অন্তর্দ্বন্দ্ব
--মোঃ অলিউল্লাহ
জীবনের স্বাদ গ্রহণ করতে গিয়ে বিষাদগ্রস্থ হবো তা কে জানত। এটা ঠিক যে আমার কৃত কর্মের কোন নতুন আগাছা জন্ম নেয়নি। কিন্তু আমার সব থেকে বড় প্রতিকূলতা বা প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাড়িয়েছো তুমি। আমি মানছি জীবনের গতিপথে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে কয়েকটা মারাত্মক ভুল করে ফেলেছি। আর সেজন্যে আমি অনুতপ্ত।
-সরি? ভুল? এটাকে তুমি
ভুল বলবে?
তাহলে কী অন্য কিছু
বলা উচিৎ?
- -এতগুলো পাপকে তুমি কেবল ভুল বলে ইতি টানতে চাইছো?
আমি দুঃখিত। আমি লজ্জিত।
আমি জানি ভুল আর পাপের মধ্যে পার্থক্য কতটুকু হওয়া উচিৎ। আর আমি এও জানি যে ভুলের সীমা
আমি অতিক্রম করেছি। আমি পাপী। কিন্তু আমি এর গ্লানি আর নিতে পারছিনা। তুমি এমন কেন?
তুমি কেন আমায় সামান্য সান্ত্বনা দেবার স্থলে বারবার আমার অতীতকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে
আমাকে কাঠগড়ায় দাড় করাও? কেন তুমি আমার আর্তনাদ শুনতে পাওনা? কেন তুমি দেখতে পাওনা
যে প্রায়শ্চিত্ত আমি করে যাচ্ছি দিনের পর দিন?
- - প্রায়শ্চিত্ত? হা হা হা, হাসালে বন্ধু। তুমি কী প্রায়শ্চিত্ত কাকে বলে এর সংজ্ঞা ও ভুলে গেছো?
কেন? আমি প্রতিনিয়ত
সৃষ্টিকর্তার সান্নিদ্য পাবার চেষ্টা করছি। আমি প্রতিদিন প্রার্থনা করছি। আল্লাহর দরবারে
ফরিয়াদ করে ক্ষমা চাইছি আমার কৃত কর্মের জন্য। আমার জীবনে হারাতে হারাতে আর কিছুই বাকি
নাই। এখন আমি নিঃশ্ব। আমি কারো সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত নই। কারো ক্ষতি করতে চাইনা। কারো
প্রতি হিংসা, বিদ্বেষ বা কোন প্রকার জিঘাংসাও কাজ করেনা। আমার মধ্যে কোন লোভ নেই, লালসা
নেই, উচ্চাকাঙ্ক্ষাও নেই। আমি একেবারে সাদামাটা জীবন যাপন করছি।
- - তো? তাতে কি হয়েছে?
তবুও বলবে আমি প্রায়শ্চিত্ত
করছিনা?
- - না। শুন। তুমি শিক্ষিত হতে পারো। সুশীল হতে পারো। কিন্তু তুমি ভুলে গেছো তুমি যা করেছো, তা কোন দিন ক্ষমা পাবার নয়। আর তুমি যাকে প্রায়শ্চিত্ত বলছো, সেটা আসলে নিজেকে সান্ত্বনা দেবার ছলে তোমাকে নির্দোষ ভাবার অভিপ্রায়। তুমি এখন যা যা করছো, সেটা করাকে প্রায়শ্চিত্ত না বলে, বলা উচিৎ তোমার মানবিক দায়িত্ব। আর সৃষ্টি কর্তার আরাধনা করা, নামাজ পড়া, রোযা রাখা, সত্য কথা বলা, সৎ পথে চলা এগুলো তো একজন আদর্শ মুসলমানের প্রধান দায়িত্ব। যা তোমার নাবালক থেকে সাবালক হওয়ার সাথে সাথেই করা উচিৎ ছিল। বরং তুমি এতোদিন এসব না করে, এখন করছ। তোমার এতো দিনের না করা সকল কাজের যে অপূর্ণতা, সেগুলোই তো এখনো পরিপূর্ণ হয়নি। আর তোমার যে শূন্যতা বা হারানোর কথা বললে সেসবের উত্তর একটাই, এসব হবার ছিলো। কেন নয়? তুমি যদি মুসলিম হও, তোমার তো জানার কথা যে তুমি যা অর্জন করবে বা যা কিছু হারাবে সবকিছুই সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক পূর্ব নির্ধারিত। সেসবকে তুমি প্রায়শ্চিত্ত বলতে পারো না।
আচ্ছা তুমি কি একটিবারের
জন্যও আমার হয়ে কথা বলতে পারো না। মানে আমাকে এতো নিরোৎসাহিত না করে, কিছুটা তো আশা
জাগাতে পারো। বলতে তো পারো তুমি এমন কিছু করো, যা করলো তোমার সকল পাপ মোচন হয়ে যাবে?
আর তুমি যে আমায় এতো দোষারোপ করছ, আমি কী সব কিছু নিজে থেকেই করেছি? তুমি কিছু করনি?
তুমি আমাকে বাধ্য করনি এসব কাজ করতে? আমি কী তোমার কথা শুনে কিছুই করিনি?
- - অবশ্যই পারি তোমাকে উপায় বলতে। আমি হয়তো তোমাকে কিছুটা পাপ মুক্ত হওয়ার উপায় বলে দিতে পারি। তবে তোমাকে যা করতে বলবো তা তুমি করতে পারবে না। তোমার সেই সাহস নেই। নিজেকে নিষ্কলংক ও নিষ্পাপ করতে যা তোমার করা দরকার, তা তুমি করতে পারবেনা। আর যদি পারো তাহলে আমায় নিশ্চিত করে বলো। আমাকে দোষ দিওনা, কারণ তুমি যা কিছু করেছ সেই সময়টা তোমার শিশুকাল নয়। তুমি প্রাপ্ত বয়স্ক, শিক্ষিত ও হিতাহিত জ্ঞান সম্পন্ন একজন মানুষ। তুমি তোমার জৈবিক চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারনি। তোমার ইচ্ছাগুলোকে পূরণ করতে সদা তুমি উৎসাহী ছিলে। তুমি ভালো মন্দ বিচার না করে কেবল ক্ষণিকের সুখ ভোগ করতে এসব অপকর্ম করেছো। যৌবনের ভার বহন করতে না পেরে তুমি কি না করেছো বলতে পারো? বাবা-মায়ের পাঠানো টাকা পেয়ে বন্ধুদের নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছো, মদ্যপান করেছো, গান-নাচ, অশালীন জীবন যাপন ও নারীদের ভোগ করা তোমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। আর তুমি কিনা আমায় দোষ দিচ্ছ?
ঠিক আছে বলো আমি কী
করবো? কী করলে আমার এ অন্তর্দ্বন্দ্ব থেকে আমি মুক্তি পাবো? আমি পারবো যা তুমি বলবে,
তা করতে। আমাকে যে পারতেই হবে। বলো আমায়। প্লিজ একটিবার বলো।
- - তাহলে ছুটে তোমার সেই ফুফাতো বোনের কাছে। যাকে ভালোবাসার প্রলোভন দেখিয়ে তার সাথে দৈহিক মিলনের সূচনা করেছিলে। যদিও সেক্ষেত্রে তোমরা দু’জনেই পাপী, তবে তুমি প্রথমে তার কাছে তোমার দোষ স্বীকার করে বলো কোন উদ্দেশ্যে তার সাথে মিলিত হয়েছিলে? ক্ষমা চাও তার কাছে এবং দু’জন মিলে সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। হয়তোবা খোদা তায়ালা তোমায় ক্ষমা করে দিতেও পারে।
- - তারপর যাও সেই সোফিয়ার কাছে, যার মা তোমাদের বাসায় কাজ করতো। তাকে তুমি ধর্ষণ করতে চেয়েছিলে, সঠিক সময়ে তার মা চলে আসায় তোমার হাত বেঁচে যায়। কিন্তু তাকে তুমি কম কিছু করনি। তার ও তার মায়ের কাছে ক্ষমা চাও।
প্রথমটা মেনে নিলাম
আমার দোষ ছিলো। আর ইচ্ছে করলে তাকে খোঁজেও পাবো ও ক্ষমা চাইতে পারবো। কিন্তু দ্বিতীয়
অভিযোগটি আমি মেনে নিতে পারছিনা। কারণ আমাদের বাসায় যে মহিলা কাজ করতো তার মেয়ে প্রায়ই
আমাকে দৈহিকভাবে উস্কানি দিতো, সে চাইতো আমি তার সাথে কিছু করি। এমনকি সে আমার রোমমেট
এর সাথে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন করেছিল। আর সব থেকে বড় কথা- সে ও তার মা এখন ঠিক কোথায়
আছে তা জানা কোনভাবেই সম্ভব নয়। কারণ সেই বাসা ছেড়েছি পনেরো বছর হয়ে গেলো। কী করে জানবো
তারা কোথায় আছে?
- - শুন এসব তোমার মনগড়া যুক্তি। এসব বলে পার পাবেনা বুঝলে? তারপর যাও সেই নিলোফারের কাছে। যার সাথে তুমি দিনের পর দিন ও রাতের পর রাত ফোনালাপ করেছো। প্রেমের অভিনয় করেছো। আর যখনি তাকে সামনাসামনি দেখেছো, তাকে অপছন্দ করে, তিরস্কার করে তুমি চলে আসো। তাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কোন মূল্যায়ন করোনি। সে তোমাকে পাবার জন্য বহুকাল চেষ্টা করেছে। হতে পারে সে অসুন্দর কিন্তু তার সুন্দর একটা মন ছিলো। তুমি তাকে কষ্ট দিয়েছো। ক্ষমা চাও তার কাছে এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও কোন এক বেগানা নারীর সাথে সম্পর্ক করা ও মিথ্যে আশ্বাস দেবার জন্য।
এটা করতে পারবো। আমি
তার খোঁজ হয়তো পাবো এবং তার কাছে আমি ক্ষমা চাইবো।
- -এরপর যাও শরীফুন্নেছার কাছে ও রিমার কাছে। যাদের তুমি জীবন সঙ্গী করবে বলে দিনের পর দিন তাদের সাথে অবৈধ দৈহিক মিলনে সংঘঠিত হয়েছো। যদিও এতে তারাও সমান অপরাধী। কিন্তু তুমিই ছিলে সবকিছুর নাটেরগুরু। তোমার প্রলোবনে পড়ে মেয়ে দু’টো তাদের সকল সম্ভ্রম ভুলে তোমার হাতে সব কিছু সপে দিয়েছিলো। কী মর্যাদা দিয়েছো তাদের বিশ্বাসের? এমনকি শরীফুন্নেছা যখন নিজেকে শুধরে নিয়ে ভালো হতে চেয়েছিলো তখনো তার সাথে ছলনা করে তুমি তাকে ধর্ষন করেছো। কত পাপ করেছো তুমি নিজে হিসাব করতে পারবে?
কেন এসব
স্মরণ করিয়ে দিচ্ছো আমায়? কেন এতো লজ্জা দিচ্ছো আমাকে। আর কোন মুখ নিয়ে আমি ওদের সামনে
দাড়াবো? আমি কি পারবো এখন ওদেরকে বিয়ে করতে? আমি প্রতিশ্রুতি কি আমি পারবো ফিরিয়ে দিতে?
ওরা কারো না কারো ঘরে সংসার করছে। আমি কিভাবে এখন?
- - যা বলছি তা করতে পারলেই তুমি নিজের কাছে নিজেকে নির্দোষ ভাবতে পারবে। আর তুমি পারবেনা বলেই আমি তোমায় বলেছিলাম, সবই বৃথা চেষ্টা। তোমার সাহস নেই তা করার। তবুও যদি পারো, যাও সেসব মেয়েদের কাছে যাদের তুমি পথে-ঘাটে, ফোনে ও পরিচয় গোপন করে বিরক্ত করতে। ক্ষমা চাও সেই সব দেহবিক্রি করা নারীদের সাথে মিলিত হবার জন্যে। পারবে? জানি পারবে না।
আমি কি করবো বলো। তুমি
যা বলছো, তা কিভাবে করবো। এসব কাজ তো মোটেই সহজতর নয়।
- - কিন্তু এখানেই তোমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত হবে তা ভেবো না। তোমার সকল কৃতকর্ম যথাযথ ধর্মীয় আইনের আওতায় অথবা গতানুগতি আইনের কাছে আত্মসমর্পন করে সকল অপরাধ স্বীকার করার পর, তোমার বিরোদ্ধে বিচারের যে সিদ্ধান্ত হবে তা মেনে নিলে হয়তো তুমি তোমার বিবেকের কাছে নির্দোষ বলে প্রমাণ করতে পারবে। এখন তোমার হাতেই তোমার দায়বদ্ধতা কিংবা মুক্তি।
এসব তুমি কীভাবে বলতে
পারো? তুমি কী আমার নও? আর যদি তুমি আমার অস্তিত্বকে অস্বীকার করো, তবে কাকে আমি এতকাল
আপন ভেবেছি? কাকে আমি আমার জীবন দিয়ে অনুসরণ করেছি? কাকে সন্তুষ্ট করার জন্য আমি এত
কিছু করেছি?
- - তোমার কান্না আজ দেখার কেউ নেই। তোমার এ কান্নার জন্য তুমিই দায়ী। একদিন আমি তোমাকে অনেক ভয় দেখানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু তুমি আমার কথায় কর্ণপাত না করে নির্ভয়ে এতসব অপরাধ করেছো। আজ তুমি আমায় যতই আপন ভাবো, আমার জন্য বা আমাকে সন্তুষ্ট করতে তুমি কিছুই করনি। তোমার দেহ, তোমার যৌবনের তাড়না, তোমার জিগাংসাই তোমার কাল হয়ে দাড়িয়েছে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তুমি যতই ভাল কাজ করো না কেন, তোমার এই অপরাধবোধ তোমাকে অপরাধী করে রাখবে। কারণ তুমি প্রকৃত অর্থেই অপরাধী ও পাপী। তোমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত যে তোমাকেই করতে হবে।
No comments:
Post a Comment
Thanks for your comment