Saturday, June 11, 2022

জ্ঞানার্জনের অন্তরায় বা প্রতিবন্ধকতা

 

জ্ঞান অর্জন বা পড়াশোনা কেনো করবেন?

(৪র্থ পর্ব)

জ্ঞানার্জন বা পড়াশোনা কী আসলেই অনেক কঠিন কাজ?

মোঃ অলিউল্লাহ্


জ্ঞানার্জনের  অন্তরায়সমূহঃ

পড়াশোনা করতে গিয়ে শিক্ষার্থীরার ছাত্রজীবনে যেসকল সমস্যার সম্মুখীন হয় তা নিম্নে আলোচনা করা হলোঃ

৬. শিক্ষার মূল্যবোধ কমে যাওয়া ও শিক্ষিত ব্যক্তিদের মূল্যায়নের অভাবঃ বর্তমানে শিক্ষা ব্যবস্থার বেশ কিছু সিস্টেমেটিক সমস্যা রয়েছে। যেমন- গতানুগতিক ধারায় সাধারণ শিক্ষায় ছাত্র-ছাত্রীদের অধ্যয়ন করা। বিশেষ করে, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও ব্যাংকিং সেক্টর বাদে প্রায় সকল শাখাতেই শিক্ষার্থীরা উচ্চ শিক্ষা লাভ করেও ভালো কোন পেশায় নিযুক্ত হতে পারেনা। যেহেতু আমাদের দেশে কর্মসংস্থানের অভাব রয়েছে, তাই শিক্ষার্থীদের সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি তথ্য-প্রযুক্তি ও কারীগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারলে শিক্ষাজীবন শেষে ভালো কর্মক্ষেত্রে নিযুক্ত হতে পারতো। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করার পরও পেশাজীবনে সফলতা পায়না, অথবা নিম্নমুখী জীবনযাপন করে। অন্যদিকে লেখাপড়া না করেও অনেক মানুষ ব্যবসায় বা টেকনিক্যাল কাজে দক্ষতার দ্বারা অধিক উপার্জন করতে সক্ষম হয়। আর তাই  আমাদের সমাজে শিক্ষিত ব্যক্তিদের প্রতি মূল্যবোধ কমে গেছে এবং তাদের গুরুত্বও কমে গেছে। যেহেতু টাকাই মানুষের জীবনের কেন্দ্রবিন্দু সেখানে অল্প আয় করা শিক্ষিত ব্যক্তিদের সম্মান নাই বললেই চলে। এছাড়া এদেশে হাজার হাজার শিক্ষিত ব্যক্তি বছরের পর বছর বেকার হিসেবে জীবন কাটায়, তাই শিক্ষার ব্যাপারে অভিবাবক ও শিক্ষার্থীদের  উদ্বিগ্নতা ও অনিশ্চয়তার কোন অবকাশ নেই। যেকারণে শিক্ষার প্রতি তাদের অনাগ্রহ ও আপত্তি তৈরি হয়।

৭. সুদক্ষ শিক্ষকের অভাবঃ সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে সমাজের সকল ক্ষেত্রেই পরিবর্তন সাধিত হয়। আর সেই পরিবর্তনের সাথে যখন কোন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা খাপখাইয়ে নিতে না পারে তখন তার প্রভাব শিক্ষার্থীদের উপর বর্তায়। যেমন- আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় সারা পৃথিবী নিজের যেভাবে পরিবর্তন করছে, সেই ধারায় আমাদের দেশের শিক্ষকদের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। আর সেজন্য কর্মমুখী বা জীবনমুখী শিক্ষার প্রবণতা কম। সুদক্ষ শিক্ষক গড়ে না ওঠার কারনে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় আগ্রহী করা সম্ভব হচ্ছে না।

৮. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি সরঞ্জামের অভাবঃ যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও শিক্ষা সামগ্রীর অপর্যাপ্ততার  কারনে উপযুক্ত শিক্ষা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছেনা। ফলে প্রায়োগিক ও বাস্তবিক জ্ঞান শিক্ষার্থীদের প্রদান করা হচ্ছে না। আর তাই কর্মক্ষেত্রে এদেশের শিক্ষার্থীরা অনেক পিছিয়ে রয়েছে। যেহেতু পড়াশোনা করার পর সকল শিক্ষার্থীই ভালো কর্মক্ষেত্রে যেতে চায়, কিন্তু সঠিক প্রেকট্রিক্যাল নলেজের অভাবে তারা সেই কাজের জন্য নির্বাচিত হয় না। ফলে বেকারত্ব তৈরি হয়।

৯. শিক্ষা কারিকুলামে হালনাগাত ও গবেষণার অভাবঃ এদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় এখনো সেই মান্দাতার আমলের সিলেবাস পরিলক্ষিত হয়। গধবাদা বা গতানুগতি শিক্ষা পদ্ধতির কারনে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে রয়েছে। বর্তমান কর্মক্ষেত্র ও চাহিদামতো শিক্ষাব্যবস্থায় হালনাগাতের অভাবে পুরানো বস্তাপঁচা শিক্ষা প্রদান এখনো শিক্ষার অন্যতম অন্তরায়। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেই আধুনিক শিক্ষা কার্যক্রমের উপর গবেষণার অভাব রয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের উজ্জল ভবিষ্যতকে পিছিয়ে দেয়।

১০. শিক্ষকদের প্রাইভেট বা কোচিং শিক্ষা পদ্ধতিঃ খুবই দুঃখজনক ও হতাশার কথা হচ্ছে, আমাদের দেশে ছাত্র-ছাত্রীদের স্কুল-কলেজে নিয়মিত ক্লাস করার পরও তাদেরকে ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষক নিযুক্ত করে কিংবা কোচিং এ গিয়ে অধ্যয়ন করতে হয়। এটা একদিকে যেমন শিক্ষার্থীদের বাড়তি চাপ, অন্যদিকে বাড়তি টাকা খরচ করতে হয়। আর আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে খুব কম সংখ্যক ব্যক্তিই তাদের সন্তানকে সেই পড়াশোনার খরচের যোগান দিতে পারেন। যাদের টাকা আছে তারা পড়াশোনায় এগিয়ে যায়, আর যার টাকার অভাব সে পড়াশোনা থেকে ছিটকে যায়। এভাবে তাদের স্বপ্ন পূরণে বাধা সৃষ্টি হয়।

১১.  শিক্ষা বিষয়ক প্রচারণার অভাবঃ সারাদেশে বিভিন্ন মিডিয়া অসংখ্য বিষয়ে প্রচার-প্রচারণা করলেও আধুনিক শিক্ষা বিষয়ে মিডিয়ার প্রচারণা খু্বই সীমিত। মিডিয়ার এমন দায়সারা মনোভাবের ফলে জন সাধারণের মধ্যে দিনের পর দিন শিক্ষাক্ষেত্রে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হচ্ছে। অনেকাংশেই শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে অর্থ উপার্জনের জন্য বিকল্প মাধ্যম খোঁজে নেয়।

১২. সামাজিক অবক্ষয়ঃ আমাদের দেশের তরুণ সমাজে যথাযথ তদারকির অভাবে কম বয়সী ছেলে-মেয়েরা বিভিন্ন বাজে অভ্যাসে জড়িয়ে যায়। অসৎ সঙ্গ ও তরুণ ছেলে-মেয়েদের অবাদে মেলামেশার ফলে পড়াশোনায় পুরোপুরি মনোযুগী না হয়ে, ঝগড়া-বিবাদ, আড্ডা দেওয়া, অপ্রয়োজনে খেলাধূলায় সময় নষ্ট করা ও প্রেম-ভালবাসায় জড়িত হয়ে শিক্ষা থেকে দূরে সরে যায়।

১৩. মাদক ও অপরাধ প্রবণতাঃ যুবক ছেলে-মেয়েদের একটা অংশ কোন এক নির্দিষ্ট সময়ে মাদকের সাথে জড়িয়ে যায়। কেউ কেউ আবার বিভিন্ন খারাপ সঙ্গে মিশে অপরাধ কাজে আসক্ত হয়। এসব শিক্ষার্থীদের খামখেয়ালীপনার কারনে অল্প বয়সেই তারা শিক্ষা থেকে ঝড়ে পড়ে।

১৪. আইন ও অনুশাসনের অভাবঃ আজকাল তরুণ সমাজের অবক্ষয় এতোই বেড়েছে যে, তারা না মানে পারিবারিক নিয়ম-শৃংখলা, না মানে সমাজের কোন অনুশাসন। যে কারনে তাদের পড়াশোনায় মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়।

১৫. বৈশ্বিক পরিবর্তনের সাথে তাল মিলাতে না পারাঃ পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করে দেখা যায়, তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা একান্তই শিক্ষার্থীসূলভ। তারা একেকটা স্টুডেন্ট এর নিডব্যসিস সিলেবাস প্রনয়ন করেন। এমনকি তাদের পরীক্ষা পদ্ধতি খুবই প্রেক্টিক্যাল এবং সীমিত। এমনো দেখা গেছে, তাদের মাধ্যমিকের আগে কোন পরীক্ষা-ই নেই। সেখানে শিক্ষার্থীদের পছন্দের ভিত্তিতে তাদের পছন্দসই বিষয়ে পড়ানো হয়। আর তাতে করে কোন এক নির্দিষ্ট বিষয়ে তারা দক্ষতা অর্জন করে এবং ক্যারিয়ারে সেই শিক্ষার প্রয়োগের মাধ্যমে সফলতা অর্জন করে।

অপর দিকে আমাদের দেশে ক্লাস ওয়ান থেকেই ডজন খানে বই পড়ানো হয়। ক্লাস সেভেন-এইটের সিলেবাস ক্লাস ওয়ানেই পড়ানো হয়; যা কিনা কোনভাবেই শিক্ষার্থীদের বোধগম্য নয়। আর ক্লাসটেস্ট, উইক্লি টেস্ট, মানথলি টেস্ট, সেমিস্টার এমন অসংখ্য পরীক্ষায় সারাবছর শিক্ষার্থীদেরকে একধরনের রেটরেইসের মতো চালাতে থাকে। সার্বক্ষণিক পড়াশোনার মধ্যে থাকা ছেলে-মেয়েগুলো কার্য ক্ষেত্রে কিছুই জানেনা। সুতরাং বুঝাই যাচ্ছে আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার গোড়ায় গলদ আছে। আর এমন ভঙ্গুর অবস্থার মধ্যে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য এক মরিচিকার নাম।


১৬.  শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশের অচলাবস্থাঃ এদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, শতকরা পাঁচ ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ শিক্ষার্থীদের পুরোপুরি অনূকুলে নেই। আর এমন পরিবেশে পড়াশোনা করাতে অনেক অভিবাবকরাই শঙ্কা প্রকাশ করেন। শিক্ষার্রীদের নিরাপত্তা, স্বাধীনতা, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা কোনটাই ঠিক মতো খোঁজে পাওয়া যাবেনা।

১৭.  জনসংখ্যা বৃদ্ধিঃ বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেকটা পরিবারেই তিন/চার জন ছেলে মেয়ে থাকে। অধিক সদস্যের পরিবারে সকলের মৌলমানবিক চাহিদা পূরণের পর শিক্ষার জন্য অতিরিক্ত ব্যয় খুবই দুঃসাধ্য। তাই অনেক অভিবাবক শিশু সন্তানকে আয় রোজগারে নিযুক্ত করে দেন। তাতে করে শৈশবেই তাদের শিক্ষা থেকে দূরে সরে যেতে হয়।

১৮. বাল্য বিবাহঃ খুবই সাধারণ একটি বিষয় হলো এদেশে বাল্য বিবাহ। ছেলে-মেয়ের উপযুক্ত বয়স হওয়ার আগেই, তাদেরকে পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়ে বিয়ে দিয়ে দেওয়া। এর ফলে অসংখ্য শিক্ষার্থী মাধ্যমিকের আগেই স্কুল থেকে ঝড়ে যায়।

No comments:

Post a Comment

Thanks for your comment