সব মানুষই পাগল
মোঃ অলিউল্লাহ্
প্রকৃতির প্রতিটা উপাদানেরই নির্দিষ্ট সীমারেখা বা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আর প্রকৃতির এই নির্দিষ্ট সীমা যখন অতিক্রম করা হয়, তখনই ঘটে প্রাকৃতিক দূর্যোগ। কৃত্রিমতা বা আর্টিফিশিয়ালিটি সব সময়ই প্রাকৃতিক উপাদানের উপর একটা অতিরিক্ত প্রলেপন। যেমন- মহান আল্লাহ কোন মানুষকে নির্দিষ্ট আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন, অথচ একজনের মনে হলো আমার চেহেরায় মেকআপ করলে আমাকে আরও আকর্ষণীয় দেখাবে। আর তাই সে নিজেকে সব সময়ই কৃত্রিম সাজসজ্জার মাধ্যমে আকর্ষণীয় করে রাখতে চায়, কিন্তু নির্দিষ্ট একটা বয়সে কিন্তু ঠিকই তার এই আর্টিফিশিয়ালিটি আর কাজে আসেনা, তার চেহারায় বয়সের ছাপ পড়ে; এমনকি কখনো কখনো সেই কৃত্রিমতার জন্য তার স্বাস্থ্যহানি বা ক্ষতিও হয়ে থাকে।
প্রকৃতি সর্বদাই নির্দিষ্ট রূপে ভারসাম্য বজায় থাকে, কিন্তু যখনই প্রকৃতিতে জোর করে কৃত্রিমতাকে চাপানোর চেষ্টা করা হয় তখন প্রকৃতি তার বিপরীতে প্রতিক্রিয়া দেখায়। সেটা কিছু আগে অথবা পরে।
পৃথিবীতে মানুষের জন্য আল্লাহ তায়ালার যে বিধান রয়েছে, সেই আইন বা বিধান মেনে চললে কোন মানুষই ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারেনা। কোন জীবন ব্যবস্থায় যতক্ষণ সুশৃঙ্খল ও আইন মানার প্রবণতা থাকে, সে জীবন ব্যবস্থা সবদিক থেকে ভারসাম্য বজায় থাকে।
এবার আসি আসল কথায়, আসলে আমার এই ভাবনা অনেকের কাছে অতি তুচ্ছ মনে হতে পারে। অনেকে ভাবতে পারেন এসব পাগলের প্রলাপ, অথচ আমি সেসব মানুষের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি বা পাগলামি নিয়েই কথা বলছি।
দেখুন, একজন ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত স্বাভাবিক অবস্থানে থাকে যতক্ষণ সে তার সুনির্দিষ্ট প্রয়োজন পূরণে ঠিক যতটা তার দরকার ততটাই সে পায়। অর্থাৎ প্রকৃত অর্থে কোন মানুষের যতটুকু যা প্রয়োজন, ততটুকু পেলেই তার যথেষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু যখন এর কম অথবা বেশি হয় তখনই বিপর্যয় ঘটে। ধরা যাক, একজনের পেটে ক্ষুধা লেগেছে, তার পেট ভরার জন্য যতটুকু খাবার দরকার ঠিক ততটাই তার জন্য যথেষ্ট। এর কম হলে পেট ভরবেনা অস্বস্তি লাগবে, আবার যদি পরিমাণের চেয়ে বেশি খায় তখন বদহজম হবে, আর তাতেও তার অস্বস্তি লাগবে। ঠিক তেমনি জীবন ধারনের জন্য মানুষের যা কিছু প্রয়োজন, ঠিক তা থাকলেই সুন্দরভাবে জীবন কেটে যাবে। এর কম-বেশি হলেই জীবনে ভারসাম্যহীনতা দেখা যায়।
মানুষের মৌল মানবিক চাহিদার মধ্যে আবশ্যিক বিষয়গুলোর বাইরে যা আছে তা-ই কৃত্রিমতা। অর্থাৎ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা এইসব চাহিদা একটা মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অতি প্রয়োজন। আরোও স্পষ্ট করে যদি মৌলিক চাহিদার কথা বলি তাহলো ক্ষুধা, নিদ্রা, মৈথুন। এগুলোর মধ্যে কোনটির অভাব হলেই জীবনযাপনে বাধাগ্রস্থ হবে। আবার এসব চাহিদার পরেও যাদের আরো অনেক চাহিদা তৈরি হয় তা নেহাত বিলাসিতার শামিল। এর মানে হলো এই যে, কেউ খাবার খেতে বসল, আর তার সামনে বিশ-ত্রিশটি আইটেমের খাবার পরিবেশন করা হলো। হয় সে সবগুলো থেকে একটু একটু করে টেস্ট করবে, না হয় দু'য়েকটা আইটেম দিয়েই খেয়ে উঠবে। এখানে মুদ্দা কথা হলো একজন ব্যক্তির খাবারের জন্য ঠিক যতটুকু খাবার দরকার ততটুকুই পরিবেশন করাটা স্বাভাবিক, এর বেশি করাটা অস্বাভাবিক বা বিলাসিতা। আর একটা সহজ ব্যাপার হলো অপচয়ের পরিণতি অভাব। এই কথার অর্থ হলো যদি একজনের আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি হয়, তাহলে অচিরেই সে অভাবগ্রস্থ হবে। যা কিনা তার জীবন যাপনের জন্য একটি বিপর্যয় বা প্রতিবন্ধকতা।
প্রাকৃতিকভাবে মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যা কিছু দরকার, তার বাইরে যে সকল বিষয়ের প্রয়োজন পড়ে তা হলো, চিত্তবিনোদন, সামাজিক পদমর্যাদা, ব্যক্তিত্ববোধ ও নিজেকে মানুষের চোখে শ্রেষ্ঠ করে তোলার একটা আপ্রাণ চেষ্টা। সেটা হতে পারে ক্ষমতার মাধ্যমে বা নিজের অবস্থান দ্বারা মানুষকে আকৃষ্ট করে লোকের চোখে নিজেকে জনপ্রিয় ভাবার মাধ্যমে আত্মতৃপ্তি। এই যে একধরনের চাহিদা, এটা খুবই মনস্তাত্ত্বিক ও মানুষের এক ধরনের ইলিউশান বা মোহ। আর এই মোহের কারনে মানুষ যারপরনাই ভূমিকা পালন করতে পারে। এক কথায়, এটা মানুষের একধরনের পাগলামি। ঠিক এই জায়গাটায় এসে সব মানুষই পাগল।
দেখেন, আপনার একান্ত মৌলিক চাহিদাগুলো যখন মিটে যায়, তখন আপনি স্বস্তিতে থাকেন। আর কথায় তো আছেই, সুখে থাকলে ভূতে কিলায়। যখন আপনার গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা মিটানোর পর স্বস্তিতে আছেন, তখন আপনার বিলাসী মন আরোও স্বস্তি বা ভালো থাকতে চাইবে। অর্থাৎ আরও কিভাবে ভালো থাকা যায় সেই চিন্তা আপনাকে অনবরত পোক করতে থাকবে। আর আপনি তখন আরও একটু বেশি ভালো থাকার কথা চিন্তা করে হয়তো অনেক পরিকল্পনা করবেন। এই যেমন- লোকের চোখে জনপ্রিয় হওয়ার জন্য কোন নেতা হলেন বা নিজের প্রতিভা দেখিয়ে হিরো কিংবা মডেল হলেন; যা আপনাকে একটা বাড়তি আত্মতৃপ্তি দেবে। তখন আপনি আহ্লাদে গদগদ হয়ে বলতেই পারেন, আরেহবাহ আমি তো বিশাল কাজ করে ফেলেছি। কিন্তু সত্যিকার অর্থে এটা একধরনের মোহ বা মায়া। মৌলিক চাহিদার বাইরে যে চাহিদাই আসে তা আপনার মধ্যে মোহ তৈরি করে।
এই দুনিয়ায় একেকজন মানুষ একেকটা জিনিসের প্রতি পাগল। কেউ পাগল ক্ষমতার, কেউ ধনসম্পদ বা টাকার পাগল, কেউ কারো প্রেমে পাগল, কেউবা জনপ্রিয় হবার পাগল, কেউ আবার ভাবের পাগল। যাইহোক, আমার এসব কথা বলার উদ্দেশ্য হলো এই পাগলামি বা এইসব চাহিদা কেবল মানুষকে বস্তবাদী ও দুনিয়ামুখী করে তুলে। দুনিয়াতে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে কিংবা নিজের অস্তিত্বকে স্থায়ী রূপ দিতে আমরা কত কিছুই না করতে চাই। দুনিয়াকে পর্যাপ্তভাবে ভোগ করার মানসিকতার কারনে আমরা আমাদের আসল পরিচয় ভুলে যাই। মহান সৃষ্টিকর্তা কোন উদ্দেশ্যে আমাদেরকে এই দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন তার কথা ভুলে যাই।
আমাদের এই ভোগবাদী মনোভাবের কারনে আমরা যারপরনাই খারাপ কাজে লিপ্ত হই। এই দুনিয়ায় চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, ঘোষ খাওয়া, সুদ খাওয়া, হত্যা, নির্যাতন, জুলুম ও অত্যাচার সবই সংগঠিত হয় এই ভোগবাদকে কেন্দ্র করে। যা প্রকৃতির প্রতিকূলে গিয়ে সামাজিক সমস্যা তৈরি করে। অথচ একজন মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য খুব বেশী কিছু দরকার পড়েনা। যদি কেউ ধর্মীয় বিধি বিধান মেনে চলে, তাহলে সে নিশ্চিত ভাবে সেই স্বাভাবিক জীবন ধারার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। একজন মুসলিম হিসাবে আমি ইসলাম ধর্মকে স্বয়ং সম্পূর্ণ মনে করি। আর আল্লাহ তায়ালা নিজেই বলেছেন, নিশ্চয়ই ইসলাম আল্লাহর মনোনীত ধর্ম।
যেখানে ভোগবাদ মানুষের মধ্যে মোহ তৈরি করে তাকে দুনিয়া মুখী করে তুলে, সেখানে ধর্মীয় অনুশাসন ও ধর্মীয় মূল্যবোধ একজন মানুষকে সর্বোচ্চ নৈতিক হতে সাহায্য করে। তার ভিতর কেবল দুনিয়ার প্রতি লোভ লালসা নয়, যেখানে মৃত্যুর পরে অনন্তকাল থাকতে হবে সেই ভাবনা তার মধ্যে কাজ করে। সে মৃত্যুকে ভয় করে, মৃত্যুর পরের জীবন সম্পর্কে ভয় করে, জান্নাত ও জাহান্নামের কথা স্মরণ করে দুনিয়ায় ভাল কাজ করে।
যার ভিতর দ্বীনের প্রতি গভীর বিশ্বাস আছে, সে ভোগবাদী না হয়ে বরং দুনিয়াতে কোনভাবে বেঁচে থাকার কথা ভাববে। আর তাই এই বস্তুবাদ মানুষের ক্ষণিকের মোহ বা ইলিউশান ছাড়া কিছুই না। কারন প্রতিটা প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। আর একজন মানুষ যখন মরে যায়, তখন দুনিয়ায় তার কোন অস্তিত্বই থাকেনা। যদিও বস্তবাদীরা কিছু মৃত মানুষের ইহলৌকিক কৃতকর্মের জন্য তাদের স্মরণীয় বা অমর বলে দাবী করে। আর এটাও তাদের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি কিংবা মোহ মায়ার প্রতিফলন ছাড়া কিছুই না।
কেনো একজন মানুষ মরে গেলে তার কোন অস্তিত্ব থাকেনা?
কারন ব্যক্তি নিজেই নিজের উপস্থিতি দেখছেনা। যেখানে আমি নেই, সেখানে আমার অস্তিত্ব কি করে থাকতে পারে। যে পৃথিবীতে ভাল থাকার জন্য এতো কিছু করছি, কতদিন আমি এখানে থাকতে পারবো? প্রতিটা মানুষের একটা নির্দিষ্ট বয়সসীমা বা ভ্যালিডিটি দিয়ে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে, এই ভ্যালিডিটি ফুরিয়ে গেলেই চলে যেতে হবে দুনিয়া ছেড়ে। কোথায় যাবো আমরা মৃত্যুর পর? কী হবে আমাদের সাথে? আর মানুষকে আল্লাহ তায়ালা এতো সুন্দর চিন্তা শক্তি ও বিবেক দেওয়া সত্ত্বেও যখন মানুষ ভ্রান্ত পথে চলতে চলতে পথভোলা হয়ে যায়, তারা পাগল ছাড়া আর কি? তাদের ভোগবাদ বা বস্তুবাদী মানসিকতা তাদের মধ্যে যে মোহ বা পাগলামির জন্ম দিয়েছে, সেই মোহে তারা অন্ধ। তারা তাদের জ্ঞানের সীমাকে সংকোচিত করে রেখেছে। আর সেজন্যই তাদের এই দুনিয়াপনা বা ভোগবাদ তাদেরকে পাগল হিসাবে সাব্যস্ত করেছে।
শেষ কথা হলো আমার এই লেখার প্রসঙ্গটিকে অনেকে ভুল ব্যাখা করতে পারেন। তারা হয়তো বলতে পারেন, শুধু যদি মৌলমানবিক চাহিদা পূরণ করেই মানুষ খান্ত হয়ে যায়, তাহলে তো মানুষের সৃজনশীলতার প্রকাশ পাবেনা। মানুষ একটা গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ হয়ে যাবে এবং মানুষ যদি কেবল আখিরাত নিয়ে ভাবে তাহলে দুনিয়ায় তো অচলাবস্থা তৈরি হয়ে যাবে। দেখুন, আমি আমার কথাগুলো দ্বারা শুধুমাত্র বুঝাতে চেয়েছি, কেউ যেনো ভোগবাদে এতটাই আসক্ত না হয়, যাতে করে সে আখেরাত বিমুখী হয়ে যায়। দুনিয়ায় সর্বোচ্চ নৈতিকতা ও ভাল কাজের মাধ্যমেই যেনো তার জীবন অতিবাহিত করতে পারে। কেউ যেনো দুনিয়ার মোহে পড়ে অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার, জুলুমের মতো অনৈতিক না হয়। পৃথিবীতে কেবল নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য যেনো বিনা দ্বিধায় কেউ পাপ না করে ফেলে এটাই বুঝাবার চেষ্টা করেছি।
No comments:
Post a Comment
Thanks for your comment