সাফল্য
মোঃ অলিউল্লাহ্
শুনেন অরুন সাহেব, ‘জলে বাস করে কুমিরের সাথে লাগার পরিণাম টা কী হতে পারে তা আপনি হয়তো আন্দাজ করতে পারছেন না।’
স্যার আপনারও জানার বাকি আছে আমি উভচর প্রাণীদের মতো। জরে এবং স্থলে দুই জায়গাতেই অবস্থান করতে পারি। আমি জানি আপনার অফিসে চাকরি করলে আমার ভবিষ্যত কতদূর পর্যন্ত গড়াবে। আপাদমস্তক ডালাই করা কিছু গদবাধা মিডল সেকেন্ড ক্লাস কর্মীর মধ্যে আমাকে ফেলার মতো বোকামি করবেন না। নেহাত ভদ্রলোক বলেই আপনার সাথে এমন ভদ্র আচরণ করে চাকরি থেকে ইস্তফা নিলাম।
সেদিন আমার অফিসের বস আমার দিকে এক আজব চাহনিতে তাকিয়ে ছিলেন। নিশ্চয়ই তিনি মনে মনে এমন ভাবেন নি যে আমি খুব বড় সরকারী অফিসার কিংবা বিরাট একজন ব্যবসায়ী হয়ে ওঠবো। সে নিশ্চিত ভেবে নিয়েছিল আমার আমার ক্যারিয়ার এখানেই শেষ। হয়তো আর কোনদিন আমার ভাল চাকরি হবে না আর হলেও সেখানে আমি টিকতে পারবোনা। আমার যে পরিমাণ ইগু আর মেজাজ তা নিয়ে জীবনে সফল হওয়া যে অনেক কঠিন সেটা তিনি খুব অংক করে বুঝে নিয়েছিলেন।
যখন অফিস থেকে বেরিয়ে আসবো, বসের রুমের দেওয়ালে ঝুলানো একটা পেইন্ট চোখে পড়ে ছিল। খুব সম্ভব একটা সবুজ মাঠ। সে মাঠে একটা কিংবা দুইটা গরু গাস খাওয়ারত। পাশেই একটি নদী অজানায় হারিয়ে গেছে। ওপরে আকাশের রঙ টা খুব উজ্জল দেখাচ্ছিল। আমার আজো চোখে ভাসে আমার বসের সেই চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলার বিরক্তিকর সেই চেহেরা। একবার তার চেহেরার দিকে তাকিয়ে যখন রক্ত টগবগ করছিলো, তখন ঐ পেইন্টটির দিকে তাকিয়ে নিজেকে শান্ত করার পাথেয় খুঁজে নিয়েছিলাম।
আপনার মনে প্রশ্ন জাগাটা স্বাভাবিক যে, এখন কী অবস্থা? চলুন একটা গল্প শুনে আসি।
আমার বন্ধু অরুন। বয়স পয়ত্রিশ। এখন সে একজন ক্রিয়েটিভ ম্যানেজার। একটা আইটি ফার্মের ক্রিয়েটিভ ডিজাইন সেকশনে কাজ করছে। ওহ সরি সরি, আমার পরিচয় দিতে ভুলে গেছি। আমি নাফিস। অরুনের সাথেই পড়াশোনা শেষ করেছি। এখন একটি বেসরকারী কোম্পানীতে কাজ করছি। আমরা প্রায়ই দু’জন মিলে সুখ-দুঃখের গল্প করি। আমার বন্ধুর বর্তমানে আরো একটি স্ট্যাটাস হলো সে একজন ব্যবসায়ী।
হ্যা, আপনার মতো আমিও অবাক হই যখন ভাবি সে দুইটা প্রফেশন একসাথে সামলায় কি করে। আসলে উপায় থাকলে নাকি চেষ্টা করতে দোষ নাই। সে হয়তো চেষ্টাটাই করেছিল আর তাই উপায় হয়ে গিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে উপায় থাকার কারণেই কি ইচ্ছা করেছে নাকি ইচ্ছা করার কারণে উপায় হয়েছে। যাক, আপাতত আমাদের নিজের চরকায় তেল দেওয়াই ভাল।
কথার পিঠে কথা বলতে গিয়েই ওকে একদিন জিজ্ঞাসা করে বসলাম, তুই কি সফল তোর জীবনে?
সে আমায় উত্তর দিল, ‘সফলতা বিষয়টা একটু আপেক্ষিক। আগে বুঝতে হবে তুই আসলে সফলতা বলতে কি বুঝিস। যেমন ধর, তুই একটা ছবি আঁকতে বসছিস আর খুব সুন্দর একটা ছবি আঁকা হয়ে গেলো। এবার তোর মনে একটা ভাল অনুভূতি হবে। এটা কিন্তু তোর কাজের একটা সফলতা। তবে প্রতিযোগিতায় তোর সে ছবি অন্যান্যদের আঁকা ছবি থেকে শ্রেষ্ঠ হলো না। তাহলে কি তুই ব্যর্থ?’
বুঝলাম, ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে হবে। কিন্তু এটা বুঝলাম যে সে সোজা উত্তর দেবার মানুষ না। একদিন তাকে বলতে শুনেছি, জীবনে যেদিন কোন একটা লক্ষ্য থেকে ছিটকে পড়বো, ছিটকে পড়ার আগেই আমাকে দ্বিতীয় লক্ষ্যটিকে প্রস্তুত করে রাখতে হবে। আমি সেটাই করছি। জীবনে উত্থান-পতন আসবেই। কারণ পাল্টানো জীবনের নিয়ম। আমরা শুধু রূপান্তরিত হতে পারি। নিশ্চিত হেরে যাবে জেনেও যে জীবনের সাথে বাজি ধরার সাহস করতে পারে; সে হয়তো সফল হয়েও যেতে পারে। অন্যরা সেটা গ্রহণ করুক আর নাই করুক।
জীবনে চড়াই-উৎরাই সময়টাকে কেউ দেখেনা। শুধু দেখে সফলতা ও ব্যর্থতাকে। একদিন আমি তাকে বললাম, তোর অফিসে কাজ কি?
উত্তর দিল ‘ইমাজিন করা’। সাথে একটা কথা বললো- ‘ইমাজিনেশন ইজ মৌর ইপর্টেন্ট দ্যান নলেজ।’
আমি বসে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম। ও আমায় প্রশ্ন করলো, ‘কিরে কি ভাবছিস?’
উত্তর দিলাম- ডিস্টার্ব করিস না, আমি ইমাজিন করছি।
আমায় জিজ্ঞেস করলো ‘কি ইমাজিন করছিস?’
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ওর চোখে-মুখে আকাঙ্ক্ষা দেখতে পেলাম। বেচারা ভেবেছিলো আমি খুব মহৎ কিছু একটা ভেবেছি। পরে বললাম, ইমাজিন করছিলাম কিভাবে তোর পাছায় লাথি মারা যায়। তাহলে হয়তো অনেক বড় নলেজ অর্জন করতে পারবো। একথা শুনেই ও একগাল হেসে দিল আর বলল ‘এভাবেই পৃথিবীতে সুন্দর সুন্দর উক্তিগুলো অবহেলিত হয়। ঠিক এই কথাটাই কিন্তু একজন বিখ্যাত ব্যক্তি বলে গিয়েছিলেন। কিন্তু আমার মুখে শুনেছিস বলে কোন মূল্য দিলিনা।’
প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের সফলতা ও ব্যর্থতার গল্প আমরা শুনি। কখনো কখনো তুলনা করি নিজেকে তাদের অবস্থানের সাথে। আমার বন্ধু তার ব্যর্থতাকে অনুসরণ করেনি কখনো, জীবনের চ্যালেঞ্জকেই প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেছে। বাকিটা তার মুখ থেকেই শুনে নিন।
আচমকা এ কর্পোরেট দুনিয়াটা বড় বেশী বস্তবাদে আচ্ছন্ন মনে হয়। আসলে সফলতা-ব্যর্থতা কিছুনা। দিন শেষে টাকাটাই এখানে সফলতা। আসলে জীবন টাকার কাছে দায়বদ্ধ। আর আমার প্রশ্ন এই দায়বদ্ধতাই কী জীবন?
কিছু গল্প এমনও হয়।
কর্ম জীবন মানেই নিজেকে একধরনের পন্য করে ফেলা। সেটা মেনে নেওয়াই কর্পোরেট জগতে ভদ্রতার লক্ষণ। আমি সেটা পারিনি বলেই আমার বসের সাথে আমার বিরোধিতা হয়েছিল। অসুস্থতা একটি শারীরিক প্রতিবন্ধকতা। স্বভাবতই অসুস্থ হলে অফিসে যাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনা। আর সে অবস্থা যখন মারাত্মক আকার ধারণ করে তখন তো জীবন হুমকির মুখে। কারণ কর্পোরেট লাইফে আপনাকে সুস্থ থাকতে হবে। অসুস্থ হবেন তো আপনি সে জগতে চলাফেরার অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।
কর্ম জীবন মানেই নিজেকে একধরনের পন্য করে ফেলা। সেটা মেনে নেওয়াই কর্পোরেট জগতে ভদ্রতার লক্ষণ। আমি সেটা পারিনি বলেই আমার বসের সাথে আমার বিরোধিতা হয়েছিল। অসুস্থতা একটি শারীরিক প্রতিবন্ধকতা। স্বভাবতই অসুস্থ হলে অফিসে যাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনা। আর সে অবস্থা যখন মারাত্মক আকার ধারণ করে তখন তো জীবন হুমকির মুখে। কারণ কর্পোরেট লাইফে আপনাকে সুস্থ থাকতে হবে। অসুস্থ হবেন তো আপনি সে জগতে চলাফেরার অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।
পেশাস্থলে মানুষ এত বেশী আবেগহীন যে সেখানে আপনি বেঁচে আছেন কি মরে যাচ্ছেন তাতে কিছু যায় আসেনা। আর তাই আমার অসহায় অবস্থায় যখন অন্যায় আপত্তিকর মন্তব্য শুনতে হচ্ছিল, আত্মসচেতনতার ফলে এ দায়বদ্ধতাকে মেনে নিতে পারিনি। ফলাফল যা হবার তাই হলো।
No comments:
Post a Comment
Thanks for your comment