Thursday, September 19, 2019

তবুও আমার আমি

তবুও আমার আমি
মোঃ অলিউল্লাহ্
অনতিদূরের পর্বতন্যায় দীর্ঘ ঘন বৃক্ষের আকাশছোয়া সবুজ পাতাদের মাথা উঁচু করে রাখা বিশালায়তনের সীমানার ওপারেই কিছুটা লালিমা সারা আকাশের গায়ে প্রদীপ জে¦লে আছে।  যদিও চাঁদশূন্য আকাশ; তবুও এক বন্দরের কৃত্রিম আলো ভয়ার্ত স্টেজে আশার আলোর মতো হারিকেনের আলো স্টেজকে কিঞ্চিত আলোকিত করে।  অতন্দ্র বালিকার অগভীর ভাবনার বিপরীতে আজ কেমন তীক্ষ্ম উপলোব্ধি।  স্তব্ধ নিবিড় আর অলস মুহুর্তে তীরবীদ্ধ ঘোড়ার মতো কেমন ছটফট করতে শুরু করলো বালিকাটি।  অতি পরিচিত চঞ্চল,  আত্মবিশ্লেষক ও আত্মসচেতন সেই মানবী- কেমন এক জটিলতর পরীক্ষা নিয়ে ভাবছে।

রাত পোহানোর আর ঘন্টা দু’য়েক বাকি।  লম্বা ও হালকা গড়নের একটি ছেলে- মাথায় কুকড়ানো চুল,  আসক্ত চেহেরা,  হাতগুলো ক্ষুধার্ত বাঘের থাবার মতো। সে বলল- ‘ওই রূমালি,  তৈরি হয়ে নে।  আমরা একটু পরেই এখান থেকে পালাবো। ’

দিগন্তে মিশে থাকা আঁখি দু’টি অত্যন্ত ক্ষিপ্ততায়,  অভিশপ্ত চাহনিতে ছেলেটির পানে তাকায় রূমালি। ভয়ংকর দৃষ্টির প্রতিশোধ মুখর গম্ভীরতা নিয়ে খানিকক্ষণ নিরব থাকলেও,  তৎপরবর্তী বলে ওঠে,  ‘সারাদিন মৃত প্রাণীর মাংস বক্ষণ করেও তোর পেট ভরেনি? আর কি খায়েস বাকি আছে তোর?’
ছেলেটি একবারের জন্য তাকালো বটে; কিন্তু কোন উত্তর খুঁজতে সুবিধে পেলনা।  একটু পরেই ত্রিশ বছর বয়সী এক মহিলা, ঘরে  প্রবেশ করে বলল- ‘শান্ত তুই যা।  আমি দেখছি।  রূমালি,  বোন যা হবার হয়েছে।  আমরা তোকে তোর বাবা-মায়ের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।  তুই ভাবিস না। ’

ঘরের দেয়ালে ঝুলানো ক্যালে-ারটি ফ্যানের বাতাসে নড়ছে।  ক্যালে-ারের লম্বা লম্বা ভবনের ছবিটা যেন,   রূমালির চোখে ভুমিকম্পে কাঁপতে থাকা ভবনগুলোর মতই ঠেকছে।  সে দেয়াল হতে যেমন চোখ সড়াতে পারছেনা; তেমনি প্রিন্টিং প্রেসের মেশিনের মতো খাটে বসে ঝুলানো পা দু’টির অস্থির নড়াচড়া থামাতে পারছেনা। ক্রুধান্বিত দৈত্য যেমন লাথি মেরে বাড়িঘর মাটিতে পিশিয়ে দিতে পারে, তেমনি তার পায়ের ঝুলানো অবস্থা যেন টুইনটাওয়ারের নরবড়ে অবস্থা।  রূমালি একমুহুর্তের জন্য তার সময় পূর্বমুহুর্তে ফিরে যায়।

একাদশ শ্রেণি শেষ করে দ্বাদশে পা রেখেছে সে।  আজই প্রথম ক্লাস হবে।  বন্ধুদের সাথে কতদিন পর দেখা হবে।  অনেক মজা হবে আজ।  কলেজ গেইটে ঢুকতেই, চোখ পড়লো একটি পায়রার দিকে।  বিদ্যুতবাহী তাড়ের উপর বসতেই, পায়রাটি রক্তশূন্য হয়ে মিনিট কয়েকপর মাটিতে পড়লো।  দৃশ্যটি মেনে নিতে কষ্ট হলো রূমালির । 

একটু পরেই সবকিছু যেন অন্ধকার হয়ে এলো।  সমস্ত পৃথিবী যেন ঘুরপাক খাচ্ছে।  আকাশ যেন ধপাস করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।  আর কিছু জানেন সে।  একঘন্টা পর একটি মাইক্রোবাসে একটি ছেলের কোলে নিজেকে আবিষ্কার করলো সে।  প্রথমে চিনতে না পারলেও,  পরে বুঝল এই সেই ছেলে যাকে সে ভালবাসতো।  কোন প্রশ্ন করার ধৈর্হ্যও তার ছিলনা তখন।  বিশ^স্ত নয়নে তাকিয়ে রইলো প্রেমিকের দিকে।  ভাবলো সে হয়তো সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য কোন পিকনিকে নিয়ে যাচ্ছে তাকে।  কিন্তু ছেলেটির অঙ্গভঙ্গিতে তার ধারণা মিথ্যে হলো। 

একটি অপরিচিত রাস্তা দিয়ে চলছে গাড়ি।  রূমালি এখন স্পষ্ট বুঝতে পারছে, সে কেমন বিপদমুখী।  কিন্তু তার সেই আক্ষেপ নেই।  চোখে জল নেই।  মুখে উজ্জ্বলতাও নেই।  গায়ে নেই উষ্ণতা।  সংকটময় ভাবনাও তার প্রতিচ্ছবিতে নেই।  কোন প্রতিক্রিয়াই যেন তাকে স্পর্শ করছেনা।  শুধু অপলক নয়নে তার প্রেমিক শান্ত ও প্রেমিকের বন্ধু বিপুলের দিকে চেয়ে আছে। 

রুদ্ধশ্বাসে থাকা প্রাণীটির মতোই সে,  নিস্তেজ।  হঠাৎ একটি মৌমাছি বিপুলের গাল ঘেষে বসলে,  তা অধির দৃষ্টিতে দেখতে থাকে রূমালি।  একসময় এটি গালে কামড় দেয়; কিন্তু বিপুল তখন ঘুমিয়ে ।  গাল ফুলতে শুরু করলো।  রূমালির ঠোটে কিছুটা হাসির ইঙ্গিত আসলেও মুহুর্তেই নিভে গেল।  অন্যদের এদিকে কোন খেয়াল নেই। 

অসামান্য বিপদের মধ্যেও রূমালি কেবল ভাবনায় হারিয়ে গেল।  গাড়ি চলছে তো চলছেই। রূমালির ছোট বোনের যখন জন্ম হবে,  তখন তার মাকে হাসপাতালে নেওয়ার সময় এম্বুলেন্সে সেও ছিলো।  ব্যথায় যখন তার মা ছটফট করছিলো,  তখন রূমালি দিশেবুদ্ধি হারিয়ে তার মাকে সুড়সুড়ি দিচ্ছিল। কারণ রূমালি যখন কাঁদতো,  তার মা ওকে সুড়সুড়ি দিয়ে কান্না থামাতো।

কিন্তু রূমালি সেই মুহুর্তে তা বুঝে ওঠতে পারেনি, যা এখন বুঝতেছে।  কিন্তু রূমালি কি এখন তার সাথে কি হতে চলেছে,  তা বুঝতে পারছে? হয়তো পারছে, হয়তো না।

একটি বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামলো।  রূমালিকে জোর করে গাড়ে থেকে নামালো শান্ত।  রূমালি তখনো কোন প্রশ্ন করার কথা ভাবতে পারলো না।  একঘন্টা পর একটি বদ্ধ ঘরে রূমালি ও শান্ত।  শান্ত দরজা বন্ধ করে দিলো।  অদেখা কালবৈশাখী ধেয়ে ধেয়ে আসতে শুরু করলো।  সমস্ত পৃথিবী কালো মেঘে আঁধারে ঢেকে গেল।  পাখ-পাখালির গুঞ্জন যেনো,  সমুদ্র গর্জনের সাথে ক্ষুধার্ত সিংহের গর্জনে মিশে গেল।  ঘন অমাবশ্যা নেমে এলো,  রাক্ষুসী রূপে।  শুধু দু’ফোটা ঘাম কপাল বেয়ে বেয়ে চোখে গিয়ে পরলো রূমালির। 

চোখ জ¦লছিলো ঠিকই,  তখনি রূমালি আক্ষেপহীন,  অভিযোগহীন।  ঘোর হতে বের  হয়ে কেবল ভাবলা-‘ আমি আর নই,  সেই আমি। ’
সকাল ঘনিয়ে এলো।  তার যত আর্তনাদ,  তা কেবল অশ্রুহীন চোখের বিশ^স্ত চাহনিতেই তলিয়ে গেল। তার বাবা শামসের আলী ছেলেটিকে পুলিশে দিয়ে মেয়েকে বাড়িতে নিয়ে গেল। এক সপ্তাহ পর,  নতুন পোষাক পরিধান করে রূমালি কলেজে গেল।  ক্লাস করল।  ভাবতে অবাক লাগলেও সত্যি,  তার মধ্যে পূর্বেকার সেই উদ্যমতা আর উচ্ছলতার অভাব লক্ষ্যণীয় হয়নি।  দু’য়েকজন বান্ধবী ঘটনা জানলেও তাকে দেখে বিশ্বাস করতে পারেনি। আনন্দ আর ভাবনার তরীতে নিজেকে ভাসিয়ে নিয়ে, গভীর দূরে হারিয়ে গেছে সে।

কলঙ্ক বলে কোন ছাপ তার ফ্রেমের প্রতিচ্ছবিতে নেই।  হাস্যোজ্জ্বল সবুজ শ্যামল প্রকৃতিই যেন তার মধ্যে বিচরণ করে।  যদিও সে প্রকৃতি ভিজেছে কালবৈশাখীর ঝড়ে, তবুও তা এখন সতেজে জেগে ওঠেছে।  ছয়মাস পর,  এক ডাক্তার ছেলের সঙ্গে রূমালির বিয়ে হয়।  মতামত নিয়ে তার কোন বাঁধা না থাকায় বাবা-মা হাফ ছেড়ে বাঁচলেন।  তারা বিষণ খুশি যে,  ছেলেটি অত্যন্ত নিষ্পাপ,  সুদর্শন ও মার্জিত স্বভাবের।  তবে বাবা-মায়ের মনে এও জেগেছে যে, ছেলেটিকে ঠকানো হলনাতো?

পরক্ষণে অবশ্য নিজেরাই নিজেদের সান্ত¡না দিয়েছে।  সে তো শুধুই একটা দুর্ঘটনা ছিল।  রূমালি কিন্তু সে বিষয়টি কখনো ভাবতেই চায়নি।  আর ভাববেই বা কেন? তবে কি...........? থাক এতো কিছু ভেবে কি হবে।  মানুষের ভাল থাকাটাই বেশি আবশ্যক। 
   
......................

No comments:

Post a Comment

Thanks for your comment