Thursday, September 19, 2019

চোখের সামনে কষ্টদের আনাগোনা, মোঃ অলিউল্লাহ্

চোখের সামনে কষ্টদের আনাগোনা

প্রলয় কুমিল্লা শহরের একটি এগারো বছরের ছেলে। দুই বছর আগে একটা খুনের অপরাধে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। আমার তার সাথে দেখা হয় কুমিল্লা জেল হাজতে।  ভাবছেন, আমি কে?

ভাবেন, তবে ভাববেন না আমি পুলিশের লোক।  কারণ ওনারা অনেক উন্নত শ্রেণির সরকারী কর্মকর্তা।  বেশ দায়িত্ববোধ কাজ করে ওনাদের মধ্যে।  আর সে দায়িত্ব পালনার্থে আমাকে গ্রেফতার করে কান্দিরপার থেকে।  আমি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের তৃতীয় বর্ষেও ছাত্র।  আমি বলেছিলাম ওনাদের,  যে আমি কলেজে পড়ি।  আইডি কার্ডও দেখিয়েছিলাম।  এক কন্সটেবল আমার কার্ডটি দেখে বলল,  ‘তমাল মাহমুদ! এই তোরা এই মালটাকে গাড়িতে ওঠা।  সালা এই কলেজ পড়ুয়া ছেলেগুলোই যত নষ্টের মূল। ’

আমার কষ্ট হওয়ার কথা ছিল সেই মুহুর্তে,   কিন্তু হঠাৎ একটা অতীতের কথা মনে পড়ে গেল।  স্কুলে পড়ার সময়,  বন্ধুরা আমায় তমাল না বলে প্রায়ই ‘মাল’ বলে ডাকতো। আসলে আমি কান্দিরপার গিয়েছিলাম আমার এক অসুস্থ বন্ধুকে দেখতে। যাওয়ার পরই মুখোমুখি হলা ককটেল বিস্ফোরনের।  যারা ককটেল মেরেছে তারা ততক্ষণে উদাও।  কিন্তু দিশেহারা হয়ে সবার মতো আমিও যখন দৌড়াচ্ছিলাম,  তখন এই মহৎ দায়িত্ববান ব্যক্তিরা আমায় নিয়ে এলো সবচেয়ে নিরাপদ স্থানে প্রথমে থানায়, পড়ে জেলখানায়।  আর সেই সূত্রেই আমার পরিচয় প্রলয়ের সাথে।

  প্রলয় খুব গম্ভীর আর রাগী একটা ছেলে।  তবে মাঝে মাঝে খুব হিউমারিস্টও বটে।  সে গ্রামে প্রাইমারী স্কুলে পড়তো।  তার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু নিলয়।  একদিন স্কুলে গেল দু’জনে।  তখন সকাল আটটা,  স্কুলে আর তেমন কেউ যায়নি তখনো।  সেই সময়ে শিক্ষকরা এসে দেখলেন নিলয়ের লাশ।  তার পাশেই প্রলয় বসে বসে কাঁদছে আর তার সমস্ত শরীর কাপছে।  আমি এখনো মনে করতে পারি সেই মুহুর্তের কথা,  যখন সে আমায় তার কথাগুলো বলছিলো।  তার চোখে-মুখে যেন বিষন্নতার ছাপ আর সারা শরীরের কাঁপনি।  বাকি কথাগুলো সেইক্ষণে  আর শুনা হলো না। 

নিলয় আর প্রলয়ের মধ্যে খুবই মিল ছিল।  আর তাদের এই ভাল বন্ধুত্বে কি ঘটে গেল তাদের শৈশবেই,  তা নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়লো।  আসল ঘটনাটা বললো পরের দিন।  সেই সময়টা ছিল খুবই আশঙ্কাজনক সময়।  দিনদুপুরে সন্ত্রাসী আর মাস্তানী চলতো।  ঠিক সেই দিন সকাল বেলায় একদল পুলিশ কিছু সন্ত্রসীকে তাড়া করলো।  গুলি ছুড়লো।  আর তখন সামনে চলে আসে নিলয়।  প্রলয় তখনো দেয়ালের ওপাশে দাড়িয়ে।  নিলয় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে গলাকাটা মুরগির মতো কিছুক্ষণ ছটফট করে,  পরে চিরতরে হারিয়ে গেল।  যা হলো তা প্রলয় দেখতে পায়নি, তবে পুলিশগুলোর দ্রুত চলে যাওয়া দেখলো।  স্কুলে শিক্ষকরা ভাবলো প্রলয় তাকে হত্যা করেছে।  কিন্তু বুদ্ধিহীনতার কারণে হয়তো এও বুঝতে পারলো না যে, এত কম বয়সী একটি ছেলে গুলি পাবে কোথায় আর তাকে মারবেই বা কি করে? 

অন্যদিকে নিলয়ের বাবা-মা তার ময়না তদন্তে দিতে রাজি হলোনা।  সন্তানহারা বাবা-মায়ের আর্তনাদ শুনে আইনও কেমন নিরব হয়ে গিয়েছিল।  কিন্তু বাবা-মা হারা প্রলয়ের কথাটা কাকতালীয়ভাবে সবাই ভুলে গেল।  এতগুলো দিন কেটে গেল তার জেলখানায়,  কেউ কখনো কোন খবর নেয় নি।  
আমি হয়তো কাল চলে যাবো এখান থেকে।  কিন্তু ভাবতে পারছিলাম না, তার জন্য কি করা যায়।  যতবার তার মুখের দিকে তাকিয়েছি, শুধু একটা চাপা রাগ, ঘৃণা আর কষ্টের ছায়া ভেসে বেড়াতে দেখেছি।  আমি নিজেও জানি না, তাকে আর কয়দিন এখানে থাকতে হবে।

No comments:

Post a Comment

Thanks for your comment