Tuesday, February 18, 2020

সেদিনের দুরন্তপনা || মোঃ অলিউল্লাহ্


সেদিনের দুরন্তপনা

আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। আমার বন্ধু রোমেন আমার থেকে দুই-তিন বছরের ছোট হবে। সে তখন ক্লাস সিক্স এ পড়ে। আমাদের বন্ধুত্বে যতটা ঘনিষ্ঠতা ছিল, ততটা প্রতিযোগিতা মূলক ছিল আমাদের পড়াশোনায়। সব সময় আমরা ভাল রেজাল্ট করতে চাইতাম। আরো মজার ঘটনা আছে আমাদের পড়াশোনা নিয়ে।

আমি যখন  ক্লাস থ্রিতে পড়ি ও পড়তো ক্লাস ফোরে। আমার বাবা-মা হয়তো ঠিক সময়ে আমাকে স্কুলে ভর্তি করাতে ভুলে গিয়েছিল। আমি একদিন ওকে রিকুয়েস্ট করলাম ও যেন ইচ্ছে করে এক ক্লাস ফেল করে। তাহলে আমরা দুজন একসাথে এক ক্লাসে পড়তে পারবো। কিন্তু সে বাবা-মায়ের ভয়ে রাজি হলো না। এরপরেই ঘটলো দারোণ ঘটনা। অনেকটা কচ্ছপ আর খরগোশের গল্পের মতো। আমার বাবা-মা ধীরে ধীরে আমায় যখন বাড়িতে হাতে খড়ি দিচ্ছিল, তখন রোমেন স্কুলে শিক্ষকদের কাছ থেকে হাতে খড়ি নিচ্ছিলো। কিন্তু ক্লাস ফাইভের পর তার বাবা-মা ভাবলো আমার ছেলে খুব দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে, ওর একটু জিরিয়ে নেওয়া দরকার। তাই তাকে দুই বছর স্কুলে পাঠায়নি। আর এই সুযোগে আমি গেলাম ওর সিনিয়র হয়ে।

এক ক্লাস সিনিয়র, চাট্টিখানি কথা নয় কিন্তু।যা হবার হয়েছে, বন্ধুত্বে কিন্তু নো জুনিয়র সিনিয়র।কে আমরা আরো বেশি ঘনিষ্ঠ হলাম।  প্রতিদিন একসাথে স্কুলে যাওয়া আসা আর স্কুল শেষে নানা রকম খেলাধুলা করতাম।

একদিন স্কুল ছুটি ছিলো শবে বরাত উপলক্ষে। রোমেন আমায় এসে বলল, কিরে কি করছিস?
আমি তখন আমার বাড়ির আঙ্গিনায় ফুলবাগানে গাছের পরিচর্চা করছিলাম। ওকে দেখে মনে হলো কোন একটা প্লান নিয়ে আসছে। 

আমি জিজ্ঞাসা করলাম কেনরে, কিছু বলবি?
ও বলল চল ঘুরতে যাই।
আমি বললাম কই যাবি?
ও বলল- অনেক দূরে।
কিন্তু কিভাবে?
কেন তোর তো সাইকেল আছে।
হ্যা, কিন্তু এক সাইকেলে দুজন বেশি সময় ধরে চালাতে থাকলে পরিশ্রম বেশী হবে।
ও তখন বলল- আচ্ছা আমি তাহলে আলামিনের সাইকেলটা নিয়ে নেই।
পারবি নিতে? দিবে তো?
অবশ্যই দিবে। ঠিক আছে আমি নিয়ে আসছি।

যেই কথা সেই কাজ। একটু পরেই রোমেন সাইকেল নিয়ে হাজির। ওকে কানে কানে বললাম, তুই সাইকেলটা নিয়ে স্কুলের সামনে যা। আমি মা কে বলছি একটু ঘুরে আসি।
মা, ওমা।
কিরে?
আমি রসুলপুর যাবো, কিছু ফুলগাছ কিনে আনবো।

এতো দূরে যাওয়ার দরকার নেই। তোর বাবার সাথে বাজারে গিয়ে নিয়ে আসিস।
না না। বাজারে সব ফুল গাছ পাওয়া যায় না। আমি গেলাম, চলে আসবো তারাতাড়ি। একথা বলে বেরিয়ে গেলাম। কিরে কোন দিকে যাবি? চল উত্তর পাড়া হয়ে রসূলপুর যাই।
রসুলপূর কেন যাবো?
তাহলে আর কোথায় যাবো?
তুই না বললি অনেক দূরে যাবি?
হ্যা, কিন্তু বেশি দূরে গেলে মা চিন্তা করবে।

তুই বেশি দূরে গেলে, তোর মা জানবে কী করে? তোর মা কে কী সঙ্গে নিয়ে আসছিস?
আরে তা নয়, দূরে গেলে তো দেড়ি হবে বাড়ি আসতে। তখন মা চিন্তা করবে।
করলে করুক। মাঝে মাঝে ছেলেকে নিয়ে চিন্তা করা অনেক ভাল কাজ। আমরা কোম্পানীগঞ্জ থেকে সিলেট রোডে উত্তর দিকে যেতে লাগলাম। অনেক দূর গিয়ে একটা ব্রিজের উপর ওঠলাম। রোমেন জানতে চাইলো, কীরো আমরা এখন কোথায়?

কাউকে জিজ্ঞাসা কর। আচ্ছা করছি।
ভাই এই জায়গার নাম কি?
দোকান্দার- এইডা দো সিম্বি (সিএন্ডবি)। তোমরা কই যাইবা?
রোমেন- আমরা রসুলপুর যাবো। দোকান্দার- হেই জায়গা দো বহুত দূরে, তোমরা এত দূরে যাইবা কেমনে?
আমি বললাম, আমরা পারবো। একথা বলে সাইকেল চালাতে শুরু করলাম। অনেকক্ষণ চালানোর পর পৌছলাম গোপালনগর।

রোমেন বলল- চল, এদিক দিয়ে দক্ষিণ দিকে একটা রাস্তা গেছে। ওই রাস্তা ধরে রসুলপুর যাওয়া যায়।
আমি বললাম, রসুলপুর যাবো না।
তার মানে? কই যাবি তুই? আমি এদিক দিয়ে আর চিনিনা।
তোকে চিনতে হবেনা। আমরা ইন্ডিয়া যাবো আজ।
হ্যা, কী বলছিস! তোর মাথা ঠিক আছে? আমরা এতক্ষণে আট-দশ  কিঃমিঃ চালিয়ে আসছি। চল বাড়ি যাই। বাড়িতে কাউকে কিছু বলিনি?

কিছু হবে না। তুই ভাবিস না।
কিন্তু তুই চিনিস ইন্ডিয়া কিভাবে যেতে হয়?
তুই ভাবিস না। আমার বাবা চিনে।
কী আজব কথা বলছিস? তোর বাবা কি আমাদের সাথে আসছে নাকি?
বাদ দে তো। চল।
এটা কই আসলামরে?

একজন লোককে জিজ্ঞাসা করলাম- এটা কোন জায়গা?
পথিক- এইডা নব্বুর (নবীপুর)। তোমরা কইত্তে আইছো? কই যাইতাছো?
ভাই আমরাও জানিনা কই যামু।
দুস্ত আমার খুব পিপাসা লাগছে। আচ্ছা চল, সামনে একটা বাড়ি আছে, ওই বাড়িতে গিয়ে পানি খাবো।
আচ্ছা ঠিক আছে। ধীরে আরো অনেক পথ চলতে লাগলাম। তখনো আমরা একটু হাঁপিয়ে ওঠিনি। আরো ৮-১০ কিলোমিটারের মতো পথ গেলাম।

বিকাল চারটা বেজে গেছে। ঘন তরু ছায়ায় ততক্ষণে চারিপাশ রোদের উপর খানিকটা আবরণ ফেলে দিয়েছে। একজন বয়স্ক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম এখন আমরা ব্রাহ্মণপাড়া নাইঘর আছি। সাইকেল চালাতে চালাতে হরিমঙ্গল বাজার রোড ধরে কিছু দূরের পথ পাড়ি দিলাম দুই বন্ধু। হরিমঙ্গলের আগেই ঘুঙঘর নদী পার হয়ে হরিমঙ্গল রেল ক্রসিং এ কিছুক্ষণ থামলাম। সাইকেল দুটো রেললাইনের পাশে রেখে দুই বন্ধু প্রথমবারের মতো রেললাইনে কিছুক্ষণ হাটলাম। রেলগাড়ি এর আগে দেখা হয়নি আমাদের। আমি ওকে বললাম কিছুক্ষণ দেড়ি করলে মনে হয় একটা রেলগাড়িও দেখতে পাবো।

রোমেন বলল-আরে নাহ। রেলগাড়ি কখন আসবে তার কোন ঠিক আছে নাকি। আর বেশি দেড়ি করলে আমরা ইন্ডিয়ার বর্ডার পার হয়ে পাহাড় দেখতে পাবো না।
এখানে বলা রাখা ভালো: আমরা দু’জনেই জানতাম ইন্ডিয়া বর্ডার পার হলেই অনেক উঁচু উঁচু পাহাড় দেখতে পাবো। কারণ লোকের মুখে শুনেছিলাম ইন্ডিয়ায় অনেক উচুঁ পাহাড় আছে। বইয়ে ও পড়েছি। কিন্তু কোন বইয়ে পড়েছি মনে নাই। এতোকিছু মনে থাকে নাকি। আমাদের মাথায় গেঁথে গিয়েছিল ইন্ডিয়া মানেই পাহাড়ের দেশ। ভাগ্য খুবই ভালো ছিল, পাঁচ মিনিট পরেই ইয়া বড় এক রেলগাড়ি বেপু বাজিয়ে আসছিল। আমরা দু’জন খুশিতে আত্মহারা হয়ে একজন অন্যজনকে দেখছিলাম। আরো দেখছিলাম রেলগাড়িতে বসে থাকা লোকগুলোকে।

রোমেন আমাকে বলল- এই রেলটা মনে হয় ইন্ডিয়া থেকে আসছে।
আমি বললাম- আরে নাহ, এইটা বাংলাদেশী রেলগাড়ি। অনেক দূর থেকে আসছে।
ও আবার জিজ্ঞাসা করলো কতদূর থেকে আসছে?
আমি কিছুটা রেগে গিয়ে বললাম- তুই অনেক প্রশ্ন করিস। আমি এতো কিছু জানি নাকি? ও কিছুটা চুপ হয়ে গেলো, আর সরল চোখে আমার দিকে তাকালো। সাইকেল চালাতে চালাতে দু’জনের চেহেরাই রোদের আলোতে কালো হয়ে গেলো। আর পরতে পরতে ঘাম ঝড়েছে যে কতটা তা আর কী করে বোঝাই। 

তারপর গিয়ে পৌছালাম হরিমঙ্গল বাজার। সকালে দু’টো রুটি খেয়ে বের হয়েছি। খুব ক্ষিধা লেগেছে। ওকে বললাম কীরে তোর পেটে ক্ষিধা লাগেনি?
অনেক আগেই লাগছে। তোকে বলিনি। টাকা নিয়ে আসিনিতো। তুই তো বলিসনি এতো দূরে আসবি। বললে কিছু টাকা নিয়ে আসতাম।
ইশ! কত যে দিতো তোর মা তোকে টাকা।
দিতো না। আম্মা কেমন জানি। টাকা চাইলে দিতে চায়না। কিন্তু ঘরে নতুন চাল এসেছে। এক কেজি চাল চুরি করে এনে বিক্রি করে দিতাম। তাহলেই তো কিছু টাকা হয়ে যেতো।

থাক থাক। মন খারাপ করিস না। আমার পকেটে কিছু টাকা আছে। চল বাটারবন আর চা খেয়ে নেই।
হ্যা, চল।
ছোট একটা চায়ের দোকানে গিয়ে বললাম- বাটারবন আছে?
-হ, আছেদো। কয়ডা দেয়াম?
-দুইডা দেন। আর লগে চা ও খায়াম।
- আইচ্চা বও দিতাচ্ছি।

চা ও বাটারবন খেয়ে আবার শুরু হলো সাইকেল চালানো। ততক্ষণে পায়ে কিছুটা ব্যথা অনুভব করছি। কিন্তু রোমেনকে বলছিনা, বললে ও আবার আমাকে লজ্জা দিবে, যে আমি এতো তাড়াতাড়ি ক্লান্ত হয়ে গেছি। আমার মনে হয়, সেও ক্লান্ত হয়েছে, কিন্তু বলেনা। আমি লজ্জা দেবো সেইজন্য। আমি কী ওর মতো নাকি, কথায় কথায় লজ্জা দেবো। কতকিছু যে চলছে মনের ভিতর। সাইকেল চালাচ্ছি আর দু’জন কথা বলছি।

চারিদিকে গাছপালা ও পাখিদের কিচিরমিচির শুনছি। সারাদিনের রোদের পর গাছের ছায়ায় সাইকেল চালাতে চালাতে ভাবনাদের উস্কানি গেলো বেড়ে। কী দেখবো বর্ডার পেরিয়ে? আদৌ বর্ডার পেরোতে পারবো কিনা? কত বড় বড় পাহাড়, শুধুই কী দেখে চলে আসবো- নাকি পাহাড় বেয়ে উপরে ওঠবো? আরো কত কী চিন্তা খেলা করছিলো মাথায়।

হরিমঙ্গলের পর নবীয়াবাদরোড এর মাঝামাঝি একটা জায়গায় গিয়ে থামলাম। রাস্তার দুইধারে ছোট ছোট কিছু দোকান। ওখানকার লোকজনের মধ্যে অনেকেই আদিবাসী। একটি বটগাছের তলায় দু’জন বসে অল্পসময় রেস্ট করছিলাম। সাইকেল দু’টো স্ট্যান্ড করানো ছিল। এমন সময় একদল চোরাচালানকারী ব্যক্তি সাইকেলে করে চিনির বস্তা বহন করে অতিদ্রুত ভারত থেকে বাংলাদেশে চিনি চালান করছিল। এদের মধ্যে একজন, রোমেনের বন্ধুর সাইকেলটিতে তার সাইকেল দিয়ে ধাক্কা দিলো। সাইকেলের চাকাটা গেলো একদম বাকা হয়ে। কিন্তু সেই ব্যক্তি ধাক্কা মেরে আর দাড়ায়নি আরো বেশি গতিতে সাইকেল চালিয়ে চলে গেলো। কিন্তু আমাদের টেনশন গেলো বেড়ে। রোমেন তো প্রায় কাঁদতেছিলো।

আমার বন্ধুর সাইকেল। কী করবো এখন? ওকে আমি কী জবাব দেবো?
আমি বললাম, যা হবার হয়েছে। এখন তো মন খারাপ করে কিছু হবে না। চল দেখি সামনে কোন মেকানিকের দোকান পাওয়া যায় কিনা।
ও বলল, মেরামত করাবো কিভাবে? আমার কাছে তো কোন টাকা নাই।
আরে ভাবিস না, আমার কাছে আরো ত্রিশ টাকা আছে।

ত্রিশ টাকা দিয়ে কী সাইকেল মেরামতের কাজ করবে? আর সন্ধ্যাও হয়ে আসতেছে। বাড়ি যাবো কীভাবে?
এতো ভাবিস না চল আমার সাথে। কিছুদূর গিয়ে একজন মেকানিকের খোঁজ পেলাম।
ওনি বলল- এইডা ঠিক করাদো বহুত ঝামেলার। অনেক সময় লাগব। তোমরা ঘুইরা আইয়ো গিয়া।
আমি বললাম, কাকা আমাদের বাড়ি অনেক দূরে। আমরা ইন্ডিয়ার পাহাড় দেখতে এখানে আসছি।

এই কথা শুনে, ওনি বলল- বাড়ি কই তোমরার? আর এইখানে তো পাহাড় নাই। পাহাড় দেখতে অইলে ইন্ডিয়ার বর্ডার পারইয়া আরো বহুত মাইল দূরে যাইতে অইবো। তোমরাদো বর্ডার পারইতে পারতানা। বর্ডারে কাটাতার দেওয়া থাকে। ইন্ডিয়ার পাহারাদাররা পাহারা দেয়।

রোমেন বলল- আর পাহাড় দেখা লাগবেনা। আপনি শুধু আমাদের সাইকেলটা ঠিক করে দেন। তাহলে  বাড়ি যেতে পারবো। আমাদের বাড়ি অনেক দূর। গুঞ্জর আমাদের গ্রামের নাম।
ওইডা আবার কোয়ানো?
কোম্পানীগঞ্জ চিনেন?
হ, কোম্পানীগঞ্জ চিনি।
ওখান থেকে খুব কাছে।

তারপর শুরু হলো বিপদের দ্বিতীয় পর্ব। বিশাল আয়োজন করে বিদ্যুৎ চমকাতে শুরু করলো আকাশে। চারিদিক কালো অন্ধকার হয়ে আসতে লাগলো। একটার পর একটা বিকট শব্দের বাজ পড়তে লাগলো। মেকানিক কাকাকে খুব অনুরোধ করলাম, তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করতে। আবার মনে মনে আরেকটা ভয় কাজ করছে, ওনি সাইকেল মেরামত করে কত টাকা চাইবে সে কথা ভেবে।

আধঘন্টা পর সাইকেল মেরামত করা হলো। বৃষ্টিও কমে এলো। কিন্তু ততক্ষণে সন্ধ্যা ভারি হয়ে আসলো। ওনাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কাকা আপনাকে দেবার মতো তো খুব বেশি টাকা নেই। মাত্র ত্রিশ টাকা আছে। কিন্তু আপনি এতো কষ্ট করে মেরামত করলেন।
ওনি আমাদের দিকে চোখ বড় করে একমুহুর্তো তাকিয়ে রইলো। আমরা দু’জন দু’জনার দিকে দেখাদেখি করছি আর ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে আছি। ওনি পকেট থেকে দশ টাকা বের করে বললেন, ওই যে চায়ের দোকানডা দেখতাছো, ওইখান থাইক্কা আমার লাইগ্গা একটা চা আর একটা ইস্টারফিল্টার সিগারেট লইয়া আইয়ো। আমি টাকাটা নিয়ে চা ও সিগারেট নিয়ে আসলাম। চা তিন টাকা আর সিগারেট দুই টাকা। পাঁচটাকা ফেরত দিলাম। তারপর পকেট থেকে ত্রিশ টাকা বের করে ওনার হাতে দিয়ে বললাম, কাকা রাগ করবেন না। আমাদের কাছে আর টাকা নেই।

ওনি একটু মুচকি হাসলেন আর বললেন, তোমরার বয়সী আমার একটা পোলা আছে। স্কুলে পড়ে। মাসাল্লাহ ব্রেইন্ডা অনেক ভালা। টেয়া লাগদোনা। তোমরা জ্বলদি কইরা বাড়ি যাও। অনেক অনুরোধ করার পর ওনি বলল- পাঁচটেয়া দাও। ওই যে চা সিগারেট খাইলাম, ওইডা ধরো তোমরার টেয়া দিয়া খাইলাম আরকি।

আমি দিলাম এবং অনেক খুশি হলাম। তার শুরু হলো বিপদের তৃতীয় পর্ব। কাচা রাস্তা বৃষ্টিতে হাটু অবদি কাদা হয়ে আছে। অনেক দূর পর‌্যন্ত পায়ে হেটে সাইকেল ঠেলে রাস্তা পার হলাম। তারপর পেলাম পিচঢালা রাস্তা। দু’জন সাইকেলে উপর ওঠে চালাতে শুরু করলাম। কিন্তু আধাঘন্টা চালানোর পর আর শক্তি পাচ্ছিলাম না পায়ে। পেডেল দিতে গেলে পায়ে ব্যথা হয়। কিন্তু কিছু করার নেই। কিছুক্ষণ পায়ে হেটে কিছুক্ষণ সাইকেল চালিয়ে বহু কষ্টে বাড়ির কাছে আসলাম।

এখন আশঙ্কা বিপদের চতুর্থ পর্বের। বাড়িতে নিশ্চয়ই এতক্ষণে হুলোস্ছুল পড়ে গেছে। আসলে এর আগমুহুর্তেও বাড়ির কথা মনে পড়েনি। রোমেন বিদায় নিল আর বলল দুস্ত দোয়া করিস বাড়ি গিয়ে যেনো মায়ের হাতের মার না খাই। আমি বললাম, যা আল্লাহ্ ভরসা। আমার জন্যও একটু দোয়া কর। বাড়ি ঢোকলাম। কারো কোন সারাশব্দ নাই। রাত সাড়ে দশটা। সবাই শবে-ই-বরাতের নামাজ পড়ছে। আমি কিছুটা ফ্রেশ হয়েই বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ পরেই আমার চিৎকারে সারা বাড়ি মাথায় ওঠে গেলো। না না মায়ের হাতের মার খেয়ে নয়, সারাদিন সাইকেলের পেডেল মারার কারণে, পা ফুলে কলা গাছ হয়ে গেছে। পা থেকে ব্যথা ক্রমেই সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে।

আমার চিৎকার শুনে মা নামাজ ছেড়ে ওঠে এসে মন্ত্রের মতো একগুচ্ছ গালাগাল দিলো। তারপর অর্ধেক রাত পর্যন্ত হাত-পা মালিশ করে দিলো ও প্যারাসিটামল খাওয়ালো। জীবনে প্রথমবার আমার এমন দুরন্তপনা। যা সারাজীবন স্মৃতিতে গাথা হয়ে রইলো।

No comments:

Post a Comment

Thanks for your comment