Saturday, April 28, 2018

অস্থায়ী

অস্থায়ী

মোঃ অলিউল্লাহ্
দুপুরের পর থেকেই নির্জীবতা বেড়ে চলেছে। আকাশে মেঘেরা যেমন ভার সইতে না পেরে বৃষ্টির ধারায় নেমে আসে তেমনি ল্যাক্রিমাল গ্ল্যান্ড থেকে অবাধ অশ্রুগুলো বেরিয়ে আসতে চায়। আর কর্ণিয়ারের আঙ্গিনায় ঘুর ঘুর করতে থাকে, একটা দীর্ঘশ্বাসের অপেক্ষায়। দীর্ঘশ্বাসের  অনুমতি পেলেই পৃথিবীর সকল সুখকে তলিয়ে দিয়ে আবেগের বন্যায় ভেসে যাবে। দু’একটা চুল সাদা হলেও তা আর্টিফিসিয়াল কালার মনে হয়। চল্লিশ পেরিয়েছে বটে; ভার্সিটির থার্ড ইয়ারের ক্লাসে ঘুরতে দেখে কেউ শিক্ষক না ভেবে বরং ছাত্র ভাবতে ভুল হবেনা। বহুকালের আক্ষেপ নিয়ে সেই পশ্চিম আকাশটাকে চোখ মেলে দেখছে। পলক ফেলতে ইচ্ছে করলেও সে কেমন ভয় বোধ করছে, যদি পলক ফেলতে গিয়ে জনমের তরে দৃষ্টি হারিয়ে ফেলে! একটা বড় জেদ, একটা ঘৃণা সেই দৃষ্টিতে- যা যাদুর শক্তির মতো পশ্চিম আকাশটাকে বিধ্বস্ত করে দিতে চায়। 

সাহিত্যের বইয়ের গল্পে পড়া সেই গৌধুলির উড়ে যাওয়া বকগুলোকে ভেবে নয়, বরং সেই বকের সাড়িকে তার একদল বিধবার সাদা কাপড়ে মুখ লুকিয়ে কোন দিকে না তাকিয়ে তীর্থের পথে হাটতে থাকার মতো ঠেকে। প্রাণের সকল আকুতি আর মিনতি যেন সূর্য না ডুবে, যেন আধাঁর না নামে, যেন পৃথিবী ঘুমিয়ে না পরে। সে একটি রাতকে সহস্র দিনের অংকের যোগফল বলে মনে করে। সমুদ্রদেশের নাবিকের যেমন কখন জাহাজ তীরে ভেরানোর তাড়া, তেমনটা তার রাত পোহানো নিয়ে।
  
কোন কম বয়সী ছেলের খামখেয়ালিপনা তার ভাল লাগে না। তার বন্ধু আফসার আলম ভার্সিটিতে পড়ার সময় তাকে বলেছিলো ‘তুই তোর গোড়ার কথা ভুলে গেলিরে। গ্রামে বড় হয়ে তুই শহরেই থাকিস সারাটা বছর। কখনো গ্রামে আসলেও ঘর থেকে বের হয়ে গ্রামটা ঘুরে দেখিস না। তা তোর মধ্যে দেশপ্রেম আছে তো শাওন?’
উত্তরটা একটু ক্ষিপ্ত ছিল তার, আফসার তার বন্ধু বলে হয়তো রাগের মাত্রাটা আরো বেশি ছিল। কারণ আপনজন না হলে কি পশমের গোড়ায় আটকে থাকা রাগগুলো ঝেড়ে ফেলা যায়? 

ধমকের সুরে বলল ‘তোর বাবা বিটেতে থেকে তুই যেমন বুক ফুলিয়ে চলতে পারিস, আমি সেটা পারিনা। আমি আমার বাবার বিটেতেই থাকি, তবুও লোকের মুখে শুনতে হয় ‘ওখরা’ শব্দটি। আমার বাবা আমার মাকে নিয়ে বিয়ের পনের বছর পর তার শ^শুরের গ্রামে একটি বাড়ি কিনে থাকতে শুরু করে। কিন্তু এরপরও সে নাকি ‘ওখরা’ অর্থাৎ তার পূর্বপুরুষেরা এখানে জন্মগ্রহণ করেনি। ছোট থেকে বড় হলাম এবং সেই ছোটবেলা থেকেই প্রতিবেশী, গ্রামবাসীর একটা হীনমানসিকতা দেখতাম। বাবা নিজে বাড়ি কিনলেও বহুকাল একটা অখ্যাত নামকে বহন করে বেড়িয়েছে পরোক্ষভাবে। কোন পথ দিয়ে হাটার সময় দূর থেকে একজন অন্যজনকে চোখের ইশারায় জিজ্ঞাসা করতো ‘কে’? তখন অন্য ব্যক্তিটি বলতো অমুকের জামাই।’

আফসার শুধু ফেলফেল করে চোখ মুখের দিকে তাকায়, কিছু বলার সাহস পায় না। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক তাকিয়ে আবার বলতে শুরু করেন তিনি ‘গ্রামে অন্য কেউ দশটা অন্যায় করে বংশের জোরে বেঁচে যায়, কিন্তু আমরা অন্যায় না করেও অসংখ্য অন্যায় অত্যাচার সহ্য করেছি। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করতো, দেবো নাকি গলা থেকে মাথাটা নামিয়ে। কিন্তু বাবা কোনদিনই কোন মানুষের সাথে প্রতিবাদ করতে দেয়নি। গ্রামের যে কোন উন্নয়নের জন্য বাবার সাহায্যের হাতটা ছিল অনেক বড়। তবে যে নেতার পকেটে উন্নয়নের টাকার সিংহভাগটা যাবে, তার নামটি দানের তালিকার শীর্ষে থাকতো। এরপরও আমাদের মনে করা হতো উদ্বাস্তু। সেই বড় হওয়ার পরও মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন দেখলাম না। আর কখনো আগ বাড়িয়ে নিজের পরিচয়টা তুলেও ধরতে চাইনি কখনো সমাজে। 

শুধু অপেক্ষা দেখি সমাজপতিদের চোখ আমাদের দেখতে পায় কিনা। শিক্ষা-সংস্কৃতির সকল কিছুতেই তো বিচরণ করেছি এই গ্রামে। কিন্তু মাধ্যমিক পাশ করার পরও অনেক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করতো কেরে ছেলেটা? তো উত্তর আসতো- অমুকের ছেলে। কেউ কেউ চিনতে পারলেও না চেনার ভান করতো। তারপর চলে গেলাম শহরে পড়াশুনা করতে। শিকড়ের টানে নাকি বড় মায়া, তা আমারও হয়েছিল। শৈশব থেকে কৈশোর পর্যন্ত সকল স্মৃতির টান, আর আমার গায়ে ধুলোবালি লেগে যে শরীর বেড়ে ওঠেছে- সে মাটির টান। গ্রামের নামটা আজো সেই সুতোর টানে আসে নি। এসেছে কেবল সেই মাটি, সবুজ ঘাসের মাঠ, নদীর তীরে ফসলের জমি আর ওইসব কদমগাছ, আম-জাম,শিমুল ও বটগাছ। দিঘীর জলে সারাদিন ডুবানোর স্মৃতি আর তোদের সাথে দল বেধে বিলে মাছ ধরতে যাওয়া। এখানে আসি কেবল এসবের টানে। কিন্তু সত্যিই আমি অধিকার খাটাতে যাই না এ আমার গ্রাম।

শহরের মানুষগুলো একেকটা মেশিনের মতো। এদের আবেগ-অনুভূতি বলে কোন কিছু লক্ষ্যণীয় হয় না। কেউ কারো বিপদে এগিয়ে আসে না। টাকা দিয়ে বাড়ি ভাড়া করতে গেলেও পাওয়া যায় না। আর পাওয়া গেলেও বাড়িওয়ালারা কসাইয়ের মতো ব্যবহার করে। তারা সর্বদাই আমাদের উদ্বাস্তু বা নদীর জলে ভেসে আসা মানুষ ছাড়া আর কিছু ভাবে না। পরগাছার মতো বেঁচে থাকতে হয় আমাদের, মেনে নিতে হয় অনেক অন্যায় আবদার। নিজের অস্তিত্ব অস্বীকার করতে পারি না বলে, ছুটে চলি একটি স্থায়ী পরিচয় পেতে। তবুও মনে মনে লালন করতে হয় আমি ডিপেন্ডেন্ট। আমার জন্ম সনদ আছে, জাতীয় পরিচয় পত্র আছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সকল সার্টিফিকেট আছে।

 আর এই সবগুলোতেই বাবার নাম ও মায়ের নাম আছে। তারপরও আমাকে কোথাও কিছু করতে গেলে একজন পরিচয় দান কারীর সাহায্য নিতে হয়। সেটা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি , ব্যাংক একাউন্ট খুলতে গেলে এমনকি চাকরির সিভিতেও দু’জন পরিচয়দান কারীর ঠিকানা ও পদ লিখতে হয়। প্রশ্ন হচ্ছে কেন? আমার জন্মসনদ, আমার জাতীয় পরিচয়পত্র, আমার সকল সার্টিফিকেট কি আমার পরিচয়ের জন্য যথেষ্ট নয়? তার মানে কি আমি এখনো এদেশের স্থায়ী নাগরিক হতে পারলাম না? আমি শুধুই ডিপেন্ডেবল?’

তার কথাগুলোতে হয়তো সুক্ষ্ম যুক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে। হয়তো নাও পাওয়া যেতে পারে। এগুলো হয়তো তার সত্ত্বা, তার অন্তর্দ্বন্দ্ব বা তার অস্তিত্বের টিকে থাকার প্রতিবন্ধকতা। যা তাকে সারাক্ষণ ভাবায়। এখন তার গৃহ নেই, তার ঠিকানা নেই, তার আশ্রয়স্থান বলতে কিছু নেই। তবে আছে, হ্যা সত্যিই আছে। সান্ত¡নার আবাসস্থানটা কিন্তু তার আছে। সে সারাদিন পথে পথে ঘুরে বেড়ায়, যখন তার কাজ না থাকে। কিছু বেদে যেমন নৌকায় করে ভেসে ভেসে কিছুকাল এখানে, কিছুকাল ওইখানে বসবাস করে সারাজীবনই অস্থায়ী হিসেবে কাটি দেয়। তেমনি সে জীবনের অনেকটা সময় এখানে-সেখানে কাটিয়েছে। সে একটি সরকারি ব্যাংকের ম্যানেজার। খুব আরাম আয়েশেই হয়তো কাটিয়ে দিতে পারতো জীবনটা। ঘর-বাড়ি, গাড়ি হয়তো সবই সে করতে পারতো নিজের জন্য। 

কিন্তু একটা স্বপ্ন সে প্রতিরাতেই জেগে জেগে দেখতো। কোন মানুষের অনাহার সে হতে দেবে না। কোন মানুষকে ফুটপাতে, স্টেশনে, রাস্তায় ঘুমাতে সে দেবে না। তার বেতনের টাকা দিয়ে এসব মানুষের জন্য খাদ্য আর সামান্য বাসস্থান করে দেয়ার দায়িত্বটাই তাকে পেয়ে বসল। যত বেকার যুবক আছে, তাদের সামান্য বেতনে হলেও নানা জায়গায় কাজের সুযোগ করে দেওয়াটাকে সে তার কাজের অংশ হিসাবে নিল। তবে তার সারাদিন বহু দায়িত্বের মধ্য দিয়ে কাটলেও রাতের বেলাটা সে নিজেই ফুটপাতে, কোন গাছের নিচে, বা খোলা মাঠে একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে কাধেঁর ব্যাগটাকে বালিশ হিসাবে ব্যবহার করে রাত কাটিয়ে দেয়। তবে খুব অল্পরাতই সে ঘুমিয়েছে। সে ঘুমিয়ে পড়লে পৃথিবীকে জেগে থেকে দেখবে কে? জোনাকি পোকার আলোয় সবুজ প্রকৃতিকে অবলোকন করবে কে? ভোর বেলা পাখি ডাকলে সে বুঝতে পারে এবার পাখিরা তাকে ঘুমাতে বলছে, আর তার দায়িত্বটা ততক্ষণের জন্য এরা নিবে বলে আশ্বাস দিচ্ছে।

কিন্তু এখন তার আর রাত কে সহ্য হয় না। সে সূর্যের ডোবে যাওয়াকে কোন এক দৈব অভিশাপ বলে মনে করে। সে সমস্ত রাতটিকে মুমূর্ষু রোগীর ছটফট করা যন্ত্রণা মনে করে। সে সকালটাকে মনে করে মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে সেই মানুষটির মতো। 

নিচের ডাউনলোড বাটনে ক্লিক করে গল্পটির পিডিএফ ডাউনলোড করুনঃ






No comments:

Post a Comment

Thanks for your comment