Monday, May 14, 2018

আত্মবিশ্বাসের কাছে হার


আত্মবিশ্বাসের কাছে হার

মোঃ অলিউল্লাহ্

অনেক কিছুই ঘটে যায় মিরাকল হয়ে। আর তাই এ ‘মিরাকল’ নামটিও বোধ হয় জীবনের খানিকটা জায়গা জুড়ে থাকে। বাবা-মা খুব সখ করে জন্মের পর নাম রেখেছিল সোহাগ। যেদিন স্কুলে ভর্তি হতে গেলাম।
স্যার আমায় জিজ্ঞেস করেছিল, ‘নাম কী?’

নিচু স্বরে উত্তর দিলাম, স্যার আমার নাম সোহাগ।

স্যার জানতে চাইলো, ‘আগে পিছে কিছু আছে?’

একটু অপ্রস্তুত হলাম বটে, চেয়ারে বসে ছিলাম। পিছনে একটা দেয়াল আর সামনে স্যারের টেবিল। দিশা-বুদ্ধি না পেয়ে তাই উত্তর দিলাম, স্যার সামনে টেবিল, তার সামনে আপনি আর পিছনে তো দেয়াল ছাড়া কিছু দেখতে পাচ্ছিনা।

যদিও একটু বেশী বয়সে স্কুলে ভর্তি হতে গিয়েছিলাম, সে ব্যাপারটা অবশ্য আমার বাবা-মা আর আমারই জানা ছিল। শারীরিক গঠনের দিক থেকে বোঝার উপায় নেই আমার প্রকৃত বয়স কত। আর তাই অল্প বয়স ভেবে নিয়েই স্যার রাগটাকে সামলে নিলেন। তানাহলে এত সহজে ভুল হজম করার ক্ষমতা ওনার ছিলনা।

বলল- ‘বাবা তোর নামের আগে পড়ে কিছু আছে?’

এবার ব্যাপারটা কিছুটা আমলে আসলো। তাও একবার ভেবে নিলাম, স্যার বলে কথা এবার ভুল হলে একটা জারি দিতে ছাড়বে না। বললাম, স্যার নেই।

ওনিই অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল তখন, জিজ্ঞেস করলো, ‘কোন স্যার নেই?’

আমি বললাম, স্যার আমার নামের আগে পিছনে কিছু নেই। হুট করে কোন কিছু না ভেবে ওনি রেজিস্টার খাতায় আমার একটা নাম লিখে নিলেন। প্লাবন আহমেদ সোহাগ। বের হবার পূর্বে আমায় একবার কাছে টেনে বলে দিলেন,  ‘এই ছেলে শুন, একজনের নামের তিনটি অংশ থাকে। তাই আজ থেকে তোর নাম প্লাবন আহমেদ সোহাগ।’ বুঝিনি পুরোটা বিষয়, কিন্তু নামটা ভাল লাগলো বলে আপত্তি করলাম না। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো প্লাবনের কারনে সোহাগ নামটা প্লাবিত হয়ে গেল, ইয়ে মানে প্রায় হারিয়ে গেল। সবার কাছে প্লাবন-ই প্রিয়চেনা।

ছাত্র হিসাবে প্রচন্ড রকমের ফাঁকিবাজ ছিলাম শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই। তবে কেন জানি শিক্ষকের খুব প্রিয় ছিলাম সারা শিক্ষাজীবনেই। জানিনা এমন কি কারণ ছিল আমায় অতিরিক্ত ভালবাসার। হয়তো কোন এক মিরাকল কাজ করত। আর সেই রেশ ধরেই হয়তো বারবার রেজাল্ট খুব ভাল হয়ে যেত। আর আমাদের দেশের কালচার অনুযায়ী শিক্ষকদের মনে সহানুভূতি বিশেষ কিছু ছাত্রের জন্য প্রযোজ্য ছিল। হয়তো পরীক্ষায় একটু খারাপ করলেও আগের ক্লাসে ভাল ছিলাম বলে, ওনারা হয়তো মন থেকে চাইতেন না রোল নম্বরটা পিছিয়ে যাক।

আর এই কারণেই কেন জানি মিথ্যে একটা অহমিকা মনে কাজ করতো। পড়াশোনা করি আর না করি পরীক্ষায় কিন্তু মনের মাধুরি মিশিয়ে অনেক কিছুই লিখে দিতে পারি। আরো একটা বদ্ধমূল ধারণাও মনে পোষণ করতাম, সেটা হলো শিক্ষকদের এতো সময় নেই যে, আমার সমস্ত খাতার লেখা মনোযোগ সহকারে পড়বে। আফটার অল ওনি তো আর কোন উপন্যাস পড়তে বসবেন না।

প্রাথমিকটা ভালই কাটলো। কিন্তু ফলাফল যে খুব ভাল এসেছিল তা নয়। তবুও প্রাথমিকে বৃত্তি দেওয়ার একটা অভিপ্রায় ছিল। ভেবে নিয়েছিলাম মিরাকল হয়তো এখানেও ঘটতে পারে। কিন্তু এতটা সৌভাগ্যবান যে আমি ছিলাম না। তাই জীবনের প্রথম আত্মবিশ্বাসের কাছে খেলাম ধাক্কা। শ্রেফ হলো না আরকি বৃত্তিটা পাওয়া। তাতে আর তেমন কি যায় আসে আমার। অবশ্য আমার পরিবারেরও যে খুব একটা আসলো গেলো তা নয়।

কারণ একটাই,গ্রামের নিম্নমুখী শিক্ষাপ্রবণতার পরিবারগুলোর মধ্যে আমার পরিবারটিও অন্যতম ছিল।যেখানে খানিকটা নিজেই নিজের অভিবাবক হয়ে গিয়েছিলাম। যাক সেকথা। নিজের বাহ্যিক সৌন্দর্য খুব একটা আকর্ষণীয় না হলেও মনের অগোচরেই কখনো কখনো এক ভাবনা দানা বাঁধত, সেটা হলো আমার প্রতি কোন মেয়ের আকর্ষণ। অর্থাৎ আমি নিজে থেকে কোন মেয়ের প্রতি আগ্রহ দেখাতাম না, কারণ একটাই আমাকেই মেয়েরা পছন্দ করবে আর প্রপোজাল পাঠাবে। নেহাত নিজের চেহারাটা আয়নায় মাঝে সাজে দেখি, তাই বুঝতে সক্ষম হয়েছিলাম এটা সম্ভব না।

কোন মেয়ে আমায় প্রপোজাল দিবে দূরে থাক, কাছে এসে আজ পর্যন্ত কোন প্রশংসাই করলো না। যদিও মেয়েরা প্রশংসা একটু কম করতে পারে। সরি, কোন মেয়ে পাঠক থাকলে রেগে যাবেন না প্লিজ। শেষ পর্যন্ত যা হলো, কোন এক রমনী প্রায় প্রতিদিন অন্তত একবার হলেও আমার দিকে ঘাড় বাঁকা করে তাঁকাতে শুরু করল। কী ভাবছেন? নিশ্চয়ই মেয়েটা মা কালীর মতো, মানে দেখতে কৃষ্ণবর্ণ। অথবা বাহ্যিক ভাবে দেখতে অসুন্দর কিংবা অন্য কোন সমস্যা তো আছেই। তানাহলে আমার মতো একজনের দিকে ফিরে তাকাবে কেন?

না সেরকম কোন সমস্যা ছিলো না। আর সেজন্যই তো আমার আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে উঠতে শুরু করলো। অবশ্য আমার কোন দিক থেকে রূপ বা গুণ বেড়ে গিয়েছিল তাও নয়। ভালইতো চলছিল, আগে একা পথে হাটতাম। হতছেড়ার মতো বন্ধুদের গার্লফ্রেন্ডদের সাথে কথা বলতে দেখে মনে মনে সামান্য আফসোস করে ঘাড় ঘুরিয়ে অন্য দিকে ফিরে ঘুমিয়ে যেতাম। অন্তত সে গ্লানি মিটলো  বলে। ছ’মাস যেতে না যেতেই তার আমার মাঝে একহাজারটা মিলের পাশাপাশি অমিল হতে শুরু হলো। শুধু খুনসুটিতেই সীমাবদ্ধ রইলো না আমাদের সম্পর্ক। আর সেই রাগের মাথায় আমার প্রিয়ার সত্য কথাটিও বের হলো তড়িৎ গতিতে। খেলাম জীবনের অন্য এক ধাক্কা।

এর আগেই বলে নিচ্ছি, আমার জ্ঞানের ভান্ডার সমৃদ্ধ না হলেও আমার সনদপত্রের ভান্ডার বেশ ভারি হয়ে এলো মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে। তাই আগের পাওয়া ধাক্কাটা কিছুটা সামলে নিয়েছিলাম। কিন্তু আবেগীয় ধাক্কা যে কেবল এবারই শুরু।

তার মুখশ্রী মলিন হলো মুখের একটি কথায়। ‘আমি বিবাহিতা। ক্লাস এইটে আমার বিয়ে হয়ে ছিল। চলবে আমাকে তোমার?’

প্রথমে যদিও চালাতে গিয়ে ইতস্তত হয়েছিলাম, পরে অবশ্য ভেবে নিয়েছিলাম চলবেনা কেন দৌড়াবে। আর এই ভাবনাকেও প্রাইওরিটি দিতে চাইলাম। তবে সে আর আমার কথা শুনতে যাবে কেন? যে সর্বদা নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়েছে, আমার কথা এতো বেশী রসালো ছিলো না যে তা আহ্লাদে গদগদ হয়ে মেনে নিতে হবে। সেটাই হলো, বিয়ে করে ফেললো তার মতো একজনকে। তার মতো বলার কারণ, সে যাকে বিয়ে করলো সেও বিবাহিত। তবে একথা তার কাছে গোপন করেছিল। পরে সে জানতে পেরেছিল। ধাক্কা শুধু আমি একা খেলাম না, সেও খেলো।

হয়তো আত্মবিশ্বাসের কিছুটা টনক নড়েছিল তখন। ধীরে ধীরে সবদিক থেকেই বাস্তবতাকে মনে প্রাণে ধারণ করতে শুরু করলাম। প্রায় প্রতিনিয়তই নতুন করে চিনতে শুরু করলাম আমার এই আমিকে। চিনলাম আমার এই শহর, আর পরিবেশ ও এখানকার মানুষগুলোকে। সেখানেও অনেক ঘাটতি ছিল আত্মবিশ্বাসের। যাকেই খুব প্রাণপনে আপন ভেবে নিয়ে কাছে টানতে চাইলাম; বন্ধু ভেবে যাদের বুকে ঠাই দিতে চাইলাম। বন্ধু হলো বটে আমার সুসময়ে। সার্থ উদ্ধার হলো আর মাঝায় লাথি মেরে মেরে চলে গেল। সেজন্যই বোধ করি আমার লাম্বার স্পাইনটা ধীরে ধীরে দূর্বল হয়ে গেল। ইদানিং উঠতে-বসতে খুব সতর্ক হতে হয় আর অনুমতি নিতে হয় এর কাছে।

মাঝে মাঝে অবাক না হয়ে পারিনা, সালার যে শরীরটাকে ত্রিশ বছর ধরে বয়ে নিয়ে বেরাচ্ছি, তাও আমার সাথে বিট্রে করতে শুরু করেছে। আমার অন্ধ অহমিকার পতন হতে শুরু করলো সেদিন থেকে যেদিন থেকে বলতে শিখেছিলাম আমি না খুব সহজে অসুস্থ হইনা। “শরীরের নাম মহাশয়, যাহা করবে তাহাই সয়।” এই কথাটা আর আমার ক্ষেত্রে মানিয়ে নিতে পারলনা। জীবন নাকি জীবনের নিয়মেই চলে? হ্যা, মস্ত বড় সান্ত্বনা আমার সামনে। সেটাকে মাথায় রেখেই ব্যথাটা একটু কম বোধ করি।

আমার আত্মীয় স্বজনরা আমার বেশ প্রশংসা করতো। বলতো, ‘তোর জীবনে তুই অনেক সফল হবি। সাফল্যের সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌছাতে পারবি।’ কথায় কথায় যে কম আপ্লুত হয়েছি তা নয়। দুর্ভাগ্য এই যে, সফল এর ‘স’ টা আমার ছিল ‘ফল’ টা হলো না। সসম্মানে সম্মান পাশ হলো বটে, অসম্মানেও একটা ভাল চাকরি জুটলো না। ভেবে তো নিয়েছিলাম, পাশ করার সাথে সাথেই কিছু একটা হয়ে যাবে। তবে হ্যা, কিছু তো হলো। এই যে চাকরি না হওয়া। পরিবারের মানুষদেরও কী ভরসা আমার উপর ‘এত ভাল রেজাল্ট যার, তাকে কি চাকরি পেতে কাঠঘর পোহাতে হবে? দেখবি আমাদের ছেলে পাশ করার আগেই.....।’


পাশ করার আগেই ছেলে উদ্ধার করে ফেলবে। ভেবেই নিয়েছি হবেনা আমাকে দিয়ে কিছু। ঘোড়ার ঘাস কাটাও হবেনা। বড্ড রেগে গেলে নিজের প্রতিই ক্ষিপ্ত হই আমি। পৃথিবীতে অসংখ্য মানুষ থাকে যাদের সুযোগের অভাবে অনেক কিছুই করা হয়ে ওঠেনা। পর্যাপ্ত যতটুকু সুযোগ ছিল, তার মধ্যে হয়তো অনেক কিছু করা অসম্ভব ছিল না। কিন্তু পারলাম না। কারণ দর্শালে তো অনেক কিছুই বলা সম্ভব। কেবল অজুহাত দেওয়া হবে।

আমাকে যতটা বিশ্বাস করতো আমার ফ্যামিলির লোকজন, আমিও ততটাই ভরসা করতে পারতাম তাদের উপর। সেকারণেই তো জীবনের বড় সিদ্ধান্তটা নিজে না নিয়ে তাদের উপরই ছেড়ে দিলাম। ওনারা যেটা করবেন,সেটা কি আর আমার খারাপের জন্য করবেন? নিশ্চয়ই না। আসলে ওনারা সবসময় ভালই চান। কিন্তু গতানুগতিক বিদ্যার দৌড় সংক্ষিপ্ত হলে যে পরিকল্পনায় খুব বেশী দূর যাওয়া যায় না। আমি সাধারণ হতে গিয়েও তো খানিকটা সাধারণত্ব থেকে ছিটকে পড়েছি।

নিজেকে অসাধারণ ভাবছি তা নয়। হতে পারে তা অস্বাভাবিক। কারণ আমার পরিবারের লোকজনের বিদ্যার দৌড় সংক্ষিপ্ত। তাদের পরিকল্পনা ও ভবিষ্যত ভাবনাগুলো সর্বদা বর্তমানকে ঘিরেই থাকে। যা ভাল হয় সেটা বিধাতার অশেষ কৃপা আর যা কিছু খারাপ ঘটবে, তা দুর্ভাগ্য বলে চালিয়ে দেওয়া তাদের সাধারণ বিষয়। আর তাই তাদের মাঝখানে আমার সামান্য জ্ঞানটুকু অসামান্য সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে।

ডজনখানেক মেয়ে দেখাদেখি শেষ হলেও আমার সাথে সাদৃশ্য পাওয়া কঠিন। শেষ পর্যন্ত দায় সারানোর মতো হুট করেই পছন্দ করে ফেলা হলো একটি মেয়েকে। আত্মবিশ্বাসতো তাদের প্রতি আমার আছেই। রাজি হয়ে গেলাম। টের পেলাম। সাধ মিটে গেল। বুঝলাম আবারো হেরে গেলাম। আর তাকে হারিয়েও ফেললাম। মানাতে পারছিলাম না যে । কি করবো।

তবুও জার্নিটা হার না মানা করতে চেয়েছিলাম। জগতের আনন্দময় ইলিমেন্টগুলোকে খোঁজ করতে শুরু করলাম। একেবারে যে পাইনি তা কিন্তু নয়। তবে আবেগের মেঘগুলো মাঝে মাঝে এতটাই ভারী হয়ে ওঠে যে, বৃষ্টির মতো কান্না করেও নিবারণ করা যায় না। একটা কথাই বলতে ইচ্ছে করে, জেতার নেশা তো ছিলনা আমার। শুধু বাঁচতেই তো চেয়েছিলাম। তাহলে কী “আপনা মাংসে হরিণা ভৈরী”। আমার বড় শত্রু আমার আত্মবিশ্বাস। আর তার থেকে বড় শত্রু আমার আমি নিজেই।

No comments:

Post a Comment

Thanks for your comment