একটি স্মৃতির স্বপ্ন
মোঃ অলিউল্লাহ্
মেঘনা নদীর তীরে বসে অঝড়ে কাঁদছে নির্জনী। তার অদূরেই মিলিত হয়েছে মেঘনা ও গোমতী নদী।একটা ঝোপ ঝাড়ে বসে আছে সে। কিছুক্ষণ পর পরমশামাছির উৎপাত। বয়স একুশ কিংবা বাইশ।জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্রী সে। গায়ের রং ফর্সা, মাথায় অগোছালো চুল। কাশবন হতে ছুটে আসা বাতাসের সাথে দুয়েকটা কাশফুল তার এলোচুলে শোভাবর্ধন করছে। মশা- মাছির উৎপাতে চলে যাওয়ার উপক্রম হলেও কাশফুলেরউড়ে এসে চুলে পড়াটা তার কাছে কিছুটা আনন্দের বটে।হঠাৎ কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ শুনে এদিক-সেদিক ভয়ার্ত চোখ নিয়ে তাকাচ্ছিল।
আর তখনি চোখে পড়ল অমির দিকে। একটু আগেই যে অঝড়ে কাঁদছিল এখন যেন তা মেঘের কোলে রোধের মতো হাওয়ায় মিশে গেছে। দেখে বুঝা কষ্টসাধ্য যে এ যুবতি কোন কালে কান্না বা তার ভান করেছিল।
অমিকে দেখে তার দিকে তাকিয়ে হাতের তর্জনী উচু করে বলল, ও তুই একটা কুকুর......।
অমি, ওই দুস্ত তুই আমায় কুকুর বললি?
নির্জনী, আরে গাধা আমি বলছিলাম তুই কুকুরের মতো শব্দ করছিস কেন? তুই তো জানিস আমি কুকুরকে ভয় পাই।
অমি হালকা স্বভাবের পাতলা দুইটা ঠোট দিয়ে উচ্চারণ করল ‘তাহলে ঠিক আছে। আসলে এই শব্দটা আমার মোবাইলের রিংটোন।
নির্জনী, ‘তাহলে তো ঠিকই ছিল।’
অমি, কি ঠিক ছিল?
নির্জনী,তোকে কুকুর বলা, অমি, দুস্ত তুই সব সময় আমার সাথে এমন কেন করিস বলতো।
নির্জনী, আচ্ছা ঠিক আছে এখান থেকে দ্রুত চল। জায়গাটা বেশি নিরাপদ না। যে কোন সময় পুলিশ এখানে আমাদের হানা দিতে পারে। আর ওরা কোথায়?
অমি, ওরা আসতেছে। রুহিত সুপ্রিয়ার সাথে বাইকে করে আর কান্তা, দীপ্তও প্রখর বোটে করে আসতেছে। আর ভয়ের কোন কারন নেই এটাই নিরাপদ জায়গা।
আমি সারা রাস্তায় ভিজিটিং কার্ড ফেলে আসছি।নির্জনী, ভিজিটিং কার্ড কেন?তুইকি নতুন ব্যবসা শুরু করছিস নাকি?
অমি, তুই আসলে সব সময়ই মাথা মোটা। এটা এই সেই ভিজিটিং কার্ড নয়। এতে রয়েছে সয়ংক্রিয় নেটওয়ার্কিং সিস্টেম। এলার্মিং কার্ড দেখতে ভিজিটিং কার্ড এর মতো। এই এলাকায় পুলিশ আসা মাত্র এটা আমার ফোনে সিগন্যাল দিবে।
শুন যা হবার হইছে এবার আমরা ওদের স্বর্ণগুলো ওদের দিয়ে দেই। নির্জনী,কাদের স্বর্ণগুলো? অমি, কেন পুলিশের।নির্জনী, দেখ অমি গর্ধবের মতো কথা বলিস না, হ্যা। স্বর্ণগুলো ওই অফিসারের না এগুলো সরকারের অধীনে থাকার কথা ছিল। এয়ারপোর্ট থেকে ধরার পর একজন অফিসার এটা সরকারি কোষাগারে হস্তান্তর করবে। তা না করে তিনি এগুলো নিয়ে বিয়ে বাড়িতে কি করছিলেন?অমি, কিন্তু এটা তো গেল একটা বিষয় ।
আমাদের তো পুলিশ খুজতেছে বিয়ে বাড়ি থেকে মেয়েকে পালাতে সাহায্য করেছি তাই।নির্জনী, শুন এটা মেয়ে না। এটা আমাদের বন্ধু সুপ্রিয়া।অমি, তো আমাদের বন্ধু বলে কি সে ছেলে হয়ে গেছে? তখন নির্জনী রেগে গিয়ে বলে, তোর মতো বাদরের সাথে কথা বলাই ভুল। অমি, এইতো নিজের উপযুক্ত সঙ্গীকে চিনতে পারলি। ওই যে ওরা এসে গেছে।কিছুক্ষণের জন্য জায়গাটা মুখরিত হয়ে গেল তাদের কোলাহলে, যদিও সর্বদা এখানটা জনশূন্য থাকে।
একদল বন্ধুত্বের সকল দুষ্টমি, পাগলামি আর তার মাঝেঅসাধারণ আনন্দের ঘনঘটা। একজন আরেক জনে সাথে খুনসুটি, খাবার নিয়েকাড়াকাড়ি, ক্যামেরায় ছবি তোলা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছে।এরই মধ্যে দীপ্ত ও প্রখর নদীতে নেমে সাঁতার কাটতে শুরু করল। তা দেখে লোভ সামলাতে পারলনা কান্তাও।
ইচ্ছে মতো ডুবু-ডুবি ও সাতার কাটার খেলা চলতে থাকল। আর তখনি বাজল বিপদের ঘন্টা।অমির ফোন সিগন্যাল দিচ্ছিল। অমি ও তাড়াতাড়ি ওঠে আয় আমাদের এখনি পালাতে হবে।দীপ্ত, প্রখর ও কান্তা ভেজা শরীর নিয়ে ওঠে এলো।অমির দৃষ্টি পড়ল কান্তার দিকে।কান্তার পড়নে ছিলএকটি জিন্স পেন্ট ও সাদা টি-শাট। ভেজা টি-শার্টের আড়ালে বক্ষবন্ধনীর ভিতর তার সুপ্ত যৌবন ওকি মারছিল। ডালিমের দানার মতো তার দাঁতগুলো। সমস্ত দেহ যেন প্রশান্তির আবাসস্থল। একমূহুর্তের জন্য অমিকে যেন ভার্চুয়াল হেভেন স্পর্শ করে গেল।
পরক্ষণে সবাই খুব দ্রুত দৌড়াতে শুরু করল।
কিন্তু হঠাৎ দীপ্ত বলল, এই দাড়া দাড়া, আমি আর পারছিনা।
প্রখর, কিরে কি হয়েছে তোর?
দীপ্ত, দুই নম্বর।
প্রখর,সালা এই মূহুর্তে তোর দুই নম্বর পেতে হবে? কেন যখন সবার কাছ থেকে জোড় করে খাবার কেড়ে নিয়ে গেলি, তখন মনে ছিলনা? দীপ্ত,সালা তোরা আমার বন্ধু না বন্দুক?
কারো বিপদের সময় এমন করে বলতে হয়?সামনে থেকে অমি ডেকে বলল,কিরে প্রখর কি হলোতোদের?
প্রখর অমিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখালো দুই।আর কান্তা ও নির্জনী হাসি থামাতে পারলনা। যদিওভয়ে প্রত্যেকেই আত্মহারা।
শেষে অনেক দূর পথদিয়ে ঢাকা-কুমিল্লা মহাসড়কে গিয়ে ওঠলো।কিছুক্ষণ বিশ্রামের অবকাশ পেল তারা।
আর এই সুযোগে অমি হারিয়ে গেল সোনালী স্বপ্নে। এক পাহাড়ের চুড়ায় কান্তার যৌবন লাবন্যের কাছে পরাজিত হয়ে গোলাপের পাপড়ির মতো দুটি ঠোটের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেল তার মুখ। তখনি পিছন থেকে এক পুলিশের লাঠির আঘাত প্রাপ্ত হল।পুলিশ বলল, এটা প্রেম করার জায়গা নয়।এটা পুলিশ ফাঁড়ি।মূলত প্রখর অমিকে ঘুম থেকে জাগানোর জন্য বলছিল, অমি ওঠ, এটা পুলিশ ফাঁড়ি। অমি ঘুম থেকে থেকে লাফ দিয়ে ওঠে বলল, স্যার আমি কিছু করিনি স্যার। আমায় মারবেন না স্যার।তার এই দৃশ্য দেখে সবাই না হেসে পারল না।
অতঃপর কগ্রামের ভিতর দিয়ে হাটতে শুরু করল তারা।অমি দেখল তার বাল্যবন্ধু সামন্তকে।সে পুলিশের এসআই।সামন্ত অমিকে দেখেই বুকে টেনে নিল।সাথে সাথেতাদের আরো চার বাল্য বন্ধু এসে হাজির।সুশীল, প্রকাশ, নিজুম ও সুশ্মিতা। এরা মূলত সামন্তের এখানে বেড়াতে এসেছে।প্রত্যেকের হাতে নানা ধরনের ফল। কারো হাতে পাকা কলার ছড়ি,কারোহাতে পেয়ারা, কারো হাতে আতা এবং অন্যজনের হাতে কচি ডাব।তখন অমি বলল, তোদের হাতে এসব কেন? প্রকাশউত্তর দিল তুই ভুলে গেছিস ছোট বেলায় আমরা কত বাগানের ফল, কত বাড়ির মুরগি আর কত পুকুরের মাছ চুরি করে খেয়েছি?
অমি, সালা এসব কি ভুলা যায়। এগুলো তো স্মৃতিরপাতায় পাতায় গাঁথা। কিন্তু তোরা কি এগুলোও চুরিকরে এনেছিস?প্রকাশ, কেন তুই খাবি না?তখন সুশীল বলল, অমিই চুরির জিনিস খাবেনা? একটু পর দেখবি নিজেরটা শেষ করে তোরটাও শেষ করছে।মনে নেই ছেলেবেলার কথা?ওদিকে দীপ্ত, প্রখরওনির্জনী ওদের দিকে তাকিয়ে তামাশা দেখছিল আর ভাবছিল আমাদের কি বিপদ আর ও আছে তার আনন্দ নিয়ে।এইভেবে তারা হাটতে শুরু করলো অভিমানে।এমন সময় সামন্ত এসে বলল, কি রে ভাই তোরা কোথায় যাচ্ছিস।
আরে তোরা অমির বন্ধু মানে আমারও বন্ধু। কতদিন আনন্দ করি না। চল সবাই।এই বলে শুরু হয়ে গেল চুরির ফল খাওয়া।এখানেএমন পরিস্থিতি হল যে কে পুরাতন বন্ধু আর কে নতুন বন্ধু তা বুঝা দুঃসাধ্য। সবাই মিলে একাকার। আনন্দ, হৈ চৈ, কারো হাতে গিটারের সুর, কারো হাতে বাশির সুর, কারো কন্ঠে গান আবার কারো হাতে পাতিলের তবলা। অন্যদিকে কেউ কেউ নাচতে নাচতে আত্মহারা।কত যে আনন্দের সমারোহ তাদের তা অপ্রকাশ্য।
কিন্তু যখন সন্ধ্যা হল তখন সবাই খুব চুপচাপ হয়েবসে আছে। সামন্ত অমিকে জিজ্ঞাসা করল কিরে কোন সমস্যা?অমি, হ্যা দুস্ত। অনেক বড় সমস্যায় আছি আমরা।তারপর সবকিছু খুলে বলল সামন্ত কে।সামন্ত কয়েক জায়গায় ফোন দিলেন। সবাই খুব কৌতুহলী হয়ে তাকিয়ে রইলো সামন্তেুর দিকে। অবশেষেদেখল সামন্তের মুখে একটা বিমর্ষতার ছাপ।
সবাইকেমন স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে রইলো।অমি দুঃচিন্তায় কাঠ হয়ে যাওয়া গলা আস্তে আস্তে বলল, কিরে, কিছু হলো?সামন্ত কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলল, নাহ.....না বলার সাথে সাথে প্রত্যের চোখের কোণে জল আসার উপক্রম।আর তখনি সামন্ত পুরো বাক্যটা শেষ করলো, নাহ আর কোন সমস্যা নেই।শুরু হয়ে গেল হৈ-চৈ।পরক্ষণে সামন্ত বলল, তবে......।অমি, তবে কি সামন্ত? সামন্ত, তবে তোরা যে স্বর্ণগুলো নিয়েছিলি সেগুলোর কথা........।
অমি, সেগুলোর কথা কি বল?সামন্ত, সেগুলোর কথা ধামা-চাপা পড়ে গেছে।এই কথা শুনেই সবাই অমি কে কাঁধে তুলে নিল।অমি শরীরে কাতুকুতু দিয়ে হাসতে থাকলো।আর ঠিক তখনি অমি ঘুম থেকে লাফ দিয়ে উঠল।আর দেখল তার লুঙ্গির ভিতর একটি তেলা পোকা ঢুকেছে কিন্তু কিছুক্ষণ পর ভাবল স্বপ্নের সকল কথা।
No comments:
Post a Comment
Thanks for your comment