত্তর আসবে, যার সুনির্ধারিত কোন উত্তর নেই। শেষ বয়সে মানুষ মূল্যহীন হয়ে যায়। গুরুত্ব হারায় সাথে হারায় সুদীর্ঘকালে গড়ে তোলা স্ট্রং পারসোনালিটিও। যে ব্যক্তি হিসাবে কম গ্রাহ্য তার ব্যক্তিত্ব আর কতটা। আবার অনেকে ডিফারেন্টও হয়। অনেকের শৈশব, কৈশোরের মতো শেষ বয়সটাও সমানতালে সুন্দর হয়ে থাকে। কিন্তু জীবনের শ্রেষ্ঠত্ব তখনই প্রকাশ পায়, যখন অনন্তকালের জীবনের বুনিয়াদ তৈরি করে নেওয়া যায়। জীবনের যে অংশে সত্যিকারের দায়িত্ব পালন করে, তার সঠিক ফলাফল লাভের যোগ্য হয়, সেই সময়টিই শ্রেষ্ঠ সময়।
আমি বলবো আমার জীবনের আসল সময় হলো একটা টার্নিং পয়েন্ট বা আমুল
পরিবর্তনের সময়। এই সময়ে আমি চিনেছি নিজেকে অনেকটা। আমি জেনেছি এই দুনিয়ার
পরেও আরো একটা জগৎ আছে। আমি উপলব্ধি করেছি এই পৃথিবী নেহাত সৃষ্টি করা
হয়নি এবং পৃথিবীর সকল প্রাণীকেও অহেতুক সৃষ্টি করা হয়নি। সবকিছুর পিছনে
একটা মোটিভ রয়েছে। আমার সব থেকে বড় যে পরিবর্তন, তা হলো আমার দৃষ্টিভঙ্গি;
আমি জানতে শুরু করলাম প্রকৃত মানুষ কেমন আর জানলাম আমার আসল পরিচয় আমি
মুসলমান। আর যখন জানলাম, আমি মুসলমান, তখন আমার দায়িত্ব বেড়ে গেলো। সেই
দায়িত্ব আমাকে বলতে চাইলো, ‘You should do something different, Not like
others; who doesn't care about after death. It does matter for me, how I
treat my time and what will happen to me after ending the time’.
তুমি
কি জানতে চাও আমার সে অবস্থার কথা?
অর্পিতা- হ্যা, বলো।
আবিদ হাসান - যখন আমি ভাসছিলাম একটা মাঝিহীন নৌকায়?
গন্তব্য না জানা এক যাত্রায় আমি ভেসে বেড়াচ্ছিলাম। আমি ছিলাম এক উন্মাদ।
আমি নিজের ক্যারিয়ার, প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির ঘূর্ণিতে চক্রাকারে ঘুরছিলাম।
তখন কেউ একজন অথবা কোন এক দৈব ধমকা হাওয়া বেহেস্তের লোভ দেখিয়ে আমার
দৃষ্টিকে অবনত করল, আমার উচ্চাভিলাষ গুলো একই রেখে শুধু ধরণটা দিলো পাল্টে
অর্থাৎ দুনিয়ার অট্রালিকা, পাহারসম সম্পদ আভিজাত্য আর আত্মসম্ভ্রমের মিছে
অহমিকার কথা গেলাম ভুলে। কী জানি হলো আমার মাথাটায়, সবকিছু কেমন ঘোলাটে
লাগছিল, তারপর স্বচ্ছ চোখ দিয়ে আকাশটাকে দেখতে লাগলাম, কে এই আকাশে মালিক?
কে এই সুবিন্নস্ত জমিনের মালিক? পৃথিবীর সকল প্রাণের পালনকর্তা কে? কোন সে
ড্রাইভার যে সমস্ত বিশ্ব-ভ্রমান্ডকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন? কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন তিনি? কেন নিয়ে যাচ্ছেন?
অর্পিতা- সত্যি বলতে কী যখনই জীবনের মানে খুঁজতে চেষ্টা করি, মৃত্যু নিয়ে ভাবি এবং পরকালের কথা কল্পনা করি, তখনই আল্লাহর প্রতি অনেক ভয় জাগে। ভালো কাজ করতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে সামান্য হারামও যেন আমায় স্পর্শ না করে। কিন্তু পরক্ষণেই শয়তানের প্রলোভনে আটকে যাই। এক ওয়াক্ত/ দুই ওয়াক্ত নামাজ ছাড়তে ছাড়তে একটা সময় দীর্ঘ গ্যাপ হয়ে যায়। এমনটা কেন হয় জানিনা। কিন্তু তুমি যখনই আমায় অনুপ্রাণিত করো, আমি নতুন উদ্যম খোঁজে পাই। আবার নতুন করে শুরু করি।
আবিদ হাসান- মুসলমানের প্রধান শত্রু শয়তান। সে চাইবেই আমাদের ভুল পথে নিয়ে যেতে। কিন্তু আমাদের আসল চ্যালেঞ্জ হলো শয়তানের ধোকায় না পড়ে, বরং শয়তানকে ধোকা দেওয়া। আমাদের ঈমান খুব মজবুত নয়, তাই খুব সহজেই আমরা হেদায়াতের পথ হতে সরে যাই।
অর্পিতা- Exactly, মাঝে মাঝে মনে হয় আসলেই কি মৃত্যুর পর আখেরাত আছে? জান্নাত-জাহান্নাম আছে? নাকি নাই। লক্ষ-কোটি অমুসলিমরা সবাই কি জাহান্নামে যাবে? তারা সবাই কি ভুল? এমন সব প্রশ্ন মাথায় ঘোরপাক খায়।
আবিদ হাসান- সেজন্য ঈমানকে আগে মজবুত করতে হবে। একটা বহুতল ভবনের ভিত্তি যদি মজবুত না হয়, তাহলে তা অচিরেই দশে পরে যাবে। তেমনি মুসলমানের ঈমান যদি মজবুত না হয়, তাহলে সে প্রকৃত মুসলমান থাকবেনা। তোমার আশপাশে হাজারো মুসলমান দেখতে পাবে- কেউ নামধারী অর্থাৎ মুসলমান বাবা-মায়ের ঘরে জন্ম নিয়েছে বলে নিজেকে মুসলমান পরিচয় দেয়। কেউ আবার বছরে বা সপ্তাহে দু’য়েকবার নামাজ পরে আর ইসলামের অন্যসব বিষয় তোয়াক্কাই করেনা। কেউ কেউ আছেন নিয়মিত নামাজ, রোযাসহ ইসলামের সকল রোকনই সম্পন্ন করেন, কিন্তু তা যথাযথ ভাবে করেন না। আবার আরেক দল আছেন যারা খুবই পুঙ্খানোপুঙ্খভাবে ইসলামের প্রতিটা বিষয় নিয়ে গবেষণা করেন, বিশ্লেষণ করেন, জ্ঞানার্জন করে সঠিক বা উত্তম বিষয়টি গ্রহণ করেন আর সেই অনুরূপ আমল করার চেষ্টা করেন। যারা কালে-ভদ্রে ধর্মপালন করেন, তারা শয়তানের হাতের পুতুল। মাঝে মাঝে শয়তান অবসরে গেলে তাদের ভালো কাজ করতে মন চায়, এছাড়া যত হারাম কাজই করুক না কেন, তাদের বিবেক তখন ঘুমিয়ে থাকে।
আমাদের জীবনের দীর্ঘ একটা
সময় পার হয়ে যায় কেবল দুনিয়া নামক ব্যাপারটা মাথায় ঘুরাফেরার মধ্য দিয়ে।
যে বিদ্যা অর্জন করি সকল কিছু অন্য নয়নে দেখতে পাবো বলে, সেই বিদ্যান
চোখ তো সাধারণ চোখের মতই দেখে সবকিছু। অর্থোপার্জন তো লেখাপড়া না করলেও
করা যায়। সামান্য যেকোন কাজ শিখে নিয়েই বছরের পর বছর কাজ করে শ্রম দিয়ে
টাকা উপার্জন করা যায়। তাহলে এত সময় দিয়ে শিক্ষালাভ করার দরকার কি?
সতেরো-আঠারো বছর বিদ্যার্জন করে আমিও যদি সেই অনৈতিকভাবে অর্থ উপার্জন করি,
মিথ্যে বলি, ঘোষ খাই, সুদ খাই, পরের হক নষ্ট করি, আমানতের খেয়ানত করি, গুরুজনকে অসম্মান করি, অধ:স্তনদের অবজ্ঞা করি, বিপরীত
লিঙ্গের প্রতি বেপরোয়া আচরণ করি, লোলোপ দৃষ্টি দিয়ে কাউকে স্ক্যান করে
নেই এক মুহুর্তেই এবং সেই নেশার ঘোরে রাত্রি যাপন করে দেহ-মনের ক্রিড়ায় লড়াই করি, তাহলে
এতো বছরের বিদ্যা থেকে কি গ্রহণ করলাম?
শৈশবের
আদর্শলিপির আদর্শ আমাদের মাঝে কোথায়? আমরা কোথায় রক্ষা করলাম, আত্মীয়তার
বন্ধন? কোথায় খোঁজ নিলাম প্রতিবেশীর? কোথায় কারো বিপদে এগিয়ে গেলাম? কবে
অনাহারীকে আহার দিলাম? কবে অসুস্থকে সেবা করলাম? এসবইতো আমরা বইয়ে পড়েছি,
কিন্তু বইয়ের পড়া গুলো আমাদের তো কিছুই দিলনা।
তাই অন্য নয়নে দেখা হলোনা সেই বিদ্যান নয়নের।
তবে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
“ ৩৮. এবং দুনিয়ার জীবনকে বেশী ভালো মনে করে বেছে নিয়েছিল,
৩৯. জাহান্নামই হবে তার ঠিকানা৷
৪০. আর যে ব্যক্তি নিজের রবের সামনে এসে দাঁড়াবার ব্যাপারে ভীত ছিল এবং নফসকে খারাপ কামনা থেকে বিরত রেখেছিল
৪১.তার ঠিকানা হবে জান্নাত ৷
৪৬) যেদিন এরা তা দেখে নেবে সেদিন এর অনুভব করবে যেন ( এরা দুনিয়ায় অথবা
মৃত অবস্থায় ) একদিন বিকালে বা সকালে অবস্থান করছে মাত্র ৷”
------- সুরা- আন নাযিয়াত, আয়াত-৩৮-৪১ এবং ৪৬
যদি একান্তই আমরা শিক্ষার মর্যাদা ও গুণাগুণ নিজের মধ্যে ধারণ করতে পারতাম এবং এক ভিন্ন ব্যক্তিত্বের অধিকারী হতে পারতাম, তাহলে
সেই বইয়ের কথাগুলো আবার মনে করতাম। আল্লাহর বাণীগুলোকে সত্য বলে
বিশ্বাস করতাম। দুনিয়ার ক্ষণিকের সময়টাকে বেশী ভালো না ভেবে আখেরাতের কথা
ভাবতে শুরু করতাম। যে মেধা আমায় একজন ভাল ছাত্রে পরিণত করেছে, আমায় একজন ভালো
কর্মজীবী করেছে, সেই মেধার সঠিক প্রয়োগে যদি অনন্তকাল থাকার জায়গাটা বাছাই
করতে না পারি অর্থাৎ এখনকার এই মৃদুমুগ্ধ সকালের চাইতে লক্ষ্য-কোটিগুণ
উত্তম জায়গাটা না বাছাই করে , দুনিয়ায় উৎকৃষ্ট ভেবে পরকালের নিকৃষ্ট জায়গায়
আশ্রয় পাই, তাহলে আমরা আমাদের মেধার সঠিক প্রয়োগ ঘটাতে পারলাম না। আমাদের বিদ্যা বা মেধা ও বিবেকবোধ দুইয়ে মিলে যদি পরকালের শ্রেষ্ঠ আশ্রয়স্থল না
বাছাই করতে পারি, তাহলে সেই বিদ্যা পরিত্যাজ্য ছাড়া কিছুই নয়।
আমাদের প্রত্যেকের জীবনে একটা টার্নিং পয়েন্ট থাকা উচিৎ। আর সেই টার্নিং পয়েন্ট হবে জীবন বদলানোর মতো উদ্যোগ। সঠিক সময়ে আমাদের রবের ডাকে সারা না দিলে, বিশ্ব নবীর পথ অনুসরণ না করলে আমাদের ভবিষ্যত অন্ধকার। সামান্য জীবনের ক্যারিয়ার গড়তে আমরা ১৫-২০ বছরের প্রস্তুতি নেই। আর যেই স্থানে অনন্তকালের আবাস্থল সেই স্থানের জন্যে কী আমাদের দীর্ঘ প্রস্তুতির দরকার নেই?
আমাদের এই পরিবর্তন কেবল আখেরাতের পুঁজিই নয়, বরং দুনিয়াতেও আমরা খোঁজে পাবো চমৎকার এক জীবন। যা জীবনকে কতটা
সুখ দিতে পারে, কতটা শ্রেষ্ঠ মনোসত্ত্ব তৈরি করতে পারে, তা কল্পনাই করা যাবেনা।
সারা জীবনে এতো জ্ঞানার্জন, পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কোন
শিক্ষা-ই যে বিষয়টিতে আমাদের কনভিন্স করাতে পারলোনা, সেখানে আমাদের বিবেকের
নবজাগরন আমাদের কনভিন্স করল। সারাদিনে মহান আল্লাহর সামনে পাঁচবার দাড়াতে
পারা। গিবত বা পরনিন্দা করা এটা কেবল পরচর্চা নয়; নিজের ব্যক্তিত্বের
সংকটও তৈরি করে। বরং যেকোন মানুষের উপস্থিতিতে যতটা উত্তম আচরণে আর সামনে
গুণান্বিত হওয়া যায়, তার পিছনে তেমনই হওয়া উচিৎ, এতে কেবল লোকের মুখেই ভালো
হওয়া নয়; নিজের আত্মতৃপ্তির জায়গাটাও হয় সমৃদ্ধ।
এটা একটা মজার
অনুভূতি যে, আমরা সকাল থেকে রাতে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত কোন মানুষের সম্পর্কে
সমালোচনা, নিন্দা, কটুকথা, হিংসা বা বাজে মন্তব্য না করেই একটি দিন পার
করতে পারলাম। সারাদিন মিথ্যে না বলে একটা দিন কাটাতে পারলাম। সারাদিন
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে পারলাম। একটা দিনে আমি অসংখ্যবার আমাদের খালিকের
কথা স্মরণ করেছি, তাঁর শোকর গোজার করেছি, তাঁর প্রশংসা করেছি মনে মনে।
আমাদের দ্বারা যদি সারাদিনে
কারো কোন ক্ষতি না হয়। কারো অপকার অনিষ্ট না হয়। বিপরীত লিঙ্গের এমন কারো
দিকে না তাকানো, যাকে দেখা আমাদের জন্য হারাম; এমনকি একটি দিনে কোন প্রকার
হারাম লেনদেন না করা। পারলে মানুষের উপকার করার চেষ্টা করা, অসহায়কে
সাহায্য করার চেষ্টা করা আর অসুস্থ্য কেউ থাকলে সেবা করার চেষ্টা করা। আর
এই সবই করে আমাদের পালনকর্তার ভয়ে ও তাঁকে সন্তুষ্ট করতে যা কিছু করা হয় সবকিছুর জন্য অন্তরে এক ধরনের প্রশান্তি কাজ করে। সত্যি বলছি,
জীবনে এরচেয়ে ভালো অনুভূতি আর কখনো হয়না।
এভাবে একটা মানুষ নিজেকে বদলাতে পারলে, সে নিজেই পার্থক্য বুঝতে পারবে তার অতীত ও বর্তমানের অনুভূতি দ্বারা। যখন সে বেহিসেবি
দিন কাটিয়েছিলো, এখনকার হিসেব করা দিনগুলোর তাৎপর্য বুঝতে পারবে। আর তখনি একজন সঠিকভাবে দ্বীনের ভিতরে প্রবেশ করতে পারবে। মহান রাব্বুল আলামিনের
কাছে শোকরিয়া করছি, যে তিনি আমাকে দয়া করেছেন, আমার ঘুমিয়ে থাকা বিবেককে
জাগ্রত করেছেন। বিশ্বনবী মোহাম্মদ (সঃ) এর দেখানো পথে চলবার মতো তৌফিক
দিয়েছেন। আল্লাহ যেন, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেইভাবেই আমাদের সকলকে আমল করার তৌফিক দেন,
আমিন।
অর্পিতা- মাশা আল্লাহ্। আল্লাহ মেহেরবান। আলহামদুলিল্লাহ,
তুমি একজন মুসলমান হিসাবে দ্বীনের পথে চলার চেষ্টা করছো। আল্লাহ হেফাযত
করুন, আমিন। আমিও চেষ্টা করি নিয়মিত আল্লাহর বিধি-বিধান মেনে চলার, যদিও মাঝে মাঝে অনমনস্ক হয়ে শয়তানের ধোকায় পড়ে সময় নষ্ট করি, বিপথে চলে যাই। কিন্তু তোমাকে পাশে পেয়ে আমার কাজটা অনেক সহজ হয়েছে। একজন ভালো সঙ্গীই পারে খুব সহজে তার সঙ্গিনীকে হেদায়াতের পথে নিয়ে আসতে। একজন খারাপ মানুষ যেভাবে কাউকে প্রভাবিত করতে পারে, তেমনি একজন ভালো মানুষের প্রভাবেও অপরজন ভালো হতে পারে।
ঠিক বলেছো।
অর্পিতা-আমার ভালো লাগে, যখন
তুমি নিয়মিত কোরআন ও হাদিসের বিধান অনুযায়ী নিজেকে পরিচালিত করো এবং আমাকেও
সেইভাবে নির্দেশনা দাও। আলহামদুলিল্লাহ।
তুমি দ্বীনের প্রতি খুবই আন্তরিক, মাশা আল্লাহ। আলহামদুলিল্লাহ, আমি তোমাকে আমার স্ত্রী হিসাবে পেয়েছি এবং আমি আশা করছি ভবিষ্যতে আরো ভালোভাবে দ্বীনের পথে চলবে এবং দ্বীনের কাজ করবে, ইনশা আল্লাহ।
অর্পিতা- ইনশা আল্লাহ।