ছোটগল্পঃ
দূরত্ব দুই ইঞ্চি
মোঃ অলিউল্লাহ্
দূরত্ব দুই ইঞ্চি
মোঃ অলিউল্লাহ্
বসন্ত ঋতু হিসাবে ভাল লাগার কেন্দ্রে থাকলেও, শীতের শুরুটা কিছুটা হলেও মানুষকে গরমের তাপ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ে একটা নতুন অনুভূতির বেড়াজালে আবদ্ধ করে। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার রনক, রাজধানীর ফার্মগেট থেকে প্রতিদিনই পাবলিক বাসে করে আবদুল্লাহপুর যাওয়া আসা করেন। রীতিমতো আজো একঘন্টা পার হয়ে গেলো একটি গাড়ির অপেক্ষায়। দশ-পনের মিনিট পরপর দু’য়েকটা গাড়ি স্টপেজ এ আসলেও পূর্ববর্তী স্টপেজ হতে প্যাসেঞ্জার ভর্তি করে নিয়ে আসে। দুই-একজন ওঠার সুযোগ থাকলেও অসংখ্য মানুষের ভীড়ে ধাক্কাধাক্কি করে গাড়িতে ওঠার থেকে একঘন্টা পর বাসায় ফিরতে রনকের কোন আপত্তি নেই। শুরুতে হয়তো সে কিছুটা ক্লান্ত কিংবা অসহ্য না হয়ে পারতোনা; কিন্তু আজকাল তার সবই সয়ে যায়।
এই যা বলতে না বলতেই একটি সোনার হরিণ (দুঃখিত, একটি খালি গাড়ি) এসে হাজির। রনকের এ বেলায় আর কারো ধাক্কা খেতে হলো না গাড়িতে ওঠতে। বোনাস হিসাবেও পেয়ে গেলো জানালার পাশে তার প্রিয় সিট।একটা মুচকি হাসি দিতে আর তাকে কে নিষেধ করে। শহরের ধূলাবালিতে রনকের এলার্জি চরম আকার ধারণ করেছে।ডাক্তারদের কড়া নির্দেশ, ‘মাস্ক ব্যবহার ও ফুড এলার্জি জাতীয় সকল খাবার খাওয়া স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ। অতঃপর আপনি যদি তা পরিহার না করতে পারেন, তাহলে আপনার জন্য রয়েছে সামান্য খরোচে গিফট হিসাবে এ্যাজমা, দীর্ঘমেয়াদী সাইনোসাইটিস সমস্যা এবং হাপানির আশংকা।’
প্রতিবার নির্দেশ অমান্য করে ভোগান্তির শিকার হলে, এখন সে বেশ সচেতন হয়েছে বলা চলে। নিয়মিত মাস্ক ব্যবহার করে এবং অতি লোভনীয় খাবারগুলো দেখে জ্বিভে জল এসে গেলেও সেসব খাবার পরিহার করেছে।এখন সে খুব নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করে। সিটে বসে জানালা দিয়ে তাকাতেই দেখতে পেল অন্য একটি খালি বাস প্যাসেঞ্জার পাওয়ার লোভে প্রতিযোগিতামূলকভাবে প্রথম গাড়িটি শরীর ঘেষে সামনে বাড়ছিল। এমন সময় একটি মেয়ে দু’টি বাসের মাঝখানে পড়ে জীবন হারাতে গিয়ে চিৎকার করল। গাড়ির ড্রাইভার তাৎক্ষণিক গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণ না করল। মেয়েটি প্রাণে বেঁচে প্রথম গাড়িতে ওঠে বসল। রনক হতবম্ভ হয়ে তখনো বাইরে তাকিয়ে। ঘটনাটি তাকে খুব আতঙ্কিত করলো। তার মনে পড়ে গেল রাজিবের কথা। যে দুই বাসের প্রতিযোগিতায় প্রথমে একটি হাত হারানোর পর মারা যায়। রনক নিজের চোখের সামনে সেই মর্মান্তিক ঘটনা দেখার পর দীর্ঘদিন সেই যাতনাময় স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে।
রনকের বাহুতে একটা কোমল একটা স্পর্শ অনুভব করলো। কিছুক্ষণ আগের প্রাণে বেঁচে যাওয়া মেয়েটি তার পাশে এসে বসল। বাসের সিট ছোট বলে রনকের গা ঘেষেই মেয়েটি বসল। রনক মেয়েটির শরীরের কাপুনি অনুভব করলো। এত বড় বিপদ থেকে বেঁচে আসছে, এমন কাপুনি থাকাটা স্বাভাবিক ভেবে রনক পুনরায় জানালার দিকে তাকালো। গাড়িটি মহাখালি এসে পৌছল। অনেক যাত্রী উঠল গাড়িতে। দাড়িয়ে থাকা যাত্রীদের ধাক্কাধাক্কিতে মেয়েটি কিছুটা অস্বস্তি অনুভব করলো এবং বাধ্য হয়েই আরো খানিকটা রনকের শরীর ঘেষে বসল। রনক কিছুটা চমকে উঠল। কিছু সময়ের জন্য রনক জানালার দিকে তাকিয়ে কোথাও এক জায়গায় হারিয়ে গিয়েছিল, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
কিন্তু রনকের চোখ ছলছল করতে লাগল। ভিতরে ভিতরে রনক ছটফট করতে শুরু করলো।রনকের গলা শুকিয়ে এলো। বুকের ভিতরটাতে কেমন যেন একটা চাপা ব্যথা অনুভব করতে শুরু করলো।বসে থাকা মেয়েটি সামনের সিটের উপর যখন হাত রাখলো, রনক একদৃষ্টিতে সেই মেয়েটির ডানহাতের অনামিকা আঙ্গুলের দিকে তাকিয়ে রইলো। আঙ্গলের একটা কাটা দাগ, তার দৃষ্টি কে স্তম্ভিত করে দিলো। মেয়েটি একটি নীল রং এর বোরকা পড়ে আছে। মাথায় বেগুনী ও সাদা রং এর মিশ্রনে একটি স্কার্প। অনেক মেয়েরাই স্কার্প করে, তবে এমন নিখুঁতভাবে পরিপাটি হয়ে শুধুমাত্র একজনকেই স্কার্প করতে দেখেছে রনক। রনকের চোখের কৌতুহল বেড়ে গেলে হয়তো সে নিজের চোখকে বিশ্বাস না করতে পারে।
কিন্তু রনকের ভিতরে একটা মোহিত অনুভূতি তাকে মূহুর্তের মধ্যে নাড়া দিল।তার মস্তিষ্কে ভাইব্রেশনের মতো মনে হচ্ছে। যে পাগল পাড়া ঘ্রান তার জীবনের একটা দীর্ঘ সময়ে স্মৃতিতে বন্দী, সেই যাদুকরী ঘ্রান বুঝতে তার নাক অন্তত ভুল করতে পারে না। চোখের ভ্রুতে সেই শিল্পীর তুলিতে আকা কাজলের রেখা, রনকের দৃষ্টি শক্তিতে দ্বিখন্ডিত করে দিচ্ছে। সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে, ভারী গলায় নিচের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘যে সুভাষ নাকে মেখে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, আমার মস্তিষ্কে সঞ্চিত সেই সুভাষ চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছিল।হয়তো পৃথিবী আমায় করুণা করে, তোমায় মৃত্যুর কাছ থেকে টেনে নিয়ে এসে আমার পাশে বসিয়েছে। আরো একটি বার দূষিত বাতাসকে দূষণমুক্ত ও পবিত্র করতে তোমার শরীরের সেই সুভাষ ভেসে এসেছে আমার মস্তিষ্কে। জমে যাওয়া স্মৃতিকে করেছে স্বাভাবিক।’
রনকের কথা শুনে মেয়েটি তার কাছ থেকে দুই ইঞ্চি সরে বসল এবং তার দিকে তাকালো।
কিন্তু রনকের মাথায় ক্যাপ ও মুখে মাস্ক থাকায় তাকে চিনতে পারলো না সহজে। পাঁচ বছর আগের যে সুপরিচিত কন্ঠস্বর, এতোদিনে কিছুটা পরিবর্তন হওয়া তো স্বাভাবিক। কিন্তু একেবারেই যে চেনা অসম্ভব তা কিন্তু হওয়ার কথা নয়। কিন্তু মেয়েটির চাহনিতে যে এবার কৌতুহল লক্ষ্যণীয়। মৃদু স্বরে মেয়েটি রনককে জিজ্ঞাসা করলো, ‘আপনি যা বলছেন, সেসব কি আমাকে ইঙ্গিত করে বলছেন?’
রনক কিছু বলল না। কিছু বলতে পারলোনা। কন্ঠ তার বাকপ্রতিরোদ্ধ হয়ে আসছিলো ক্রমান্বয়ে। চোখ ভিজে আসল, যা মেয়েটির দৃষ্টিকে এড়াতে পারে নি। রনক এক মোহমায়ায় আবদ্ধ হয়ে অপলক নয়নে তাকিয়ে রইলো মেয়েটির চোখের পানে।
মেয়েটি পুনরায় বললো, ‘আপনার চোখে পানি? আপনি কী কাঁদছেন? কোন সমস্যা?’
রনক একবার তার আর মেয়েটির মাঝখানে যে দূরত্ব, তা অনুমানে পরিমাপ করে নিল। পরে বলল, ‘ধমকা হাওয়ায় যখন আমি উড়ে যাচ্ছিলাম, বিলীন হয়ে যাচ্ছিল আমার অস্তিত্ব; সেই মূহুর্তে কেউ একজন অতিদূর সীমান্তের ওপার হতে কাছে এসে আমায় করেছিল মুগ্ধ। ফিরিয়ে এনেছিল নির্মম বাস্তবতা থেকে আবেগময় নিবিড়তায়। হতাশার দু’চোখে যে স্বপ্নের বীজ বুনেছিল। যে করেছিল আমায় অনুরাগী, শিখিয়েছিল কী অভিমান আর খুনশুটি। দেখিয়ে ছিল কী জীবন আর কী অভিশাপ। আমি হয়তো সেই মানুষটির পাশে বসে আছি। যেই অপরিচিত পথে হাতে হাত রেখে হেটেছিলাম বহুদূরের পথ, সেই পথ আজ একা হাটতে হাটতে হয়েছে খুব পরিচিত। আমি আজ তার কাছেই অপরিচিত।’
‘সেই মেয়েটি কি আমার মতো ছিল?’
‘সেই মেয়েটির নাম তন্ময়ী। পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি লম্বা। লাবন্যময় গোলাকার মায়াবী চেহেরা। নিবিড় ভাবনা এবং চঞ্চলতায় যে ছিল সুহাসিনী। তার সবচেয়ে বড় পরিচয় সে আত্মত্যাগী।’
‘কে আপনি?’ এবার সেই মেয়েটির মনেও বইতে শুরু করলো ধমকা হাওয়া। অত্যন্ত উদ্বেগ জন্ম হলো তার মনে।
রনক মুখ থেকে মাস্ক সরালো। বাহিরে অন্ধকার নেমে এলো। ততক্ষণে গাড়ি এয়ারপোর্ট পৌছল।ল্যাম্পপোস্টের আলোতে রাস্তাগুলো নতুন রূপে সেজেছে। মেয়েটি কি বলবে, ভাষা হারিয়েছে। শুধু চোখ সড়ানো হয়েছে দায়। সে হয়তো কখনোই ভাবেনি, আবার হবে দেখা এই পথে, এইভাবে।
কয়েক মূহুর্ত পর, ‘কেমন আছো রনক?’
‘তন্ময়ী, আমি তোমায় কোন প্রশ্ন করবো না কেন তুমি হারিয়েছিলে। আমি জানতে চাইবোনা আমি কতটা যোগ্য ছিলাম তোমার জীবনে। কিভাবে আমায় ছেড়ে এতবছর ছিলে তাও জানতে চাইবো না। কতটা সুখে আছো বা ছিলে সেটাও জানতে চাইবো না। আমার কী অপরাধ ছিলো সেটাও জানতে চাইবো না। কখনো আমার কাছে ফিরতে ইচ্ছে হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নও তোমায় করবো না। শুধু একটা কথাই জানতে চাইবো, প্লিজ আমায় উত্তর দিবে?’
‘কোথায় থাকো এখন?’
‘তন্ময়ী আমায় উত্তর দিবে না?’
‘নিজের প্রতি এতটা সিরিয়াস কিংবা কেয়ারিং কখনোই ছিলেনা। খুব উন্নতি হয়েছে তোমার।’
‘সেদিনের মতো আজো এড়িয়ে যাবে, সেটাই সাধারণ বিষয়। একবার তোমার মুখটা দেখতে পারি?’
‘সহস্র মুখের লাবন্য আর তাদের রূপশ্রীতে আমার এ শুকনো বদনখানি খু্বই আপত্তিকর। গত পাঁচ বছর যাকে আমি ভেবে এসেছি একরকম, তার প্রতি আবেগপ্রবণ হয়ে কিছু সময়ের জন্য নিজেকে মোহে জড়িয়ে অন্য এক প্রতিমূর্তিকে মনে ধারণ করার কী কোন মানে হয়? কিন্তু তোমার এ পরিবর্তনে আমি ভিষণ অবাক হয়েছি এবং আত্মতুষ্টি অনুভব করছি। যেটা আমার চেষ্টাতে হয়নি সেটা অন্য কেউ খুব সহজেই করতে পেরেছে। সি ইজ আনডাউটেডলি বেস্ট কম্পানিয়ন ফর ইউর লাইফ।কেমন আছে সে?’
‘কে? কার কথা বলছো?
‘সাইরা ফারহা। যাকে তুমি প্রতিরাতে একটি করে মেইল করতে।সমস্ত পৃথিবীর ভাললাগা যার জন্যে তুমি পঞ্জীভূত করে রেখেছিলে। ইন্দোনেশিয়ার বালিতে যার সাথে তোমার সম্পর্ক হয়েছিলো। বালির প্রতিটা সুন্দর জায়গায় তোমাদের অসংখ্য স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। তোমার প্রটেকটেড পেনড্রাইভে অনেকগুলো স্ক্যাটচ রয়েছে সাইরার। তোমাদের বিয়ের কথা চলছিলো। সাইরা তোমার জীবনে পরিকল্পিত অস্তিত্ব। আমি তার কথাই বলছি।’
‘তন্ময়ী, সাইরা সম্পর্কে আর কিছু বলার আছে তোমার?’
‘আমি জানি রনক, সাইরা তোমার জীবনের স্পর্শকাতর একটি অধ্যায়।’
‘আমি এখন বুঝতে পারছি, যা পাঁচ বছর আগে বুঝতে পারি নি। তুমি শুধু আমার জীবন থেকেই হারিয়ে যাওনি, হারিয়ে দিয়ে গেছো আমার জীবনের কাছে আমাকে। কেড়ে নিয়েছো আমার মাকে আমার জীবন থেকে। এক বছর অন্ধকার কারাগারে কাটিয়েছি আমি তোমার জন্য। কিন্তু তা আমি কোনভাবেই বুঝতে পারতাম না, আজ তোমার সাথে দেখা না হলে।’
‘তোমার এই মেলোড্রামা, এখনো ভুলতে পারনি দেখছি।’
রনকের চোখ লাল হয়ে এলো। রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে তন্ময়ীর গালে চর মারলো। গাড়িতে সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো তাদের দু’জনের দিকে।
তন্ময়ী কোন সিনক্রিয়েট না করে, ভারী কন্ঠে বললো- ‘বলো, কী এমন করেছি আমি।যার জন্য তোমার এত কিছু হয়েছে বলে আমায় দোষ দিচ্ছ?’
‘আমার পড়াশোনা শেষ হবার আগে থেকেই আমি ফ্রিল্যান্সিং এ কাজ করে টাকা উপার্জন করতাম। কারন এ পৃথিবাতে একমাত্র আমার মা ছাড়া আমার আর কেউ ছিল না। মা আমার পড়াশোনার খরচ বহন করতো। একটা স্কুলে শিক্ষকতা করতেন তিনি। হঠাৎ তার কিডনিতে প্রবলেম হয়। চিকিৎসকরা টেস্ট করে জানান একটি কিডনি ড্যামেজড এবং অন্যটির অবস্থাও ভাল নয়। ডায়ালাইসিসের জন্য প্রতিনিয়ত তাকে চিকিৎসাধীন রাখতে হতো। কিন্তু বাবার রেখে যাওয়া সামান্য টাকা দিয়ে মাকে বাঁচানো সম্ভব হবে না বলে, আমি একটা বিদেশী আইটি কোম্পানির ভার্চুয়াল সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে কাজ করতাম। সেই সুবাদে প্রতিদিন আমি তাকে মেইল করতাম। কারণ তাদের কোম্পানীর যতসব আর্থিক লেনদেন এবং গুরুত্বপূর্ণ ডাটাবেস এর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কনফিডেনসিয়াল সফটওয়্যার আমি পরিচালনা করতাম।
বিভিন্ন সময়ে প্রজেক্ট হ্যান্ডওভার এবং কনফারেন্স বা প্রেজেন্টেশনের জন্য আমাকে ডিরেক্টলি তাদের সাথে এটেন্ড করতে হতো। সেজন্য আমি অনেকবার ইন্দোনেশিয়াতে যাওয়া আসা করি আর সাইরার সাথে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরাফেরা হয়। কিন্তু তারমানে এই নয়, ওর সাথে আমার সম্পর্ক ছিল। সাইরা সেই প্রতিষ্ঠানের একজন বিজনেস পার্টনার। সে একজন বাংলাদেশী। যে কারণে আমাকে খুব বিশ্বাস করতো। আমার সেলারিও বেশ ভাল ছিল, যা দিয়ে আমার মায়ের চিকিৎসা, আমার যাবতীয় সব খরচ চালাতে পারতাম। এছাড়া ধীরে ধীরে আমি অনেক উচু স্থানে চলে যেতে শুরু করেছিলাম। ততদিনে আমার পড়াশোনা শেষ হয়ে গিয়েছিল। অস্ট্রেলিয়াতে তাদের একটি আইটি কোম্পানি সফটওয়্যার ডেভেলপ করতো। আমাকে সেখানে নিয়ে যাবার সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছিল।
একদিন সাইরা তার ব্যক্তিগত কিছু স্ক্যাটচ আমায় মেইল করে। তা আমি মেইল থেকে ডাউনলোড করে পেনড্রাইভে প্রটেক্ট করে রাখি। আর ওই পেনড্রাইভের লকড পাসওয়ার্ড আমার ডাইরিতে লেখা ছিল। সে আমাকে যেসব স্ক্যাটচ দিয়েছিল সেগুলো সাধারণ হলেও এসবের মধ্যে ছিল কিছু কনফিডেনসিয়াল কোড। যা ট্রান্সফর্ম করে পেনড্রাইবে রাখা হয়েছিল। এই কোডগুলো ওদের কোম্পানীর বিভিন্ন লেনদেনের পিন নম্বর, যা সফটওয়্যারের মাধ্যমে পরিচালনা করা হতো। আমাকে শর্ত দেওয়া হয়েছিল যখন আমি সফটওয়্যার রান করবো তখন প্রতিটা স্ক্যাটচ সেখানে ইউজ করবো। ভার্চুয়ালি তা ট্রানজেকশনের ক্ষেত্রে সাপোর্ট দিবে। আর কোন ভাবে যদি তা কোন ডিভাইস থেকে ট্রানফার করা হয়, সেই মূহুর্তে কোন হ্যাকার এজেন্সি ওই ট্রানজেকশনের নোটিফিকেশন পেলে, সে সেই ট্রানজেকশন ডাইভার্ট করে নিতে পারবে।
আর ঘটনা সেদিকেই টার্ন করেছিল। তুমি যেদিন আমার বাসায় আসলে, আমি তোমায় দেখে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম। সেসবের প্রতি আমার খেয়াল ছিল না। তুমি এমন ভাবে আমায় ভালবাসতে শুরু করলে, যে ভালবাসার ছোয়া আমি জীবনে প্রথম পেয়েছিলাম। আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম তৃপ্ততার মহাসমুদ্রে। তোমায় বুকে জড়িয়ে কখন যেন আমি ঘুমিয়ে গেলাম। বিকাল পাঁচটার দিকে আমার ঘুম ভাঙল। আমি দেখতে পেলাম পাশের রুমে থাকা আমার ল্যাপটপটি অন করা, পেনড্রাইভ টেবিলের উপর এবং ডায়েরির পৃষ্ঠা এলোমেলো হয়ে পরে ছিল। তোমার না বলে চলে যাওয়াটা আমার কাছে খুব, অস্বাভাবিক লাগে নি। কারণ আমরা দু’জন প্রথম হঠাৎ করেই খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম। নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। হয়তো তুমি আমার ঘুম ভাঙলে আমায় দেখে লজ্জা পাবে, সেই ভয়ে চলে গেছো।
কিন্তু একবারের জন্যও আমি বুঝতে পারিনি, কিভাবে কী হয়ে হয়েছে। পরদিন সকালে ইন্দোনেশিয়া থেকে সাইরা আমায় ফোন দিয়ে বলে, কোম্পানীর দুই কোটি টাকা হ্যাকিং হয়ে অনত্র ট্রানজেকশন হয়ে গেছে। তখনো আমার মাথায় আসেনি কিভাবে কী হয়েছে। অনেক চেষ্টা করেও কোন ফল হয়নি। অন্যদিকে আমায় তারা সাসপেন্ড করলো। সেলারি একাউন্ট ব্লক হয়ে গেল।
মায়ের অপারেশনের ডেট এগিয়ে আসলো, কিন্তু অনেক টাকা বাকি পড়ে যাওয়ায় চিকিৎসা বন্ধ হয়ে গেল। আমার মায়ের চিকিৎসা করার জন্য বিভিন্ন স্কুল কলেজ, অফিস ও গাড়িতে আমি সাহায্য চেয়েছি। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। মা আমায় ছেড়ে চলে গেল। মায়ের মন নাকি সবই বুঝতে পারে। হয়তোবা সে অসুস্থ অবস্থায় আমার এমন পরিস্থিতি কিছুটা বুঝেগিয়েছিল। সেজন্যই দ্রুত আমায় ছেড়ে চলে গেল। অন্যদিকে একাকীত্বতা দূর করার জন্য হন্যে হয়ে খুঁজলাম তোমায়। তোমার কোন হদিস পেলাম না। বুঝতে পারলাম। তুমি হয়তো কৌতুহল থেকেই আমায় পরোখ করে দেখতে চেয়েছিলে, একদিনের জন্য। হয়তো তুুমি আমার থেকে বেটার কাউকে পেয়েছিলে, তাই চলে গেছো আমার জীবন থেকে।
কিছুদিন পরেই পুলিশ ওয়ারেন্ট আসলো বাসায়। কোর্টে হাজির হতে বলেছিল। হাজিরা দিতে যাওয়ার পর আমায় বন্দী করলো। কিন্তু এতে আমার কোন অনুতাপ ছিল না। কারণ তখন আমার জীবনের কোন কিছুর প্রতিই আমার কোন ভাবনা ছিলনা। একবছর পর জেল থেকে মুক্তি পেলাম। নতুন পথে নতুন পরিকল্পনায় বাঁচতে শুরু করলাম।’
তন্ময়ীর চোখ দিয়ে অঝড়ে পানি আসতে লাগলো। তন্ময়ী এখন নিজেই জানে না সে কতটা অপরাধী। আসলেই কী তন্ময়ীর কারণেই সব ঘটেছে? তন্ময়ী কী আসল অপরাধী?
তন্ময়ীর গলা দিয়ে কথা আসছেনা, তবুও একপ্রকার জোর করেই বলল ‘ আমি জানি আমি অনেক অপরাধ করেছি, কোন রকম অনুতপ্ততাই এর বিপক্ষে যথেষ্ট না। হ্যা এটা সত্যি তোমার কিছু মেইল আমি পড়েছি। ডায়েরীর পাতায় একটা কোড লেখা দেখে আমার কৌতুহল হয়, আর আমি পেনড্রাইভে কী ছিল তা দেখেছি। কিন্তু কিছু কথা নাইবা হলো বলা। না হয় বাকি জীবনটা নিজেকে সেই পরিচয়েই কল্পনা করবো, যেমনটা তোমার কাছে এখন আমার পরিচয়। ভাল থেকো, আমায় গাড়ি থেকে নামতে হবে।’
তন্ময়ী একবারের জন্যও আর পিছন ফিরে তাকালোনা। হয়তোবা সেটা আর প্রয়োজন নেই। ফিরে যাবার জন্যই যে দেখা দিয়েছিলো, তার প্রতি ফিরে আসার মিনতি করা কোন স্বাভাবিক ভাবনা নয়। দ্রুত গতির চলন্ত গাড়িতে একটা নিবিড় ধমকা বাতাস এসে রনকের ভাবনাকে যেন ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। দু’চোখ বন্ধ করে বাতাসের সাথে মনের ভাবনাগুলোকে উড়িয়ে দেবার অভিপ্রায়। রনক ভাবতে চায় না তন্ময়ী এমন কাজ করেনি। কিন্তু কৌতুহলের দেয়াল টপকাতে পারছেনা রনকের বিবেক। নিজে নিজে ভাবছে, আমি কী মিথ্যা অপবাদ দিলাম নাতো। যে ভাবনারা ভেসে গিয়েছিল ধমকা হাওয়ায়, সেই ভাবনারাই হয়তো রনকের বিবেককে আবার তাড়িত করতে হন্নে হয়ে লেগেছে।
বাসায় ফিরে রনক মোটেও স্বস্তিবোধ করতে পারলোনা। বুকের ভিতর একটা শূন্যতার হাহাকার ধূমরে-মুচরে ওঠতে শুরু করলো। এর পিছনে কী কারণ রনক ততক্ষণে অনুধাবণ করতে পারলো। যে সুধা পান করলে চির অমরত্বের নেশা জাগে, সে সুধার নেশা কাটানো এত সহজ কাজ নয়। দীর্ঘ পাঁচ বছর যে অনুভূতি ভুলে থাকার প্রবল চেষ্টা, সেই সুখ-মূহুর্তের স্মৃতি অম্লান হবার কথা থাকলেও তা কেবল এক মূহুর্তের জন্য শতগুণে বেড়ে গেলো। এ যেন এক নিরুদ্দেশ পথিকের অভুতপূর্ব গন্তব্য। আনমনা হয়ে দীর্ঘ পথ হাটার পর হঠাৎ করেই যেন সে অনুভব করলো তার পা মরুভূমির চোরারাবালিতে আটকে যাচ্ছে। তার দ্রুতপথচলা যেন হয়ে এলো মন্থর।
জীবনের যে স্পনটেনিটি, তা যেন ক্রমেই হয়ে এলো স্থবির। অতিদূরের কোন এক কান্ট্রি সং এর সুমধুর সুর এসে কানে বাজতে লাগলো। সেই সুর ধরে যতই হাটা হবে তা ততই দূরে মিলিয়ে যাবে। কিন্তু তার নাগাল পাবার আকাঙ্ক্ষাও যে ব্যাকুল হয়ে ওঠছে। সেই সুর যেন কানের কাছে আলতো করে এক শূন্যতার অনুভূতিকে জাগিয়ে তুলছে। রনক ভাবছে, ‘একী প্রকৃত পক্ষেই মনের অগোচরে বয়ে যাচ্ছে, নাকি আমি নিজেই খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে এর প্রভাব বাড়িয়ে তুলছি। নাকি আমার অস্তিত্বের এক অনাকাঙ্ক্ষিত অস্থিরতা, যার থেকে আমি পালিয়ে বেড়াতে চাইছি।’
পরদিন সকালে হঠাৎ দরজায় কড়া নড়ছে। রনক কিছুটা চমকে উঠলো। তার দরজার সামনে দাড়ানো একটা ছেলে। সে আর কেউ নয়, তার ভার্সিটির বন্ধু ধ্রুব। অনেক দিন পর দেখা।
‘কীরে ধ্রুব, কেমন আছিস? আমার বাসা খোঁজে পেয়েছিস কিভাবে?’
কিছুটা ধীর গলায় ধ্রুব উত্তর দিল, ‘ভাল আছি। গতকাল সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফিরেছি। আর বাসা খোঁজে পাওয়া আমার জন্য খুব কঠিন কাজ না।’
‘আয়, বস।’
ধ্রুব ড্রইং রুমে বসে দেয়ালে ঝুলানো রনকের মায়ের ছবির দিকে এক পলকে তাকিয়ে রইলো। রনক বলল, ‘কীরে, কী দেখছিস?’
ধ্রুব’র চোখের কোণে জল ছলছল করছে। এক অসহায় চাহনিতে তাকিয়ে আছে রনকের দিকে। রনক ধ্রুব’র কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘ধ্রুব, তুই কী কোন সমস্যায় আছিস? তোর চোখে জল কেন?’
‘রনক, আমি গতকাল জানতে পেরেছি, খালা আম্মা আর নেই। তোর মা তো শুধু তোর মা ছিলো নারে। সব সময় বলতো আমার দুইটা ছেলে, রনক আর ধ্রুব। একবার কি হয়েছে জানিস? বাবা অসুস্থ ছিল, মা আমার হাতে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছিল বাবার জন্য ঔষধ কিনতে। কিন্তু পথে আমার টাকাটা ছিনতাই হয়ে যায়। দুঃচিন্তা আর মনের কষ্ট নিয়ে তোর সাথে দেখা করতে আসি। খালা আম্মা আমার চেহেরা দেখে বলছিলো-কীরে বাবা, কী হয়েছে তোর? তখন আমি কিছু লোকাতে পারিনি। আমার এ কথা শুনে উনি তোর পরীক্ষার ফি এর টাকাটা বের করে দিলো।
আর বলল আমি যেন একথা তোকে না বলি। নিজের হাতে খাবার খাইয়ে দিল আমায়। আমার খুব মনে পড়ছে খালা আম্মার চোখ দু’টো। কী মায়াবী চাহনি! হাসলে গালে টুল পড়তো আর চোখজোড়া খুবই উজ্জল হয়ে ওঠতো। আমি কী করে পারলাম এমন কাজ করতে?’
রনক অবাক হয়ে ধ্রুব’র দিকে তাকালো। ধ্রুব রনককে বুকে টেনে নিয়ে বলল, ‘দুস্ত তুই আমাকে ক্ষমা করে দে। আমি ভীষণ অপরাধী।’
‘কী বলছিস পাগলের মতো। তুই কেন অপরাধ করতে যাবি? আমার মা তো অসুস্থ হয়ে মারা গেছে।’
‘হ্যা অসুস্থ ছিল এটা ঠিক। কিন্তু সেই মূহুর্তে তোর যে সংকট ছিল তা না থাকলে হয়তো খালা আম্মাকে এতো তাড়াতাড়ি হাড়াতে হতো না।’
‘আমার সংকটের কথা তুই কী করে জানলি? একথা তো কারো জানার কথা নয়।’
‘হ্যা, আমি জানি। আমি সব জানি। এমনকি তোর থেকেও বেশী জানি। সেকথা বলতেই আজ এখানে এসেছি। আমার কথা শুনার পর তুই আমায় দিতে চাস আমি তাই মেনে নেব।’
‘কী বলছিস, তোকে কেন শাস্তি দিবো? তুই কী করেছিস?’
এরপর ধ্রুব সবকিছু খুলে বলল রনককে। ধ্রুব এবং রনক একই বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছে। একধরনের নিরব প্রতিযোগিতা তাদের মধ্যকার বিদ্যমান ছিলো। কিন্তু কেউ কাউকে সে ব্যাপারে বুঝতে দিত না। দাবার চাল দিতে গিয়ে যেমন প্রত্যেকেই নিজের সম্ভাবনাকে এগিয়ে রাখে আর প্রতিপক্ষকে দূর্বল ভাবে, তেমনি তাদের ভিতরেও তেমন এক চিন্তা কাজ করতো। খেলার চরম প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যখন কেউ কাউকে হারাতে পারছিলনা, তখন প্রতারণা করাই ধ্রুবের কাছে একমাত্র উপায় হয়ে দাড়িয়ে ছিল।
রনক বলল, আত্মপ্রতিষ্ঠিত হয়েও আমি তোর স্ট্রাগলিং সাক্সেসকে মেনে নিতে পারছিল না। আমি তোর সকল কাজ সম্পর্কে জানতাম। তুই যখন আমায় তোর কাজ সম্পর্কে আমার সাথে গল্প করতিস তখন থেকে আমি সব ধরনের কার্যক্রম ফলো করতাম। একদিন তোর কম্পিউটার থেকে ফাইন্যান্সিয়াল ট্রানজেকশন সম্পর্কিত কিছু ডাটা হ্যাক করেছিলাম। যা তুই বুঝতে পারিস নি। যেহেতু খুব স্ট্রং সিকিউরিটির মাধ্যমে তুই সবকিছু তত্ত্বাবধান করতিস, তাই হ্যাকিং স্পেশালিস্ট হয়েও আমি স্বার্থ উদ্ধার করতে পারছিলাম না।
দীর্ঘদিন ধরে আমি একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। একদিন তন্ময়ীকে তুই আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলি। কিছুদিন পর একটা শপিং মলে তন্ময়ীর সাথে আমার দেখা হলো। তন্ময়ী আমার কাছে তোর সম্পর্কে জানতে চাইলো। তুই কিছুদিন ধরে ওকে এড়িয়ে যাচ্ছিস এমন অভিযোগ ছিল তার। সে বলল শুক্রবার তোর বাসায় যাবে। সেদিন আমি তোদের চমকে দেবো বলে তোর বাসায় গিয়েছিলাম। দরজায় নক করে সাড়া না পেয়ে লকার টেনে দেখলাম দরজা খোলা। রুমের ভিতর ঢুকেই বুঝলাম তোরা পাশের রুমে দরজা বন্ধ অবস্থায় ছিলি। আর এই মূহুর্তে তোর ল্যাপটপ অন করা ছিল আর এরই সাথে সাথে টেবিলের উপর ডায়েরির খোলা পাতায় দেখলাম পেনড্রাইভের পাসওয়ার্ড লেখা দেখে পেনড্রাইভ থেকে অতিদ্রুত স্ক্যাটচগুলো আমার পেনড্রাইভে ট্রান্সফার করে নিয়ে আসি।
পরের দিন সফলভাবে আমি দুইকোটি টাকা সিঙ্গাপুরে বসবাসরত আমার খালাতো ভাই অর্নবের অ্যাকাউন্টে ট্রানফার করে দেই। পনের দিনের মধ্যে সে আমার সিঙ্গাপুর যাওয়ার সব ব্যবস্থা করে ফেলে। কিন্তু আমি তোকে নিয়ে কিংবা খালা আম্মাকে নিয়ে একটিবারও ভাবিনি। কেবল নিজের লোভ এবং প্রতিহিংসায় আমি মজে ছিলাম।
অন্যদিকে সিঙ্গাপুর পৌছানোর কিছুদিন পর তন্ময়ীর সাথে আমি কানেকটেড হই। তন্ময়ী একদিন আমায় বললো, ওর বাবা-মা ওকে একটি ছেলের সাথে জোরপূর্বক বিয়ে দিয়েছে। কিন্তু যেদিন বিয়ে হলো সেদিন রাতেই সে পালিয়ে খাগড়াছড়িতে চলে যায়। সেখানে সে একটি স্কুলের চাকরি নিয়ে একা একা জীবন যাপন শুরু করেছে। সে বারবার তোর জীবনে ফিরে আসতে চেয়েছিল, কিন্তু তোকে ঠকানো হবে বলে সে আর তোর সাথে কোন যোগাযোগ রাখেনি।
No comments:
Post a Comment
Thanks for your comment