Friday, July 23, 2021

বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলামের ভূমিকা || পার্ট - ৩

 নজরুলের কবিতায় প্রেম চেতনাঃ

আগের পর্বগুলো পড়লে বুঝতে পারবেন, যে নজরুলের কাব্যের মূল দুইটি বিষয় হলো প্রেম ও বিদ্রোহ। প্রেম বিষয়ক কাব্যগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ‘অগ্নিবীণা’, ‘প্রলয় শিখা’, ‘চক্রবাক’, ‘ছায়ানট’, ‘দুলনচাপা’। নজরুলের প্রেমের কবিতা বাংলাকাব্যের বহুকাল আগের গীতিধর্মী যোগসূত্র পাওয়া যায়। প্রেম মানেই আবেগের বহিঃপ্রকাশ, প্রেম মানেই বিরহ, প্রেম মানেই নানা রকমের অনুভূতির লেনদেন। তেমনি নজরুলের কবিতায়ও আবেদ, দুঃখ-বিরহ মিশ্রিত রোমান্টিক কবিসত্ত্বার পরিচয় পাওয়া যায়। নজরুলের কাব্যে আবেগ ও বিরহ সমানতালে পাওয়া যায়। কারাগারে বন্দি হয়েও তিনি প্রেমের কবিতা রচনা করেছেন। ‘দোলনচাপা’ কাব্যটি তিনি রচনা করেন কারাগারে বন্দি অবস্থায়। তিনি তাঁর প্রিয়তমার স্মরনে লিখেছেন-          
“এত দিনে অবেলায়-
প্রিয়তম!
ধূলি-অন্ধ ঘূর্ণি সম
দিবাযামী
যবে আমি
নেচে ফিরি র”ধিরাক্ত মরণ-খেলায়-
এ দিনে অ-বেলায়
জানিলাম, আমি তোমা’ জন্মে জন্মে চিনি।
পূজারিণী!”
 
 

 নজরুলের কবিতায় প্রকৃতি প্রেমের স্বরূপঃ

নজরুলের কাব্যে  প্রকৃতি, প্রেম ও বিদ্রোহ এই তিনে মিলে একাকার। প্রকৃতি প্রেমের ইঙ্গিত পাওয়া যায় বিশেষকরে ‘চক্রবাক’ কাব্যে। প্রকৃতি-প্রেম এবং বিরোহ দ্বারা তিনি কাব্য জগতে এক অপূর্ব সৌন্দর্যবোধ সৃষ্টি করেছেন। প্রকৃতির টানে তিনি সারাজীবন ছুটেছেন এদেশ-ওদেশ এবং একশহর হতে অন্য শহরে। তাঁর রচিত খুব অল্প কবিতাই খোঁজে পাওয়া যাবে, যেখানে প্রকৃতি ও অতীত ঐতিহ্যকে ধারণ করেননি। কাজী নজরুল মানেই প্রকৃতি প্রেমী কবি। আর সেকারনেই তিনি লিখেছেন- 
 
“বিদায়, হে মোর বাতায়ন-পাশে নিশীথ জাগার সাথী ! 
ওগো বন্ধুরা, পান্ডুর হ’য়ে এল বিদায়ের রাতি ! 
আজ হ’তে হ’ল বন্ধ আমার জানালার ঝিলিমিলি, 
আজ হ’তে হ’ল বন্ধ মোদের আলাপন নিরিবিলি ”
চট্টলা শহরে বেড়াতে গিয়ে বন্ধুর বাসার ঘরের পাশের গোবাক তরু গাছের সাথে কবির সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। প্রতিরাতে জানালা খোলে গাছের পাতাদের সাথে নিবিড়ে কথা বলা। কবি হৃদয়ের বিরহ-বেদনার কথা তাদের সাথে প্রকাশ করা। শেষবেলায় কবি যখন বিদায় নেবে, তখন এসব গাছের দিকে চেয়ে কবি বিরহকাতর। প্রকৃতি প্রেমের নিদর্শন হিসাবেই কবির বেশ কিছু কাব্য ফুলের নামে ও বৃক্ষের নামে রচনা করেছেন। ‘দোলনচাঁপা’, ‘ঝিঙেফুল’, ‘ফণীমনসা’, ‘রাঙা-জবা’, ‘মহুয়া’—আরোও বহু নাম। 

বিদ্রোহী কবি হিসাবে কাজী নজরুলের আবির্ভাবঃ

কাজী নজরুল ইসলামের প্রকৃত পরিচয় তিনি বিদ্রোহী কবি। নজরুল ইসলাম  সমসাময়িক অন্যায়-অত্যাচারের বিরোদ্ধে কলম ধরেন। তিনি যেমন সারাজীবন দুঃখ-কষ্টকে সঙ্গী করে বড় হয়েছেন, তেমনি তিনি অভাবী, গরিব, দুঃখী, অবহেলিত, অত্যাচারিত মানুষের পক্ষ নিয়ে ব্রিটিশ শোষণের বিরোদ্ধে কথা বলেন এবং বহুবার কারাবরণ করেন। তাঁর কলমী আন্দোলন ও চেতনার বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ নির্মাণ করে বিদ্রোহী কবিতা। আর তাই  প্রতিবাদী নজরুল ইসলাম হয়ে উঠেন, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। নজরুল এর বিদ্রোহী-সত্তার ভিতরে বহুমাত্রা লক্ষ্য দেখা যায়। ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, জাত-বর্ণ ও ধর্মীয় বিভক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য বিদ্রোহ ছাড়াও সকল ক্ষেত্রে অসত্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। 
 
নজরুলের বিদ্রোহের স্বরূপ উন্মোচিত হয় ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যের ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়। এই কবিতায় তাঁর বলিষ্ঠ কন্ঠ ও বজ্রনিনাদ। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় কবি বলেন,
 
“আমি দুর্ব্বার, আমি ভেঙ্গে করি সব চুরমার!
আমি অনিয়ম উচ্ছৃংখল,
আমি দলে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!
আমি  মানিনাকো কোন আইন।”

নজরুল এই কবিতার দ্বারা শোষক শ্রেণীর প্রতি তীব্র হুংকার দেন। অনাচার ও অত্যাচারের বিরোদ্ধে সাধারণ মানুষের নিয়মের শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে আসার মুক্তির আহ্বান জানান। নজরুলের বিদ্রোহ একটি সত্যকে প্রকাশ করা। আর সেই সত্য হলো মুক্তির ও কল্যাণের সত্য। তাঁকেই প্রথমবারের মতো দেখা যায়, পূর্ণভাবে ভারতের স্বাধীণতা চাইতে। তাঁর কন্ঠের বজ্রনিনাদ, বলিষ্ঠ বিদ্রোহ চেতনার ফলাফল ফুটে ওঠে তার লেখার মধ্য দিয়ে।
 
“আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা, 
করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা ”

নজরুল কখনো ভীত হননি কোন শাস্তির ভয়ে। সেকারণেই বারবার জুলুম সহ্য করে কারাবরণ করেও তাঁকে ধমাতে পারেনি কেউ। আর এই কারনেই তিনি বিদ্রোহী কবি।

পার্ট-১ পড়তে ক্লিক করুন

 

পার্ট-২ পড়তে ক্লিক করুন


 

No comments:

Post a Comment

Thanks for your comment