Saturday, May 26, 2018

ফিরে যাই সেই পথে


ফিরে যাই সেই পথে
মোঃ অলিউল্লাহ্

মানুষের জন্মের পর তার স্বতন্ত্র আত্মপ্রকাশের জন্যই হয়তো নাম রাখাটা জরুরি হয়ে পড়ে। আমরা সাহিত্যে যেমন কোন সৃষ্টিকর্মের নামকরণের সার্থকতা খোঁজার চেষ্টা করি, তেমনি একটা মানুষের সমস্ত জীবনের কৃতকর্মের পর কি তার নামকরণের সার্থকতা যাচাই করার চেষ্টা করি। আমি জানি কথাটা ইররেশনাল। তবুও কিছু মানুষকে বলতে দেখি তোমার নাম অমুক? আচ্ছা। তোমার নামের অর্থ তো ‘এই’। ধরা যাক আমার নাম নিরব। উনি হয়তো আমার কাছ থেকে উনার অবচেতন মন থেকে আশা করবেন আমি সব সময় শান্ত বা চুপচাপ থাকবো। কিন্তু উনি আমার দুরন্তপনা দেখে কি সামান্যও বিচলিত হবেন না? 

আর যদি হয়েই যান, তাহলে হয়তো আমি ইররেশনাল নই। আর হলেও সেটা পারশিয়াল। বাবা-মা হয়তো কিছু একটা চিন্তা করেছিল আমার নাম প্লাবন রাখতে গিয়ে। আমি যখন থেকে বুঝতে শুরু করেছি নামটা আমার কাছে ঠিক মন্দ লাগে নি। যাক, সেসব কথা।

কিছুদিন আগেই আমার এ শহর ছেড়ে দেবার নোটিশ আসলো আমার কাছে। আমার বড় ভাই রুবায়েত হোসাইন আমায় নিয়ে বেশ চিন্তিত। আসলে নিজের কাছ থেকে ছ’মাসের জন্য ছুটি নিতে চাই। বাড়িতে জানিয়ে দিয়েছি, আমার এ দীর্ঘ শিক্ষাজীবনে আমি কিছু শখ কিংবা ইচ্ছা পূরণ করার ব্রত করেছিলাম। কিন্তু লেখাপড়ায় একটু বেশী সিরিয়াস হওয়ায় সেটা হয়ে ওঠলোনা। আর পড়াশোনা শেষ করতে না করতেই কর্মজীবনে পা রাখলাম। অর্থের মোহ বড় লোভনীয়। 

একবার এর ঘ্রান পেলে বাতাসের সাথে নাক খাড়া করে নিশ্বাস নিতে নিতে সেই অর্থের উৎস পর্যন্ত পৌছানো চাই। কয়েক বছর চাকরি করে খুব একঘেয়েমি আমায় পেয়ে বসল। নিস্তার চাই এ বিপদ থেকে। বাসায় জানিয়ে দিলাম, আমি জানি ভবিষ্যত অনিশ্চিত হতেই পারে। কিন্তু আমি জীবন  থেকে আমার সুপ্ত ইচ্ছাগুলো পূরণ করতে ছয় মাস সময় নিচ্ছি। আর এই কয় মাস আমি কোন পার্থিব সার্থ হাসিলের দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকবো। 

বড় ভাই ফোন দিয়ে বলল, দেখ প্লাবন আমরা মধ্য বিত্ত ফ্যামিলির মানুষ। আমাদের শখ, ইচ্ছা, স্বাদ-আহ্লাদ, কামনা-বাসনা সীমাবদ্ধ। এর সীমা অতিক্রম করা কি খুব সচেতন সিদ্ধান্ত হবে বলে তুই মনে করিস?

আমি বললাম, প্রথাসিদ্ধ কিছু দায়িত্বের নাম করে সারাজীবন নিজেকে একটা চলমান মেশিন করে রাখা কি খুব আত্মপ্রসন্নের উদাহরণ মনে করেন? গতানুগতিক জীবন ধারার বাইরেও একটা জীবন থাকতে পারে। যুগে যুগে এ পৃথিবীর সিংহভাগ মানুষ যখন তাদের কর্মব্যস্ততা নিয়ে দিন-রাত অতিক্রম করে একটা সময় আপন চোখের সামনে জীবনের নিঃশেষ হয়ে যাওয়া অবলোকন করেছে, তারা কি একটি বারের জন্যও আফসোস করে বলেনি, কি দরকার ছিলো সারাজীবন খাটাখাটনি করে? অথচ মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ তাদের রীতি অনুসরণ না করে এ পৃথিবীর কিছু অকম্মা সম্বোধন (বায়ুন্ডুলে, ছন্নছাড়া, সন্ন্যাসী, ফেরারী ইত্যাদি)  গ্রহণ করে জীবন কাটিয়ে দিয়েছে। শ্রেফ তারা দায়িত্বশীলতার গুরুত্বটা ঠিক মেনে নিতে পারেনি অথবা সযত্নে এর গুরুত্বকে অবহেলা করে গেছেন। আমি তাদের মতো সারাজীবন এরকম থাকতে চাই না। অবশ্য পারবোও না।

বড় ভাই সব সময়ই কথা বলার শুরুটা করতেন শান্ত গলায়। অনেক কিছু বোঝাবার চেষ্টা করতেন। ভাবতেন যা বুঝাবেন আমি শ্রদ্ধাবোধ দেখিয়ে তা নিরবেই মেনে নেব। আফটার অল আমি তো লেখাপড়া জানা ছেলে, খুব সহজে কথার অবাধ্য হতে পারবো না। কিন্তু আমি কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে সেটা ভুল হলেও না করে শান্তি পাই না। আর আমার কিছু যুক্তি উনার কাছে যুক্তিসঙ্গত হলেও সেটা আমার অবাস্তবতা বলে আমাকে বাস্তবে ফিরে আসতে আহ্বান করে। কিন্তু সফল হতে পারেনি বলে শান্ত গলা কিছু টা অশান্ত হয়। আমার কাছে সেটা ভালই লাগে। আমার ভাই বলে তাকে সব সময় শান্ত থাকতে হবে কেন?

বাসাবো কালি মন্দির এর সামনে একটা বিশাল পুকুর। এমন বড় পুকুরকে আমাদের গ্রামে বলে দিঘি। এখানে বলা কিনা তা ঠিক জানি না। পুকুরের পশ্চিম পাড়ে একটি বড় বটগাছ। এর শিকড়গুলো যেনো গাছের চিকন ডালে বসে থাকা পাখির পায়ের নখ দিয়ে যেমন খামচি কেটে ধরে রাখে তেমনি মাটিকে আকড়ে ধরে রাখে। দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে উঠেছি, মেনে নিয়েছি পরাজয়। বটগাছটার নিচে একটা বেঞ্চিতে বসে ছিলাম। দু’চোখের জলগুলোকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম এই বলে যে, যেখানে প্রতিদিন বিকালে এসে বসে থাকতাম নিরবে, ইচ্ছেমতো কাঁদতাম আর এই মস্তবড় পুকুরটার জলে নিজের প্রতিমূর্তি দেখে মুচকি হাসতাম তার সাথে তো দেখা হয়ে গেল আবার। প্রায় আট বছর আগের স্মৃতিগুলো। জায়গাটার সাথে শেষ দেখা সাত বছর আগেই হয়ে যাওয়ার কথা ছিল।

বাসাবোর বাগানবাড়ির একটা ভবনের চারতলার দিকে একবার তাকিয়ে দেখেনিলাম। জানিনা কারা এই ছোট্ট তিনটা কক্ষে বসবাস করছে। শহুরে জীবনের প্রথম অস্থায়ী আবাসস্থল ছিল এখানেই। গলির মোড়ের সেই দোকানটা আর নেই। যে প্রতিদিন আমায় ডালপুরি আর সিংগারা খুব যত্ন করে পরিবেশন করতো। বাসার পিছনের সেই কলাবাগানটাও নেই আর। ঢাকায় যখন প্রথম আসবো, বড় ভাই বলে ছিল- ‘তোর জন্য বাসা দেখেছি, বাসাবোর বাগানবাড়ীতে। স্থানটির কথা বলার সাথে সাথে একবার এর ম্যাপটাকে ইমাজিন করে নিলাম। নিশ্চয়ই এখানে অনেকগুলো বাগান আর কয়েকটা ঘর। আর সেখানেই হয়তো আমি থাকতে যাচ্ছি। প্রথম যেদিন রিক্সায় করে এসেছিলাম, চারিপাশে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে লাগলাম বাগান কোথায়। খোঁজ মিলেনি বাগানের।

গ্রাম থেকে এসেছি। গ্রামীন পরিবেশকে ভাবা হয়তো আমার কাছে স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। কিন্তু আমার গ্রামীন মনোভাব ও কথাবার্তা শুনে আমার রুমমেট ও দু’য়েকজন নতুন বন্ধুর ভ্রু-কুচকানো আমার মনে নাড়া দিলেও নিজেকে পাল্টে ফেলার মতো চটপটে আমি কোন কালেই না। রুমমেট বড়ভাইকে একদিন লজ্জা না রেখে বলেই ফেললাম, ভাই বাগানবাড়ির বাগানটা কোথায়?

বড়ভাই একবার আমার দিকে তাকালেন, নিজে যতটুকু না মেধাবী তার থেকে বেশী ভাবমূর্তি নিয়ে আমায় বোঝাতে শুরু করলেন। আজকালের ছেলে হলে ওনার কথাগুলো এককান দিয়ে ডুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দিতো।মনে মনে বিরক্ত হতে থাকতো আর দু’একটা বকা দিতেও কৃপণতা করতো না। কিন্তু রীতিমোতাবেক মোস্ট ওবেডিয়েন্ট পিউপিলের মতো গভীর মনোযোগে ওনার কথাগুলো শুনে গেলাম। ওহ, সরি ওনার পরিচয়টা দেয়া হয়নি। ওনার নাম লিংকন। প্রথম যখন শুনেছিলাম, তখন থেকেই অংক করতে শুরু করে দিয়েছিলাম- লিংকন কারো নাম হতে পারে। আমি ইতিহাসে বরাবরই মাথামোটা ছিলাম। তাই উচ্চমাধ্যমিকে ইতিহাস মুখস্ত করতে করতে মাথা গরম হয়ে যেতো, কোন রকম পরীক্ষার খাতায় বমি করে ফেললে এরপর আর তা মাথায় থাকতো না। তবুও একটা নামের সাথে মিল পেয়ে গেলাম। আব্রাহাম লিংকন নামটা শুনেছিলাম, আর ওনি একজন বিখ্যাত ব্যক্তি এতটুকুই ধারণা ছিল আমার। হয়ত লিংকন ভাইয়ের বাবা-মা ওই ব্যক্তির নামটিই নকল করেছেন।

যাই হোক, ওনি ততক্ষণে আমার আপাদমস্তক অবজারভ করে নিয়েছেন। আমায় বললেন ‘ঢাকায় এমন অসংখ্য জায়গা আছে সেসব জায়গার নামগুলো একটু পিকুলিয়ার।’ মোস্ট ওবেডিয়েন্ট হয়ে ভালই হয়ে ছিল। একটা ওয়ার্ড শেখা হলো ওনার কাছ থেকে। বলার সাথে সাথেই প্রশ্ন করলাম ভাই, পিকুলিয়ার কি? উচ্চমাধ্যমিকে কিং লিয়ার নামে একব্যক্তির কথা পড়েছিলাম।ওই ব্যক্তির ছোট ভাই নাতো?

গম্ভীর মানুষের হাসি যে কতটা বিরক্তির হয় সেটা তখন ওনার হাসি দেখে বুঝে ছিলাম। আমার কথা শুনে খুব মাস্তি করে হেসে নিলেন। তারপর একপায়ে ভর করে একহাতে দেয়ালটা ধরে আমায় আবার জ্ঞান বিতরণ করতে শুরু করলেন। ‘শুন, পিকুলিয়ার মানেটা তা নয়। আজই ডিকশনারীতে দেখে নিবে বুঝছো?’

মাথা নেড়ে, জ্বি ভাই বুঝছি।

‘তারপর শুন, ঢাকা শহরের কিছু জায়গার নাম বলি। নীলক্ষেত, খিলক্ষেত, কচুক্ষেত, হাতিরপুল, ধোলাইখাল, ভূতেরগলি ইত্যাদি এমন আরো অনেক জায়গার নাম রয়েছে। তাই বলে সেখানে আসলে বস্তুগত কোন কিছু নেই। বুঝছ ব্যাপারটা?’

জ্বি ভাই বুঝছি। পরের দিন সকালে যখন ঘুম থেকে ওঠলাম, বারান্দায় দাড়িয়ে সেই কলাবাগানের দিকে তাকিয়ে রইলাম অনেকক্ষণ। হঠাৎ মাথায় এলো আরে এটা তো একটা বাগান। দৌড়ে গেলাম লিংকন ভাইয়ের কাছে। ওনি অনলাইনে সারারাত আউটসোর্সিং এর কাজ করতো। আর প্রতিদিন সকালে ঘুমাতে যেত। তখন ঘুমাতে যাওয়ার কথা। আমি ওনাকে গিয়েই বললাম, ভাই আপনি মিথ্যা কথা কইলেন ক্যান। আপনি না কইলেন বাগান বাড়িতে কোন বাগান নাই? ঐ তো আমাদের বাসার পিছনে একটা বাগান। (ওনি রক্তচক্ষুতে আমার দিকে তাকালেন। আমি গলার স্বরটা চ্যাঞ্জ করে একটু ডাউন করে বললাম) একটা কলা বাগান।

সাথে সাথেই মারলো এক ধমক। ‘ফাজলামি করো আমার সাথে। তুমি না এডমিশন টেস্ট দিতে আসছো ঢাকায়, যাও পড়তে বস গিয়ে। কমন সেন্স নাই, কখন কার সাথে কিভাবে কথা বলতে হয়?’ আসলেই হয়তো তখন আমার কমনসেন্স খুব কম ছিল। আর তাইতো সাথে সাথে করলাম আরো একটি প্রশ্ন, ‘ভাই কমনসেন্স কি?’ (ভাবছেন, ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেওয়া একটা ছেলে কমনসেন্স মানে জানে না। আসছে ডপ দিতে। সত্যিই জানতাম তখন। আর শুধু এই শব্দ কেন ইংরেজি খুব অল্প শব্দের অর্থই আমি জানতাম। কারন ছোটবেলা থেকেই অংকে ও ইংরেজিতে বহুবার ওইটা পেয়েছিলাম।পরসমাচার) তো আর কি আরো একটি ধমন জুটলো। মুখটা একটু কালো করে, মন খারাপ করে চলে আসলাম ওনার সামনে থেকে। 

সকালটাই শুরু হয়েছিল মন খারাপ দিয়ে। বাসা থেকে বের হলাম কোচিং ক্লাসে যাবো বলে। বাড়ি থেকে আসার সময় মা একটা মোবাইল কিনে দিয়েছিল। চাইনিজ মোবাইল। ক্যামেরা ছিল, অডিও-ভিডিও গানও শোনা যেত মোবাইলটাতে। খুব ভাল না হলেও তখনকার যে দাম ছিল তাই দিয়ে এখন যেমন- তেমন একটি এনড্রয়েড সেট তো কেনাই যাবে। তো বাসাবো পৌছে, গাড়িতে ওঠার অনেক চেষ্টা। যতগুলো গাড়িই আসে স্টেশনে হাউজফুল হয়ে। তারপর আর ধাক্কাধাক্কি করে ওঠা হয়না আমার। একটা তুরাগ আসলো, ওঠার চেষ্টা করলাম। পারলাম না। 

সময় দেখার জন্য পকেটে হাত দিয়ে মোবাইলটা বের করতে গেলাম। হাতটাই শুধু বের হলো। আর কি যা হবার তাই হলো। সেদিন আর যেতে ইচ্ছে করলোনা কোচিং এ। বাসায় গিয়ে বাচ্চাদের মতো অনেকক্ষণ কেঁদে নিলাম। খুব মায়া হচ্ছিল ফোনটার জন্য।

বিকাল বেলায় লিংকন ভাই বাসায় আসলো। আমায় দেখলো ফ্লরে বসে আছি, মন খারাপ করে। এছাড়া সকালে উনি বকা দিছে তাই গায়ে পরে কথা বলতে গেলাম না। বলতে গেলে যদি আবার সকালের মতো বলে যে তোমার কমনসেন্স নাই। ওনি কাছে এসে আমায় বলল ‘ওই কি হইছে? মন খারাপ ক্যান? সকালে বকা দিছি তাই?’ মাথা নেড়ে বললাম- না।

‘তাহলে কি হয়েছে? চল কালিবাড়ি যাই, হেটে আসি।’
না ভাই, যাবো না। ভাল লাগছেনা।
‘আরে চলো, হেটে আসলে ভাল লাগবে।’
মনে মনে ভাবলাম, তাইতো বাসায় বসে বসে মন খারাপ করে কোন লাভ আছে?
বের হলাম। এই বটগাছটার নিচে বসে ওনাকে বললাম, ভাই আপনি ঠিকই বলেছেন আমার না কমনসেন্স নাই।
‘তুমি না কমনসেন্স মানে জানো না?’

এখন জানি ভাই। আমার মোবাইলটা পকেটমার হয়েছে। এরপর বাসায় এসে ডিকশনারী থেকে শব্দটা পড়েছি। আমার দিকে মায়াচোখে তাকালেন ওনি। আর একটা গল্প বললেন। বাসাবোতে একটা মসজিদ আছে, মদিনা মসজিদ নামে। তো গল্পটা ছিল এমন- এক ভদ্রলোক রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছিলেন। অন্য একব্যক্তিকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করেন, ভাই মদিনা মসজিদটা কোথায়? তো দ্বিতীয় লোকটি উত্তর দিলো, সামনে গেলেই বাজার। প্রথমজন বললেন ও আচ্ছা সামনে গেলেই মসজিদ? দ্বিতীয় লোকটি, মাথা নেড়ে বলল- হ্যা ভাই সামনে গেলেই বাজার।

লিংকন ভাইয়ের গল্পের মাথামুন্ডুটা প্রথমে বুঝলাম না। একটু ভেবে নিয়ে তারপর বুঝতে হলো। মনখারাপ সত্ত্বেও হাসতে হলো। আসলে ওই দুইজনই ছিল বধির। প্রায় এভাবেই অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই জায়গাগুলোতে। নেহাত এই শহরটা কে বিধায় জানাতে শহরের অবস্থান করা সবগুলো জায়গায় ঘুরে বেড়ানো বায়না নিয়েছি একসপ্তাহের জন্য। এক সপ্তাহের আজই প্রথম দিন। সাতদিন পর চিরদিনের মতো চলে যাবো এই মহানগরীকে ছেড়ে। আর ফিরবোনা এখানে। 

সাত বছর আগে যখন মনস্থির করেছিলাম চলে যাবো, এই লিংকন ভাই আর শিমুল ভাই আমায় যেতে দিলনা। ঢাকায় বাস্তবতা দেখার টিকিটটা কেটে দিয়েছিল এই দুইজন ব্যক্তি। আজ ওনাদের কারোরই কোন হদিস আমার কাছে নেই। তথ্যপ্রযুক্তির যুগ হলেও তাদের সাথে কোন যোগাযোগ নেই আমার। শুধু তাদের স্মৃতিগুলো বুকে ধারণ করে রেখেছি। 

একটি বিষয় সকলের কাছেই প্রশ্নের তৈরী করবে, যে কেন আমাকে সাত বছর আগেই চলে যেতে হত। অসামান্য আত্মবিশ্বাসকে পুঁজি করে যখন ফ্যামিলির অন্য কারো জ্ঞানের সীমা পেরিয়ে ভাগ্যান্বেষণে পারি জমিয়ে ছিলাম, ধরেই নিয়ে ছিলাম আমার উচ্চ শিক্ষার ইচ্ছাটা পূরণ হবে। মেধা আর জনসংখ্যাবহুল এদেশে যেকোন ক্ষেত্রেই বেশ প্রতিযোগিতা করে স্থান দখল করে নিতে হয় এটা কারো অজানা নয়।

কিছু পারিপার্শ্বিক সমস্যা আর অর্থনৈতিক দুঃভাবনার পাশাপাশি মানসিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াই হয়তো সেখানে আমার ব্যর্থতার মূল হোতা হিসেবে কাজ করেছিল। শেষ পর্যন্ত টিকে থাকার পাল্লাটা উচুতে ওঠে গেল। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষায় ভাল প্রতিযোগীর পরিচয় দিতে আমি পারিনি।

তবুও দুঃসাহস করেছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয়েই হবে আমার অধ্যয়ন। একটা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়। একটা পরীক্ষায় অংশ গ্রহণের পরেই টানাপোড়ন শুরু হলো। সমাপ্ত হলো আমার ভাবনার পরিসর। সবকিছু গুছিয়ে পরদিনই ছাড়বো এ শহর। সবাইকে বিদায় জানাতে গিয়েই তাদের কয়েকশত পরামর্শ মেনে নিতে চাইলাম। আমাকে দিয়ে ঘুরে দাড়ানোর কাজটা কখনো হয়না। কিন্তু কেমন যেন একটা ইলিয়শনে ছিলাম কিনা জানি না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা কলেজে মোটামোটি একটা বিষয়ে চান্সও হয়ে গেল। কেমনে কী! যদিও সেখানে পড়ার মত অযোগ্য নিজেকে ভাবিনি কখনো। নিজের সাথে কিংবা দুঃসময়ের সাথে শুরু হলো একধরনের স্ট্রাগল। থেকে গেলাম।

কাল যাবো আমার দ্বিতীয় অবস্থানস্থলে। এভাবে সাতটা দিন শেষ করে, ফিরে যাবো আমার নতুন গন্তব্যে। 

আজ শুক্রবার জৈষ্ঠ্যের সকাল। তীব্র গরম হওয়ার কথা থাকলেও কয়েকদিন ধরেই অনিয়মিত বৃষ্টি। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির পানে হাত বাড়িয়ে দিয়ে অনুমান করে নিলাম ঠিক কতদূর পর্যন্ত যাওয়া যাবে। এমনিতেই অ্যালার্জির প্রকোপ। যে বৃষ্টিতে ভেজা এক সময় শখের বিষয় ছিল তা আজকাল বড় বিপদের কারন হয়ে দাড়িয়েছে। ঘন্টা খানেক বারান্দায় দাড়িয়ে বাহিরে প্রকৃতিটাকে প্রেডিক্ট করে নিলাম। বৃষ্টি কমে এলো। যাবো আমার দ্বিতীয় আবাস্থলে। ইব্রাহিমপুর, ফরিকবাড়িগলি। একমাসের জন্য জায়গা পেয়েছিলাম সেখানে। একটা অাকাঙ্ক্ষিত অধ্যায় শুরু করতে গিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে তা শুরু হয়ে গিয়েছিল।

দ্বিতল ভবনের নীচতলায় ৫/৬ টা ছোট ছোট কক্ষ। পশ্চিম পাশের একটা কক্ষেই আমি থাকতাম। ভিতরটা অন্ধকারে আবদ্ধ। প্রায় ১৫ জনের বসবাস ছিল সেই কক্ষগুলোতে। আর সকলের জন্য বরাদ্দ ছিল একটি ওয়াশরুম এবং একটি কিচেন। অর্থাৎ যারা মেস বাসায় থাকেন তাদের কে আর বুঝিয়ে বলার কিছু নেই। একটি ছেলে, যে কিনা আমার রুমমেট ছিল। আমার বন্ধু তার সম্পর্কে বেশ প্রশংসা করেছিল। আর যেহেতু আমার জরুরী ভিত্তিতে একটি সীট দরকার ছিল, সে মুহুর্তে ও খুব বড় একটা সাপোর্ট দিয়েছিল।

ছেলেটি আরো দুইটি মেস এর দায়িত্ব চালায়। এভাবে নাকি তার চলে যায়। যাহোক, ছোটখাট একটা পরীক্ষা হয়ে গেল জীবনের। তবে হ্যা, কলেজ ভর্তি সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু মাঝখানে একটা লম্বা সময় বায়ুন্ডুলের মতো কাটিয়ে দিয়েছিলাম। তা প্রায় মাস দুই-তিন তো হবেই। কিন্তু কিছু করার তাগিদে আবার ছুটে আসলাম। এখনকার যে মনোবাসনা সেটা তখন পূর্ণ হলে আর ফিরতাম না। কাজও পেলাম, এক সপ্তাহ রাতের বেলায় আউটসোর্সিং এ কাজ করার পর আমার ছোট একটা ভুলের দরুন বিদেশী বায়ার প্রজেক্টটি ক্যান্সেল করে দেয়। বহু কষ্টে সংগ্রহ করা পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা দিয়ে একটি ল্যাপটপ কিনে ছিলাম কাজ করার জন্য। মেসের খাবারের জন্য ওই ছেলেটিকে হাজার খানেক টাকা দিয়েছিলাম। ছেলেটি একদিন পর নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। শুধু আমার নয়, মেস এর আরো অনেকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে।

মজার ব্যাপার কি এখন আর সেই ছোট ছোট কক্ষ গুলো নেই। বাড়িটার চেহেরাটাও অনেকটা পাল্টে গেছে। বাড়িটার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে একটা বড় নারকেল গাছ ছিল। নারকেল গাছের একটা শাখা বাতাশ এলে আমার জানালায় গিয়ে পড়ত। বাতাসে  পাতাগুলোর শব্দ এখনো কানে বাজে। নজরুল ইসলামের একটা কবিতা আছে, ‘গোবাক তরুর সাড়ি’। কবিতাটি আমি সেখানেই পড়েছিলাম, মিল খোঁজে পেলাম ওনার সাথে।

ভাগ্য অন্বেষণ করতে গিয়ে কী ভাগ্য পরিবর্তন সম্ভব? হয়তো সম্ভব। তবে সেটা লক্ষ্য প্রস্তুত ‍ও তা স্থির করার প্রতি একটা প্রবল আগ্রহের ব্যাপার। বাড়িটির সামনে একটি বহুতল ডেভেলপারদের বাড়ি গড়ে ওঠেছে। দেখেই মনে হয় বিলাসবহুল বাসস্থান। বাড়ীর সামনে বিশাল এক ফুলের নার্সারী, পাশেই দোলনা। একনজর তাকিয়ে দোল খেতে ইচ্ছে করলেও আমার সাধ্য সম্পর্কে আমি বেশ সচেতন। যাই হোক, আগের দিনের মতো আজও আমি খানিকটা আবেগপ্রবণ। ছেলেরা কতটা আবেগপ্রবণ হয় এর উত্তর জানা যাবে কোন সাইকার্টিস্ট কে জিজ্ঞাসা করলে। আরো জানা যাবে নস্টালজিয়া কোন ধরনের ইমোশন।

আমার কিঞ্চিত অধ্যয়নে আমি জানতে পারলাম এটি সাধারণত পরিস্থিতি অনুযায়ী পজিটিভ ও নেগেটিভ দুই ধরনের ইমোশন হয়। অনেক পড়াশোনা করলে এ নিয়ে একটি সেমি ডিগ্রী পাওয়া ও অসম্ভব কিছু না। ইব্রাহিমপুর বাজারে সাগর ভাইয়ের ফার্মেসী ছিল। সাগর ভাই আমার খুব সুপরিচিত মানুষ। আমি এখন তার কাছেই যাবো। জানি না এখনো সেখানে ওনার ফার্মেসী আছে কিনা। তার আগে বলে নেই। প্রাথমিক চিকিৎসার প্রয়োজন হলে সে আমার জন্য যথেষ্ট ছিল। আমার একটা অভ্যাস আছে। মন্দ না ভাল তা ঠিক জানি না। কখনো মনে হয় মন্দ আবার কখনো মনে হয় ঠিকই তো আছে।

আসলে অভ্যাসটা হলো যে কোন কিছু করার আগে নিজের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করতে পারিনা। যেকোন নগন্য অথবা জগন্য মানুষের কাছে বিনা দ্বিধায় পরামর্শ চেয়ে বসি। সাগর ভাই আমার খুব ভাল একজন পরামর্শক ছিলেন। যেকোন ব্যাপারে ওনাকে বিরক্ত করার লাইসেন্স দেওয়া থাকতো। সাগর ভাইয়ের ফার্মেসী থেকে আমার অন্য এক বাসার অর্থাৎ চিলে কোঠাটি দেখা যেত। আমার চিলে কোঠা থেকে মাঝে মাঝে ওনার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতাম। ব্যাপারটা বলা হয়নি ওনাকে কখনো। একদিন সন্ধ্যা বেলায় ঘুম থেকে ওঠে চেয়ারে হেলান দিয়ে চিলেকোঠার সামনের ফাঁকা ছাদে বসলাম। সাগর ভাইয়ের ফার্মেসী র একটা ছেলে, একটা মেয়ের সাথে কথা বলছিল। সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলো আশপাশে কেউ আছে কিনা।

কেউ নেই তাই সে আপত্তিকর কিছু অঙ্গভঙ্গি করলো মেয়েটির সাথে। মেয়েটির অবশ্য তাতে সম্মতি ছিল। বোঝাই যাচ্ছিল মেয়েটি তার গার্লফ্রেন্ড। হতেই পারে এমন কিছু। কিন্তু সেটা কি আমার দেখা ঠিক হলো। আমার বিবেক যেকোন ছোট খাট ব্যাপারেই আমাকে অনেক দ্বিধান্বিত করে রাখে। সেকারণেই আর কোনদিন সেদিকে খেয়াল করিনি। ভাবতে ভাবতে আর হাটতে হাটতে চলে আসলাম সাগর ভাইয়ের ফার্মেসীর সামনে।

সাগর ভাই আগের মতোই আছে। সেই নিবিড় হাসি, অপলক হয়ে তাকিয়ে থাকা। মাঝে মাঝে সাগর ভাইকে নারীদের মতো মনে হতো। বিশেষ করে উনি যখন হাসে আর এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মাথায় কয়েকটা চুল পেকেছে। আমায় দেখে একবারের জন্যও না চেনার ভান করেনি। সাগর ভাই খুব আপ্যায়ন করতে চাইলো। আমি সাগর ভাইকে বললাম, ভাই আপনার সাথে বহু বছর পর দেখা হলো। দেখে খুব ভাল লাগলো।

আরো কিছু জায়গায় ঘোরাফেরা হয়ে গেল। যেমন হাবিবুল্লাহ রোডে রবিন স্যারের কোচিং সেন্টার। মুন্সীবাড়ী রোডের সেই তিনতলা বাড়ীর দু’তলা (আগের মতই আছে। বুঝলাম বাড়ীওয়ালা ঢাকার অন্যান্য বাড়ীর মালিকের মতো সফল হতে পারেনি। পারলে হয়তো তিনতলা বাড়ীটা আরো উচু হতে পারতো।) কচুক্ষেত ও পুলপারের রাস্তা ধরে মিরপুর চৌদ্দ নম্বর থেকে সেই ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে ভাষান্টেক। দু’য়েকটা জায়গা গাড়ি থেকে তাকিয়ে দেখে নিলাম।

একটা মানুষকে নিয়ে এমন কোন অলি-গলি নেই যেখানে আমার হাটাহাটি হয়নি। একটা সময় ছিল যখন রাত জাগাটা আমার একান্ত দায়িত্ব হয়ে দাড়িয়েছিল। ভোর বেলায় ঘুমিয়ে বেলা বারোটা বাজার আগেই ঘুম থেকে ওঠে নাস্তা শেষ করে হাটতে বের হতাম। প্রতিদিন কয়েক কিলো রাস্তা পায়ে হেটে নানা রকমের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতাম। সবই যেন আজ অকপটে মনে পড়ে যাচ্ছে। আগামীকাল আমার ঘোরাফেরা শেষ হতে যাচ্ছে। সাতদিন ঘুরে কাটাতে চাইলেও একটু বেশী দ্রুত শেষ হয়ে গেল। কিন্তু বলা যাচ্ছে না। মন ভাল লাগলে আরো কিছু জায়গায় ঘুরবো।

বিশেষ কিছু জায়গায়, যেখানে একটি মানুষকে নিয়ে হেটেছিলাম। সেই মানুষটি অবশ্য আমার অনেক আগেই ঢাকা ছেড়েছে। নিজের ভিতরে পোষে রাখা গল্পগুলো বলা কোন অর্থে খুব দায়িত্বশীল হয়ে ওঠতে হয় সেটা টের পেয়ে আমার বোধ হয় সচেতনতার থেকে অসচেতনই বেশী হয়ে যাচ্ছি। প্রত্যেকটা মানুষই আত্মবিশ্লেষণ করতে পারে স্বতস্ফূর্তভাবে, তবে তার জীবনে যদি জটিলতার ছায়া না পড়ে। স্বাভাবিকতায় মোড়ানো যে জীবন আমি গড়ে তুলতে চেয়েছিলাম, তা ক্রমেই এতটা কমপ্লিকেটেড হয়ে ওঠবে তা কে জানত। ইদানিং তো কারো সাথে কোন কথা বলতেই ভয় হয়। মনে হয় এই বুঝি করে ফেললাম মস্ত আরো একটি বড় ভুল। কী জানি এর পিছনে কোন মনস্তাত্ত্বিক কারণ থাকে কিনা।

খুব বেশী মনে পড়েনা কোন দিন নিজের মধ্যে কোন উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যকে ধারণ করেছিলাম কিনা। কেউ কখনো প্রশ্ন করলে সেই মুহুর্তেই যেন মনে হতো আমার একটা জীবনের লক্ষ্য তো থাকা উচিৎ তাই না? সেই ব্যক্তিটি হয়তো চোখ কপালে তুলতো। কিন্তু সেই মুহুর্তে আমার সাদামাটা হাসি আর নিজের মনের দিকে খেয়াল করতে গিয়ে কথাটার তাৎপর্য হারিয়ে যায়। উদ্দেশ্যহীনভাবে পথ চলতে গিয়ে পা দু’টো ক্লান্ত ঠিকই কিন্তু যতদূর যাওয়ার কথা ছিলো কিংবা যাওয়া সম্ভব হতো তা কি আমার আলসেমী অথবা কর্ম অনিহার কারণে হলো না?

নিজের বিবেক সদাই জাগ্রত রাখত আমায়, যখনি আমি আত্মগ্লানিমূলক কোন কাজের অভিপ্রায় করতাম। সেকারণে অনৈতিক কিছু সম্ভব হয়নি আমাকে দিয়ে। কিন্তু এটা আমার জন্য কোন সান্ত্বনা নয়, কারণ নৈতিকভাবে যতটা পথ অতিক্রম করেছি সেটাকেও পুঁজি করে সামনে এগোলে আমার আর পিছন ফিরে ভাবতে হতোনা।

আজ তৃতীয় দিন, গ্রীষ্মের খরতাপ অনুভব করাটা সহজ কাজ। গুলশান পার্ক ও বনানীর পরিষ্কার রাস্তা দিয়ে হাটাহাটির শুরু। আগে যতটুকু না নিরাপত্তা ছিল এইসব জায়গায় এখন তার থেকে ঢের বেশী নিরাপত্তা প্রদান করছে নিরাপত্তা কর্মীরা। এরপর বনানী থেকে মহাখালীর দিকে হাটা শুরু করলাম। হাটতে হাটতে যে পরিমাণ ভাবনা মাথায় এলো, তা হলো। চল্লিশভাগ শিক্ষার্থী খামখেয়ালীভাবে বিনোদন ‍ ও উপভোগের মাধ্যমে সময় নষ্ট করে। জীবনকে প্রচন্ড রকমের ভোগবাদে মাতিয়ে রাখতে তাদের যত প্রচেষ্টা। কিছু শিক্ষার্থী আছে যারা সামান্য সিরিয়াস তাদের পড়াশোনা নিয়ে কিন্তু পরিশ্রমী হতে ইচ্ছে করেনা।

বন্ধুমহলে একটা ভাল যোগসাজেস থাকলেই মোটামোটি একটা সিজিপিএ পাওয়া সম্ভব আরো সম্ভব ইমপ্রুভমেন্ট নেওয়ার জামেলা থেকে মুক্তি পাওয়া। এর মধ্যে কেউ কেউ আবার আছে যারা নিজের বন্ধুদের মধ্য থেকে বা জুনিয়রদের মধ্য থেকে কারো দৃষ্টি আহবানে প্রবলভাবে চেষ্টা চালায়। আসলে এগুলো খুব অহেতুক বিষয়। কিন্তু যেটা স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের পর বুঝলাম, সেটা হলো অহেতুক ছিলো আমার নেকামি। প্রতিদিন সকাল বেলায় গদবাধা প্রথাসিদ্ধ ক্লাস করতে ছুটে যেতাম, বন্ধু-বান্ধবহীন, আড্ডাহীন একগেয়েমি ছাত্রজীবন।

সহজ-সরল পথ চলা আর বাহ্যিক সিরিয়াসনেস এর মধ্য দিয়ে দু’একজন শিক্ষকের প্রশংসা আদায় করা। শিক্ষাবর্ষ শেষে একটা ভাল সিজিপিএ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা। সামান্য হিংসার পাত্রও হতাম বন্ধুদের কাছে। কিন্তু আমার সাফল্যের পথে কতটা হাটা দরকার ছিলো আর কতটা আমি হেটেছি সেটা হলো প্রশ্নবোধক?

যেমনই হোক, একেবারেই কী বাজে রকমের শিক্ষার্থী ছিলাম আমি? আর আমার অবস্থা যদি এমন হয় তবে, যারা কোন দিন বইয়ের পৃষ্ঠা খুলে দেখেনি তাকে কি বলা যায়? আমরা যখনই নিজেদের দুরবস্থার কথা ভাবি, তখনই আমাদের সামনে একটা সহজ সান্ত্বনা থাকে। সেটা হলো আমাদের থেকে যারা আরো একটু বেশী খারাপ অবস্থায় থাকে তাদের সাথে নিজেদের তুলনা করে নিজেকে সার্ভাইবেবল করে তোলা। আমার বড় ভাইয়ের ছেলে শান্ত সেদিন স্কুল থেকে ফিরলে ওর বাবা ওকে প্রশ্ন করলো- কিরে শান্ত, তোর আজ পরীক্ষার রেজাল্ট দেওয়ার কথা না?

শান্ত- ধীর গলায় উত্তর দিলো, হ্যা আব্বু।
তো কি খবর বল। কি হয়েছে রেজাল্ট?
আব্বু আমার বন্ধু সুমনের বাবা একজন উকিল। সুমন ফেল করেছে।
আচ্ছা বুঝলাম, তোর কি খবর?
আব্বু আমার আরেক বন্ধু রানা, ওর বাবা ডাক্তার। রানাও ফেল করেছে।
হুম বুঝলাম। কিন্তু তোর কি রেজাল্ট?
আব্বু তুমি তো সুনীলকে চিনো?
হ্যা। কি হয়েছে?
ওর বাবা একজন ম্যাজিস্ট্রেট। সুনীল ও ফেল করেছে?
সবই বুঝলাম, তুই কি করছিস সেটা বল?
এবার শান্ত অশান্ত হয়ে বলল- আব্বু তুমি কী দরবেশ নাকি?
বড় ভাই প্রথমে একটু থতমত হয়ে গেলো। তারপর ব্যাপারটা বুঝতে পারলো।

 মোটামোটি ভাবে জানা যায় কিছু শিক্ষার্থীর পৈত্রিক সচলাবস্থা, পারিবারিক দৃঢ়তা আর অপচেষ্টার আড়ালে সক্রিয় যে প্রচেষ্টা তা আমার সারাদিন  বইয়ের পাতায় চোখবুঝে থাকাকে হার  মানিয়েছে। এককথায় বললে এটাও আমার জন্য একটা কোমল সান্ত্বনা। কারণ কিছু পারিনি বলে, নিজেকে ডিফেন্ড করছি নানা অজুহাত দিয়ে। এটা স্বভাবতই আমার প্রতিদিনকার অন্তঃদ্বন্দ্ব।

কলেজের আশপাশ দিয়ে হাটাহাটি। নতুন কোন পরিবর্তন নেই। আগের মতোই। ঘন্টা দু’য়েক ঘুরাফেরা শেষে কলেজ থেকে ফিরে যাবো। নিয়মানুযায়ী দু’চোখের কোণে ভারী মেঘের মতো অশ্রুগুলো বেরিয়ে আসার উপায় খুঁজছে। আমার খুব প্রিয় এক শিক্ষিকা, পিছন থেকে আমার নাম ডেকে বলল, প্লাবন, এই প্লাবন।
আমি পিছন ফিরে দেখলাম।
‘কী অবস্থা তোমার? কেমন আছো?’
ম্যাম এর দিকে তাকিয়ে জোর করে একটা হাসিমাখা চেহেরা বানিয়ে বললাম, ভালো আছি ম্যাম।
‘কী করছো এখন?’

অল্পসময় চুপ থেকে ভেবে নিলাম কি বলা যায়। মিথ্যা বলাটা কি ঠিক হবে ? সেখানেও আমার ঐ দ্বিধান্বিত বিবেক ধমক দিলো। ম্যাম এর তাকিয়ে থাকাটা দেখতে ভাল লাগে। ত্রিশোর্ধ্ব হলেও মুখের অবয়বে মায়াবী হাসি ও লাবন্য।উনি হাসলে চোখ দুটো খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমি নিচু গলায় বললাম, ম্যাম একটা কোম্পানীতে কয়েক বছর ধরে চাকরি করছিলাম। চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি। অনিশ্চিত ভবিষ্যত। আসলে কিছুদিন বেকার থাকতে ইচ্ছে করছে। আমি জানি বেকারত্ব কাটিয়ে আবার কর্মমুখী হওয়াটা বেশ চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু আমার এই অবসরটি খুব প্রয়োজন।

ম্যাম বললেন, ‘তুমি খুব ভাল স্টুডেন্ট। আমার বিশ্বাস এই চাকরি চলে গেলেও তুমি চেষ্টা করলে আরো ভাল কিছু করতে পারবে। অনেক সময় বড় কিছু পেতে গেলে ছোট ছোট ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। সফলতার পূর্বশর্ত মানসিক প্রশান্তি। হতাশাকে দূরীভূত করতে কিছু সময় নিজের মতো উপভোগ করতেই পারো। এতে করে তোমার পরিকল্পনা হয়তো আরো সুদূরপ্রসারী হবে।’

আমি ম্যাম এর দিকে খুব শ্রদ্ধা নিয়ে তাকিয়ে রইলাম। আমি সর্বদাই খুব ভাল শ্রোতা। আমি উনাকে বললাম, সত্যি ম্যাম আপনি আমায় এভাবে আশা দেখাবেন ভাবিনি। আমি ধরে নিয়েছিলাম, আমার ক্যারিয়ার এ উদ্দেশ্যহীন এই কর্মবিরতির কারণে আপনি আমায় হতাশাব্যঞ্জক কথা শোনাবেন। বলবেন, পড়াশোনায় এত ভাল হয়ে লাভ কী যদি ক্যারিয়ারে সফল না হওয়া যায়?

শুন, যারা ভাল তারা চেষ্টা করলে আরো ভাল কিছু করবে এটাই সত্যি। সম্পদ শত বছর ফেলে রাখলেও তা মূল্যহীন হয়ে যায় না। আমি জানি তোমার মধ্যে পটেনশিয়ালিটি আছে। যোগযোগ রেখো। ভালমন্দ জানাবে।

ম্যাম এর সাথে কথা বলে ভাল লাগলো। কেউ উৎসাহ দিয়ে কিছু বললে মনটা শিথিল হয়ে যায়। কিছু সময়ের জন্য চারপাশের বাস্তবতাকে দেখছিনা এমন ভাব করা যায়। আবার কখনো কখনো এমনও মনে হয় যে সে তো খুব সফল মানুষ। সে যেহেতু আমার মধ্যে সম্ভাবনা দেখছে তাহলো হয়তো আসলে আমি কিছু না কিছু করতে পারবো।  কিন্তু সীমিত সময় পর বাস্তবতার বাটনে অটোমেটিক ক্লিক পড়ে যায়। ছেলেবেলার কথা মনে হলে বড্ড স্বাচ্ছন্দ বোধ করি। কোন রকমের পিছুটান কিংবা জটিলতা ছিল না জীবনে। হ্যা, এটা ঠিক যে আমার সেটা না থাকলেও  একজন ব্যক্তির সেটা আমার থেকে পরিমাণে হয়তো বেশী ছিলো। আমার বাবার। তিনি কেবল আমার মতো ছোট্ট সমস্যায় হতাশা, জটিলতা বা পরিস্থিতি ও প্রকৃতির বিরূপ আচরণে অসহায় হয়ে হার মেনে নেননি। যদি নিতেন, তাহলে নিতান্তই আমাদের থাকতে হতো পথে  ঘাটে।

বাবা হয়তো আক্ষরিকভাবে জীবনের জটিলতাটাকে বুঝতে পারেন নি কিন্তু সেটাকে জীবনের অসময় বলে চালিয়ে দিয়ে সুসময়ের আশায় অধির আগ্রহে বসে থাকতেন। তাতে বোঝা যায় বাবা অনেক ধৈর্য্যশীল ছিলেন। আমি এতটা ধৈর্য্যশীল না।

একটা জায়গায় হাটাহাটি করাটা আমার একটা মানসিক নিরাময় মনে হতো। ঠিক কেমন একটা অনুভূতি আমি আজো বুঝে উঠতে পারিনা। কলেজ শেষে প্রায় দিন হেটে বাসায় ফিরতাম। মহাখালী- বনানী রেল রাস্তা ধরে। কখনো নিজেকে একজন অঘোষিত প‌র্যবেক্ষক মনে হতো। কমলাপুর থেকে ছুটে আসা সবগুলো ট্রেনই বনানীতে থামতো না। দু’য়েকটা থামতো। ট্রেনের ছাদে কিছু টিকেটহীন যাত্রীর বসে থাকা দেখতাম। মনে হতো এরা উদ্দেশ্যহীন যাত্রা করছে। হয়তো তারা নিজেরাই জানেনা কোন স্টেশনে নেমে যাবেন। দু’একজন টোকাই ট্রেনের পিছনের দিক দিয়ে ওঠে ছাদে দৌড়াদৌড়ি করতে দেখতাম।

বনানী জায়গাটা একটু আজব জায়গা সেটা জানতে আমার অনেক সময় লেগেছিল। একদিন সেই মানুষটি আমায় নিয়ে রেল রাস্তায় হাটবে বলে গোঁ ধরে বসল। দুইটা লাইনে দু’জন দু’জনের হাত ধরে হাটা ওর শখ হয়েছে। খুব সম্ভবত নাটকে দেখেছে।  বারবার সেই মানুষটি, সেই মানুষটি বলতে ভাল লাগছেনা। ওর নাম শরিফুন্নেছা। ওর নিজের মানসিক ও দৈহিক মেচ্যুরিটির সাথে সাথে কিছু অনুভূতিপ্রবণ ও আবেগীয় ইচ্ছা মনকে তাড়া দিচ্ছিল। ইচ্ছা পূরণ করার মতো তেমন কেউ ছিল না। আমার মতো একজনের সাথে কোন মেয়ে ঘুরতে বেরোবে এটা অন্য কেউ যেমন কখনো ভাবে না, আমিও ভাবতে পারতাম না। ওর ইচ্ছা পূরণ আমার দায়িত্বে পরিণত হলো। তানাহলে কবে আবার অন্য কাউকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে কে জানে।

জেদি মেয়ে মানুষ বলে কথা। মেজাজ খারাপ হলে অতি যত্নের মাথার চুল ছিড়তেও দু’দণ্ড ভাববেনা। একদিন দু’জন মিলে রেল লাইনে হাটতে গেলাম। যদিও শহরে ছেলে-মেয়েদের অবাধ চলাফেরায় কেউ ভ্রুকুচকায় না তবুও এমন একটি আপত্তিকর জায়গায় হাটতে যাওয়ায় কিছু মানুষের চোখ কপালে উঠেছে।  স্বাভাবিক ভাবেই ও খুব আনন্দিত হয়েছিল। কিন্তু আনন্দটা মাটি হয়ে গেলো যখন একভদ্র লোক আমায় ডেকে একটা আড়ালে নিয়ে গেল। সে চিন্তিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। লোকটি বলল, ভাই মেয়ে মানুষ নিয়ে ঘুরার জন্য ঢাকায় অনেক জায়গা আছে। এখানেই ঘুরতে হবে?

ব্যাপারটা ঠাহর করতে না পেরে আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কোন সমস্যা?
লোকটি বলল-এটা প্রস্টিটিউটদের এরিয়া। এখানে অনেক বাজে লোকেরা চলাফেরা করে। তাই গার্লফ্রেন্ড নিয়ে এখানে ঘুরাফেরা না করাই ভাল।

আমি উনার মুখের উপরই বললাম, না না আপনি ভুল ভাবছেন। সে আমার ..........।
আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল -ভাই এসব করতে করতে বড় হয়েছি। আমাকে বুঝাতে আসবেন না। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই মেয়েটাকে নিয়ে  এখান থেকে কেটে পড়েন। তানাহলে অজানা কোন এক বিপদে পড়ে হাতড়াতে থাকবেন।

শরিফুন্নেসা আমার দিকে কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম, চলো বাসাই যাই। এমন নরম কথায় সে কখনো পাত্তা দেয় না। কিন্তু সেদিন তাকে দেখলাম অন্য এক ভঙ্গিতে। শুধু শান্ত গলায় বলল- আরেকটু থেকে গেলে হতো না?
 পরক্ষণে নিজেই বলল, আচ্ছা চলো যাই।

 এ বলে হাটতে শুরু করলো। সপ্তাহখানেক পর সে নিজেই আমার কৌতুহল দূর করে দিলো। তুমি নিশ্চয়ই সেদিন অবাক হয়েছো তাই না?
কোন দিন?
ওই যে আমরা রেললাইনে হাটতে গিয়েছিলাম। তুমি বললে বাসায় চলে যেতে আর আমি সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলাম?
ওহ হ্যা। কেন বলোতো?
জানো তোমায় যখন লোকটা আড়ালে ডেকে নিয়ে গেলো আমার অনেক ভয় হচ্ছিল। আমি আগে থেকেই জানতাম জায়গাটা অনেক খারাপ। বিশেষ করে বিকাল বেলায় এখানে কোন ভদ্র মেয়ে যায় না। এছাড়া একটা ছেলে আমার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলো, কিরে যাবি?
 আমি তখন চুপ করে রইলাম। সে আবারো বলল, কিরে লজ্জা পাচ্ছিস কেন? তুই কি লাইনে নতুন? সমস্যা নাই,বল কত টাকা দিতে হবে?
আমার বিষণ মন খারাপ হলো। আসলে আমাদের কলেজে যাওয়ার সময় অনেকে এমন বাজে মন্তব্য করে। তাই এসব শুনে খুব বিব্রত হই। সেদিন খুব অস্বস্তি লাগছিলো তাই তোমায় বলেছিলাম তোমায় চলে আসতে।

আমি ওর কথাটা শুনছিলাম সহজভাবে। কিন্তু কোন মেয়েকে এমন মন্তব্য করলে তার কাছ কেমন লাগে সেটা একমাত্র সে-ই বুঝতে পারে। আমার চলাফেরার পথে শরিফুন্নেসা সঙ্গী হবার জন্য পারফেক্ট ছিলো। আরো একটা দিন ওর সাথে কাটানো জায়গাগুলোতে হাটতে ইচ্ছে করছে। কাল সেই জায়গা গুলোতেই যাবো।














No comments:

Post a Comment

Thanks for your comment