Thursday, October 15, 2020

তোমার অস্তিত্ব এখনো বিদ্যমান

 সেই প্রথম উপলব্ধি আমার যখন তুমি নিরক্ষর হয়েও আমায় অনেক কিছুই শিখাতে শুরু করলে। তোমার আমার সম্পর্কটা সামান্যও দূরত্বের ছিলনা। যদিও আমার আগে তুমি আরো সাতজনকে এই পৃথিবীর আলোতে করেছো আলোকিত। আমার মনে পড়ে, ধীরে ধীরে শৈশব পেড়িয়ে কৈশরে প্রবেশ করলেও আমি তোমার আচল ছাড়িনি। তুমি আমায় ছেড়ে দাও নি একেলা, যেভাবে অন্যান্যদের পথ চলতে কিছুটা ছেড়ে দিয়েছিলে। তুমি প্রাকৃতিক আধুনিকতায় অসম্ভব আধুনিক ছিলে, কিন্তু প্রথাগত ও রীতিসম্মত আধুনিকতার ধার ধারনি। প্রকৃতি তোমায় আমার প্রতি একটু বাড়তি যত্নশীল করেছিল বলেই আমার মধ্যে তুমি নতুন আবিষ্কার করতে চেয়েছো।


এতো আবেগী তুমি আর এতো বেশী সংবেদনশীল যে আমার সামান্য অসদাচরনেই মারাত্মক বেদনাবোধ করতে। আবার আমার অতি তুচ্ছ চাহিদাগুলোকেও অত্যাধিক গুরুত্ব দিয়ে তা পূর্ণ করবার তাগিদে ওঠে পড়ে লাগতে। আমি অভাবের ভাবটা বুঝবার আগেই কেমন যেনো তুমি বুঝে যেতে এটা আমার দরকার। অপ্রতুল সব ইচ্ছা পূরণে যখন তোমার কাছে একটার পর একটা বায়না ধরতাম, আমি দেখেছি তোমায়, কী করতে তুমি তা পাইয়ে দিতে আমাকে। আমি দেখেছি কত মানুষের কত অপবাদ ও কত যাতনা সহ্য করেছো আমার জন্য। কিন্তু আমি জানতে চায়নি কেন এতসব করছ আমার জন্য। আর আমার এটাও সঙ্কা ছিলো যে, তুমি আমাকে সাফল্যের চূড়ায় অবতীর্ণ করলেও তার বিনিময়ে আমি তোমায় কিছুই দিতে পারবোনা।


আমার আসঙ্কাগুলো সত্যি হোক তা আমি চাইনি মন থেকে। কিন্তু তুমি সেটাই করলে, যেটা আমার অবচেতন মন বলে দিয়েছিলো। আমাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করেছো, আমি যেখানেই থাকতাম। প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত তুমি আমার মধ্যে বিরাজ করেছো, যদিও তোমার আরো সন্তানেরা বিদ্যমান ছিলো। সবার প্রতিই সমান মনোযোগ তোমার, তুমি বলতে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করতাম না, যেভাবে বিশ্বাস করেনি তোমার অন্য সন্তানরা। তারা ভাবতো সবচেয়ে বেশী আমাকেই ভালোবাসো। আমিও তাই বিশ্বাস করতাম। কেন জানি আমাকেই তুমি নির্ভরযোগ্য ভাবতে সব সময়।


আবার আমার সকল প্রয়োজনে, বাবা ও মায়ের দায়িত্বটা তুমি একাই নিয়ে নিতে। সেই আদীম ও অনাধুনিক মা কিভাবে উচ্চ শিক্ষিত মায়ের চেয়েও বেশী যত্নশীল হয়ে ওঠতে পারে সেটা তোমায় হারিয়ে বুঝতে পেরেছি। ছোট একটা অপারেশনে আমি একসপ্তাহ হাসপাতালে ছিলাম। আর কাউকে সেখানে পাইনি, তোমাকে ছাড়া। তুমি সর্বদা নিজেকেই আমার জন্য নির্ভরযোগ্য করে রাখতে। আর তুমি জানতে তোমাকে ছাড়া আমি, আমার অন্য ভাই বোনেরা খুবই অসচল। তুমি ততদিন রয়ে গেলে যতদিন আমরা নিজেদের দায়িত্ব নিজেরা নিতে পারি।


কিছু অসাধারণ অভ্যাস ছিল তোমার, যা তুমি আমাদের শিখাতে চেয়েছো। তোমার কিছু গুণাবলী স্বভাবজাতভাবে আমরা পেয়ে গেছি। কিন্তু তুমি মহান রাব্বুল আলামিনের কিছু বৈশিষ্ট খুব যত্নে আকড়ে ধরেছিলে, প্রবল সমস্যাতেও যা কিঞ্চিত নড়ভড়ে হয়নি। আমার ধ্যান ধারণা এই পৃথিবীর বিলাসীতা, আড়ম্বর ও সৌখিনতায় পৌছেগিয়েছিল। আর সেই অবস্থায় তুমি আমায় পৌছে দিয়েছো। কিন্তু নিজেকে তুমি করে রেখেছো স্বভাবজাত অভাবী, অনাহারী, অসহায় আর প্রচন্ডরকমের ধর্মভীরু। আমি ভাবতাম তুমি ধর্ম নিয়ে একটু বাড়াবাড়িই করছো, ধর্মকে এতো মানার কি আছে (আল্লাহ আমায় করুক)। কিন্তু তুমি সমস্ত কাজ করে, চিন্তা ও সকল দায়-দায়িত্ব পালন করেও সৃষ্টি কর্তার শুকরিয়া গোজার করা ও প্রার্থনায় নিজেকে ব্যস্ত রাখতে দ্বিধান্বিত হওনি। 

সৃষ্টিকর্তার নিকট তোমার সমুন্নত ও সুউচ্চ প্রাপ্তি কামনা করছি। আমার পাপ মুখে তোমার মঙ্গল কামনা করছি। যা তুমি করে গিয়েছি পরকালের জন্যে সেসব যেনো সামান্যও বৃথা না যায়, বরং আল্লাহ তায়ালা যেন তোমার সমস্ত চেষ্টার জন্য অতিরিক্ত সওয়াব বরাদ্দ করে তোমায় জান্নাতের সমুন্নত আশ্রয়ে অবতীর্ণ করেন। 

আমি তোমার চলে যাওয়াটাকে স্বাভাবিক মনে করছিনা কোনভাবেই। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার কোন ইচ্ছাকেই উপেক্ষা করার সাহস আমাদের নেই। তিনি অবশ্যই তোমাকে তোমার যথার্থ মর্যাদা দিয়েছেন এই পৃথিবীতে আর তেমনই পুরস্কার হয়তো দিবেন আখিরাতে। সারা জীবনে তোমার যে যন্ত্রণা, তোমার শ্রম ও তোমার সকল ত্যাগের পরিমাণ হিসাব করলে নিজেকে কোনভাবেই তুলনা করতে পারিনা। একজন নারী হয়ে তুমি যা কিছু করেছো, আমি তোমার সন্তান- একজন পুরুষ হয়ে সেই সবের অর্ধেক ও করতে অক্ষম। 

তোমার চলে যাওয়ার পর থেকেই তুমি বার বার ফিরে আসো আমার কাছে। একেকরাতে একেকভাবে তুমি স্বপ্ন হয়ে আসো। প্রথমদিকে তোমার আগমণ আমায় সান্ত্বনা দিতো। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে ততই আমি বিরহ কাতর হচ্ছি। আমি বুঝতে পারছি, যেভাবে তোমার অস্তিত্ব আমায় ঘিরে ছিলো যতদিন তুমি ছিলে, এখনো তোমার অস্তিত্ব আমায় সেই ভাবেই অনুসরন করছে। মাগো কেন চলে গেলে? আমার যে বড্ড একা লাগছে মা। তোমায় ছাড়া কি করে থাকি, তুমি কী দেখছো না?

No comments:

Post a Comment

Thanks for your comment