Sunday, December 29, 2019

সুপারম্যানের সর্দি-কাশি


রফিক- সাব্বির ভাই এতো লেট কেনো? তাড়াতাড়ি গিয়ে ডেস্কে বসে পড়েন। সুপারম্যান ওয়াশরুম এ আছে।

তাই নাকি? আজ মনে হয় খবর আছে।

সুশ্মিতা- কী ব্যাপার এতো লেট? আবহাওয়া কিন্তু খুব একটা ভালো না, বুঝলেন?

আচ্ছা তাই?

সুশ্মিতা- ওই যে আসছে সুপারম্যান। Be serious man!

সুপারম্যান- কি ব্যাপার সাব্বির, আজকেও কি রাস্তায় অনেক জ্যাম ছিলো? [সকলের দৃষ্টি আমার দিকে। আমি কি উত্তর দেই]

সরি ভাইয়া, সকাল থেকে মাথাটা ব্যথা করছিল। তাই কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে বের হয়েছি।

সুপারম্যান- দেখো, এসব এক্সকিউজ অনেক পুরণো হয়ে গেছে। আমার খুব ভাল জানা আছে, তোমরা কি বলতে পারো। এতো বেশি অসুস্থ হলে তো চলবেনা। ঠিক সময় অফিসে আসার চেষ্টা করো, বুঝছো?

জ্বি ভাইয়া।

সুপারম্যান- রওনক আসেনি এখনো? [একে অপরের দিকে চেয়ে চোখে ইশারা চলছে।]

সুশ্মিতা- ভাইয়া উনার তো কাল এক্সিডেন্ট হয়ে পা মচকে গেছে। আপনাকে ভয়ে জানায় নি, আপনি বকা দিবেন তাই।

সুপারম্যান- এটা তো কোন অফিসিয়াল ম্যানার হতে পারে না। একটা অফিসে কাজ করলে ন্যূনতম দায়িত্বজ্ঞান থাকতে হয়। সে তো জানে সে অফিসে না আসলে তার কাজটা পেন্ডিং হয়ে থাকবে। রাস্তাঘাটে সাবধানে চলাফেরা করতে হয়। একেকজনের একেকটা সমস্যা হতে থাকলে আমি অফিসের কাজ কিভাবে সামলাবো? আর ইদানিং খেয়াল করেছি, ছুটি নিবে কিন্তু জানাবে না। পিওন মাধ্যমে খবর পাঠাবে সে অফিসে আসতে পারবে না। এসব কি অফিসিয়াল ডেকোরামের মধ্যে পড়ে? [সবাই চুপচুপ। প্রত্যেকে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।]

সুমন- ভাইয়া একটু কথা বলার ছিলো।

সুপারম্যান- কি ছুটি লাগবে? ছুটি নিয়ে কোন কথা হবে না। অন্য বিষয়ে কথা থাকলে বলতে পারো। না হলে গো টু ইউর সিট।

সুমন- না ভাইয়া ছুটি চাইতে আসিনি। গতকাল যে ফাইলটা দিয়েছিলেন, সেই ফাইলটা কমপ্লিট করে আপনাকে শেয়ার করেছি। সেটা দেখে ফিডব্যাক দেওয়ার পর অনএয়ার করতে পারবো।

সুপারম্যান- ঠিক আছে। আমি দেখে তোমাকে জানাবো। আর সামনে আমাদের কাজের লোড অনেক বেড়ে যাবে, সো কোন ছুটি নেবার পরিকল্পনা করোনা।

সুমন- হ্যা! আচ্ছা ভাইয়া। কিন্তু ভাইয়া!

সুপারম্যান- নো কিন্তু। ছুটি নিয়ে আমি কোন কথা শুনতে চাই না। [সবাই চোখ কপালে তুলে তাকিয়ে রয়েছে।]

সুশ্মিতা- এই লোকের সমস্যা কি সুমন ভাই? ছুটি নিয়ে ওনার এতো এলার্জি কেনো? আমাদের ব্যক্তিগত প্রয়োজনের কথা ভেবেই তো কোম্পানী সিক লিভ ও ক্যাজুয়াল বরাদ্দ রেখেছে। তো সেই ছুটি দিতে ওনার এতো সমস্যা হয় কেনো?

সুমন- চাকরিটা কি ছেড়ে দিবে ভাবছো? যতদিন এরকম সুপারম্যান এর আন্ডারে চাকরি করবে, ততদিন ছুটি নিয়ে কোন কথা বলা যাবেনা। কিছু করার নেই বোন।

সুশান্ত- ভাইয়া আজ কিন্তু অনেক ভালো দেখাচ্ছে আপনাকে।

সুপারম্যান- কী ব্যাপার বলোতো? খুব পটাচ্ছো? ছুটি চাই? নাকি খুব তাড়াতাড়ি প্রমোশন দরকার? এতো পটানোর চেষ্টা করো না। ঝেড়ে কাশো।

সুশান্ত- ভাইয়া, আজ আমাদের ডিপার্টমেন্টাল মিটিং রয়েছে। বিকাল চারটায়।

সুপারম্যান- ঠিক আছে। আমি এটেন্ড করবো।

সুশান্ত- ভাইয়া একটা সমস্যা আছে।

সুপারম্যান- কি সমস্যা?

সুশান্ত- ভাইয়া, সুজন ভাই তো অসুস্থ। তিনদিন ধরে জ্বর। অফিসে আসবেনা আজ। ওনার তো প্রেজেন্টশন ছিলো।

সুপারম্যান- হোয়াট ইজ দিস? অসুস্থ! অসুস্থ্য! অসুস্থ্য! এতো অসুস্থ্য থাকো কেনো তোমরা? আমি সারা বছরে কয়দিন অসুস্থ্য থাকি?  আমি সারা বছরে কয়টা ছুটি নেই বলোতো?

সুশান্ত- ভাইয়া, তাহলে প্রেজেন্টেশন নিয়ে কি করবো?

সুপারম্যান- ওকে ফোন দাও। জিজ্ঞেস করো আসতে পারবে কিনা। জ্বর যদি কিছু কমে তাহলে চলে আসতে বলো।

সুশান্ত- ভাইয়া, ওনাকে এই অবস্থায় অফিসে আসতে বলা কি ঠিক হবে?

সুপারম্যান- ঠিক বেঠিক কি তোমার কাছ থেকে শিখবো আমি? তোমাকে যা বললাম, তা করো।

[তিনদিন পর..........]

মা- কিরে এই জ্বর নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস সাব্বির?

মা অফিসে যাচ্ছি।

মা- তোর গায়ে কত জ্বর দেখেছিস? এতো জ্বর নিয়ে আজ অফিসে যাওয়ার দরকার নেই। অফিসে ফোন দিয়ে বলে দে আজ যাচ্ছিস না।

না মা। বস কিছুতেই রাজি হবে না। আরো অনেক কথা শুনাবে।

মা- কোন কথা শুনাবেনা। তুই কল করে বল।

মা তুমি ওনাকে চিনো না। তাও তুমি যখন বলছো, দিচ্ছি কল। [কল হচ্ছে] আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া। ভাইয়া আমি সাব্বির বলছি।

সুপারম্যান- হ্যা, সাব্বির কি ব্যাপার বলো।

ভাইয়া, কাল রাত থেকে গায়ে অনেক জ্বর। আজ অফিসে আসতে পারছিনা।

সুপারম্যান- কি বলছো এসব? অফিসে না আসলে কিভাবে হবে? এসব চিন্তা-ভাবনা বাদ দাও, এসব আমি জানি। অফিসে আসো।

কিন্তু ভাইয়া!

সুপারম্যান- কিসের কিন্তু। তোমরা এতো অসুস্থ্য হও কেন? তোমাদের চলাফেরায় সমস্যা আছে। তুমি যেমন রক্ত মাংসের মানুষ আমিও রক্ত মাংসে গড়া মানুষ। আমি তো সারা বছরে একটাও সিক লিভ নেই না। তোমরা এতো সিক থাকো কেন? এতো বেশি সিক হলে তো চলবেনা।

ভাইয়া, শরীর অসুস্থ্য হলে তো কিছু করার থাকে না। আমি তো ইচ্ছে করে অসুস্থ্য হই না। হঠাৎ করে অসুস্থ্য হয়ে গেছি।

সুপারম্যান- না না এইসব বলো না। এসব এক্সকিউজ দিয়ে লাভ নেই। অসুস্থ্য হলে আমি অফিস চালাবো কিভাবে?

ভাইয়া মা বলছিলো অসুস্থতা নিয়ে আজ অফিসে না যেতে।

সুপারম্যান- তোমার মা এসব কথা কেনো বলবে? ওনি জানেনা তুমি চাকরি করো? তোমার মা বললেই তুমি অফিসে আসবেনা, এটা কেমন কথা হলো? চাকরি তুমি কর, তোমার মা তো চাকরি করে না। তাড়াতাড়ি অফিসে আসো।

ভাইয়া তাহলে একটু রেস্ট নিয়ে আসছি। একটু লেট হবে আসতে।

সুপারম্যান- ইউ আর অলরেডি লেট সাব্বির। তাড়াতাড়ি অফিসে আসো। আর এরকম ঘন ঘন অসুস্থ্য হওয়ার অভ্যাস চেঞ্জ করো। আমার এই বয়সেও আমি সারা বছরে একদিন ও অসুস্থ্য হই না। তোমাদের চলাফেরায় অনেক সমস্যা।

জ্বি ভাইয়া। ঠিক আছে ভাইয়া আসতেছি অফিসে।

সুশ্মিতা-  কি ব্যাপার সাব্বির ভাই, আপনি কি অসুস্থ্য?

না, তেমন কিছুনা সামান্য জ্বর।

সুশ্মিতা- জ্বর নিয়ে অফিসে আসছেন কেনো? ভাইয়া কে কল দিয়ে বলে দিতেন যে, আসতে পারবেন না।

কল দিয়েছিলাম। অনেক কথা শুনালো। তাই আসছি।

সুশ্মিতা-  ওহ আচ্ছা। আচ্ছা সাব্বির ভাই ওনি কি কখনো অসুস্থ্য হোন না? একটা মানুষ অসুস্থ্য হলেও তাকে ছুটি দেন না, এটা কেমন মানুষ?

ওনি তো তেমন একটা অসুস্থ্য হোন না। ওনি শারীরিকভাবে খুব ফিট থাকেন। আসলে সবার শারীরিক ফিটনেস তো একরকম নয়। কি আর করার বলো, পরের অধীনে চাকরি করা আর নিজেকে তার কাছে বিক্রি করে দেওয়া একই কথা।

সুশ্মিতা- ঠিক বলেছেন ভাইয়া। পৃথিবীর বহু দেশ থেকে দাশপ্রথা বিলোপ্ত হলেও আমাদের দেশের অনেক প্রতিষ্ঠানেই সেই ক্রীতদাস প্রথা রয়ে গিয়েছে।  এত পড়াশোনা করেও কিছু সেলারির জন্যে আমরা নিজেদের বিক্রি করে দিচ্ছি এসব লোকেদের কাছে। এখানে আমাদের ব্যক্তিত্ব, আত্মসম্মান ও ব্যক্তিগত ইচ্ছার কোন কোন মূল্য নেই। এসব প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার মানে হলো নিজের বাঁচা-মরার সকল সিদ্ধান্ত ওনাদের ওপর।

[একসপ্তাহ পর]


রওনক- সাব্বির ভাই, সুপারম্যান তো ছুটিতে আছে।

তাই? হ্যা, ছুটিতে তো থাকতেই পারে।

রওনক- আরে নাহ ভাই। সুপারম্যানের নাকি সর্দি-কাশি হয়েছে।

ওহ আচ্ছা। শীতকাল তো, অনেকেরই সর্দি-কাশি-জ্বর হচ্ছে।

রওনক- ভাই আপনি বুঝতেছেন না। আজকাল সুপারম্যানদের ও সর্দি-জ্বর হয়? দেশের কী অকাল পড়ল ভাই, সুপারম্যানের সর্দি-কাশি হয়েছে। মেনে নেয়া যায় বলেন?

সুশ্মিতা- রওনক ভাই সে সুপারম্যান হলেও কিন্তু সে ম্যান। আর সর্দি-কাশি মানুষের হতেই পারে। শুধু যখন ম্যানরা সুপারম্যান হয়ে ওঠে তখন তাদের কিছু হয় না।

রওনক- তার মানে সুপারম্যান সাহেবের ম্যান থেকে সুপার বাদ পড়ল?

ভাই আপনি পারেনও বটে।

[পরের দিন]

রওনক- ভাই সুপারম্যান তো এখনো আসলো না। আমার ফাইল তো অনএয়ার করতে পারছিনা।

চলে আসবে।  ওনি খুব দ্রুত সুস্থ্য হয়ে যেতে পারেন। ফিজিক্যাল ফিটনেস খুব ভাল ওনার।

সুশ্মিতা- তাই নাকি সাব্বির ভাই? ওনি অলরেডি কল দিয়ে বলেছে আজও অফিসে আসবেন না। অনেক ঠান্ডা লাগছে ওনার।

রওনক- কী বলছেন, সুপারম্যানের সর্দিকাশি তাতে আবার দুই দিনের ছুটি? আমাদের তো পা ভাঙলেও অফিসে চলে আসতে বলে। আর ছুটি দিলেও সর্বোচ্চ একদিন। যাক সুপারম্যান হওয়ার সুবিধা আছে ভাই।

সুশ্মিতা- ভাই মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ওনাকে জিজ্ঞাসা করি, যে আমাদের বরাদ্দ ছুটি থেকে আমাদের ছুটি দিতে আপনার এতো সমস্যা কিসের? কোম্পানী তো আমাদের শারীরিক অসুস্থ্যতার কথা ভেবে নিয়ম করেছে। আর আপনি এমন সব কথা-বার্তা বলেন যেগুলো দ্বারা কাউকে ব্যক্তিগতভাবে আঘাত করা হয়। আপনি নিজের সাথে অন্যকারো শারীরিক সুস্থ্যতা তুলনা করতে পারেন না। সবার ফিটনেস তো একরকম না। আবার কেউ রোবটও না যে সে কোনদিন অসুস্থ হবে না। আপনি সব সময় নিজে অসুস্থ্য হোন না, নিজে ছুটি নেন না বলে গলা ফাটান। ভাই আপনি যেই বেতন পান, সেটাতো একজন জুনিয়র পায় না। আপনি অসুস্থ্য হলে ভিআইপি হসপিটালে চিকিৎসা করাতে পারেন, একজন জুনিয়র কিন্তু সেই চিকিৎসা টা নিতে পারে না। আপনি নামি দামি গাড়িতে চলা ফেরা করতে পারেন, বিলাসবহুল বাড়িতে বসবাস করেন, সবার তো সেই ভাগ্য নেই। আর সবার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তো এক নয়। আপনি প্রত্যেকে নিজের মতো করে কেনো ভাবেন?

সুশান্ত- তো জিজ্ঞাসা করো না কেন?

সুশ্মিতা- জিজ্ঞাসা করি না, কারণ চাকরিটা হারাতে হবে। আর চাকরিটা হারালে সন্তান নিয়ে বিপদে পড়তে হবে। চাকরির বয়স শেষ নতুন চাকরি ম্যানেজ করাও অনেক কঠিন। না হলে অনেক আগেই লাথি মেরে চলে যেতাম।












No comments:

Post a Comment

Thanks for your comment