Thursday, September 5, 2019

ছোটগল্প - দু’ফোটা জল || মোঃ অলিউল্লাহ্


একটা হৃদয়ের নির্জনতার গভীরতা কতটুকু? অতীত-বর্তমান-আর ভবিষ্যতের পথ চলার গতিসীমা কতটা নিয়ন্ত্রণহীন হলে একটা সুন্দর জীবনের পথচলাটা হয়ে যায় এলোমেলো।  দু’টা লাইন লিখতে প্রায় অনেক সময় লেগে গেল।না আমাকে দিয়ে কি হবে আমি নিজেই জানি না।আমার নামটাই জীবন কিন্তু জীবনের যে রূপ তাকে চেনা হলো না ভালোভাবে।  সন্ধা হয়ে এলো,  চারিদিক কেমন স্তব্ধতায় মুখর হতে চলল। দশটা বছর প্রকৃতির নিয়ম বহির্ভূত সামাজিকতার পরিমল ছেড়ে আমি একাকী এ বনারণ্যে বসবাস করছি।  আমি অসামাজিক হল্ওে কিছু সামাজিক রীতি-নীতি বা আচার-অনুষ্ঠান মনে করিয়ে দেয় যে,  এখানে আমার জীবনের এতগুলো বছর কাটলো।  ঠিক যেমনটি হতে যাচ্ছে দুইদিন পর।  ঈদুল ফিতর।

এই অসামাজিক মানুষটার সাথে এ সংসারের অনেক মানুষের আন্তরিকতার সম্পর্ক গড়ে না ওঠলেও দু’চার জন মানুষ আছেন এখানে,   যাদের সাথে আমার সামান্য কথা-বার্তা হয়।  একদিক থেকে বলতে গেলে তারাও আমার মতোই অর্থাৎ নিঃসঙ্গ শুধু গৌরি দিদি ছাড়া।  কারণ তার একটা ফুটফুটে সুন্দর মেয়ে আছে । বয়স পাঁচ বছর। বিপ্লব দাদু একা মানুষ।আমার বসত বিটা থেকে তার এখানে যেতে পনের মিনিটের পায়ে হাটার রাস্তা।তার আসল নাম মনসুর,  মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে সাহসিকতা দেখিয়েছিল বেশ ।


যার ফলে তার নামের বানানটি পরিবর্তিত হয়েছে,  তার সাথে নামটিও। তবে তার কাছ থেকে শুনেছি,  সে মানুষের সামনে যতটাই সাহসী ছিলেন অগোচরে ছিলেন তার চেয়ে বেশী ভীতু। শুধু মানুষের সামনে গলা ফাটিয়ে পাকিস্তানিদের গালাগাল আর তিরস্কার করাটাই তার বিপ্লবীর সূত্রপাত। তবে একথা সত্যি যে তিনি মনে-প্রাণে চাইতেন ও বিশ্বাস করতেন এদেশ একদিন স্বাধীন হবেই।  


তার দেহের জোর হীণ হলেও ছিল প্রকট মনের জোর। একরাতে তিনি নাকি একটা জঙ্গলে গাছের নিচে পাহারারত ছিলেন কিন্তু মারাত্মকভাবে মশার কামড় খেয়ে বাড়ির দিকে দৌড়াতে শুরু করলেন। আর মুখে বলতে লাগলেন ‘‘লাগবেনা আমার দেশ স্বাধীন করা।  কোনো রকম জীবন বাঁচিয়ে বাড়ি যাই।” আর তখনি মিলিটারির পায়ে চলার শব্দ পেয়ে দিলেন বিপরীতে দৌড়।  হাঁপাতে হাঁপাতে গিয়ে পড়লেন এক ঘুমন্ত মুক্তিসেনার উপর।  জাগিয়ে তুললেন সবাইকে ।   শুরু হলো মেঘের গর্জনের মতো গুলির শব্দ। 


একে একে সকল পাকিস্তানি সেনাদের সেখানে হত্যা করলেন।  আর তখনই মনসুর নাম থেকে তার নাম হলো বিপ্লব।  তিনি খুব রসিক মানুষ।  যতক্ষণ সময় তার পাশে থাকি মনে হয়না আমি একা।  তবুও আজ আমি একা,  বড্ড নিঃসঙ্গ একটা মানুষ।


ঘরের বাহির থেকে ডাক পড়লো,  

সুমন- জীবন ভাই,  জীবন ভাই,  ও জীবন ভাই।  
জীবন-কে?  সুমন? সুমন- হ,  ভাই।  
জীবন-আসো,  ঘরে আসো।  
সুমন- কি ভাই কেমন মানুষ বলেন তো? জীবন- কেন বলতো
সুমন- “কেন?  সন্ধ্যা হয়ে গেছে,  অথচ আপনি অন্ধকার ঘরে বসে আছেন।”

জীবন - খানিকটা হেসে বলল “একা মানুষের কিসের আলো আর আধাঁর! হঠাৎ এমন সময়,  কেন এসেছো?”

সুমন- “ভাই আপনি আজ নিজেকে একা বলছেন,  তাহলে আমি কি বলবো? বারবার আপনিই তো আমাকে সান্ত্বনা দিয়েছেন।” সুমনের চোখ দু’টো যেন আঁধার হয়ে আসলো।পরক্ষণেই বলল-“ভাই একটা খবর আছে।  ”

জীবন- “কি খবর?”

সুমন- “ভাই কিছুক্ষণ আগেই শুনলাম বর্ডার পেরিয়ে নাকি অনেক চোরা চালান আসছে।  আর এসব নাকি মদ আর হেরুইন।  দুইদিন পর ঈদ,  তাই এদের এসব কাজ বেড়েই চলেছে।”

জীবন- “খুব ভাল খবর সুমন। তুমি অবস্থান নাও।আমি আজ রাতে আসছি।”

জীবন ও সুমন দুজনই খুব একা।এরা ভারতের সীমান্তবর্তী একটি পাহাড়ি অরণ্যে বসবাস করে।  সেখানে প্রায়ই ভারত থেকে অবৈধ চোরা চালান করা হয়।  আর ওরা দু’জন এসব অবৈধ জিনিস ধরে স্থানীয় থানায় হস্তান্তর করে।  দিনটি শুক্রবার বরাবরের মতো সেদিন ও এরা চোরা চালান ধরে এবং স্থানীয় থানায় গেলে সেখানে দেখতে পায় এক নতুন পরিবেশ।  রাত তিনটা,  এমন সময় সচরাচর থানার সবাই নাক ডেকে ঘুমায় কিন্তু সেদিন গিয়ে দেখলো সবাই খুব তৎপরভাবে দায়িত্ব পালন করছে।


ব্যাপার বুঝতে একটু সময় লাগলেও কিছু পরেই পরিষ্কার হলো যে থানায় নতুন এক মহিলা ইন্সপেক্টর এসেছে।জীবন ও সুমন দু’জনেই সে মহিলাটির সামনে গিয়ে হাজির হলেন।দেখে মনে হলো না যে ইন্সপেক্টরের বয়স তেমন একটা বেশী।নেম প্লেটে নাম লেখা ছিল মেহজাবিন।  জীবন সবকিছু খুলে বলল তাকে। কিন্তু মেহজাবিন খুবই রাগান্বিত চেহেরায় জীবন ও সুমন কে বলল “আপনারা আমার সাথে চলুন।”

জীবন- “কোথায়? ”

মেহজাবিন-“কোন কথা বলবেন না।চলুন। ”

জীবন ও সুমন দু’জনেই খুব চিন্তিত। মেহজাবিন দু’জনকে সাথে নিয়ে গাড়িতে ওঠলো এবং খুব দ্রুত গাড়ি চালাতে লাগলো।  পিছনের সিটে ঘুমে হেলে-ধুলে পড়ছে একজন আরেকজনের উপর সুমন ও জীবন।আর মাঝে মাঝেই মাথায় মাথায় ধাক্কা খেয়ে ঘুম বিঘ্নিত হচ্ছে।দু’জন-দু’জনের চোখের দিকে সামান্য তাকিয়েই সামনে মেহজাবিনের দিকে চোখ ফেরায় অতঃপর আবার ঘুমে নিমগ্ন হয়।  আর তাদের অন্তরে রয়ে যায় একটি ভয়,  কী যেন আছে কপালে।সকাল হতেই গাড়ি পৌছলো ঢাকা ধানমন্ডি থানায়।  

সেখানে মেহজাবিন গাড়ি রেখে ওদের দু’জন কে তার বাসায় নিয়ে যায় কিন্তু তখনও জীবন গভীর ঘুমে নিমগ্ন যদিও সুমন জেগেছে।  সুমনের কাছে সকল ঘটনা বিস্তারিত শুনলো মেহজাবিন।তারপরই শুনল জীবন এর সমস্ত জীবন কাহিনী।জীবনের জন্ম ঢাকার নাখালপাড়া রেল লাইনের পাশে একটি বস্তিতে।  তার মা ছিলেন প্রস্টিটিউট।এরপর সে কিভাবে বড়হল কিভাবে বন্য জীবন শুরু হল তা আলোচনা হবে।  


অতঃপর জীবনের জন্য আসে এক অসাধারণ স্বপ্ন।  সরকার তাকে সুযোগ করে দেয় সুখে বসবাস করার, আর সে জন্য তাকে একটি বাড়ি দেয়া হয়।  কিন্তু সে এসবে তৃপ্ত নয়; বরং অরন্যজীবনই এই জীবনের সবচেয়ে সুখি মনে হয়।  তবে বহু ভাবনার দু’ফোটা জল বেয়ে পড়ে জীবনের চোখ দিয়ে।  সে জানে না এ জল সুখের, না  দুঃখের। 

No comments:

Post a Comment

Thanks for your comment