রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জনপ্রিয় উপন্যাস 'চোখের বালি' র রাজলক্ষ্মী চরিত্র
'চোখের বালি' উপন্যাসের মনস্ত্বাত্তিক ও বাস্তবিক প্রেক্ষাপটঃ
'চোখের বালি' রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি অন্যতম মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস। সাহিত্য সমালোচকদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী এ উপন্যাসের মধ্য দিয়েই বাংলা উপন্যাসের বাঁক পরিবর্তন ঘটেছে । 'চোখের বালি' উপন্যাসটি একটি চরিত্রনির্ভর উপন্যাস, যেখানে কাহিনীর চেয়ে চরিত্রগুলোকে সনাক্ত করা যায় খুব সহজে এবং প্রতিটি চরিত্রই যেন লেখকের একেকটি জীবন্ত ও বাস্তব চরিত্র চিত্রায়ন করেছেন। তাই এই উপন্যাস কাহিনীনির্ভর তা বলা যায় না। উক্ত উপন্যাসে বেশ কিছু চরিত্র রয়েছে, যেখানে একটি উপন্যাসের কাহিনী হতে চরিত্রগুলো পরিলক্ষিত হয় বেশী।
'চোখের বালি' স্নেহ সুলভ দৃষ্টিভঙ্গিঃ
উক্ত উপন্যাসের চার নারী চরিত্রের মধ্যে রাজলক্ষ্মী চরিত্রটি অন্যতম। 'চোখের বালি'র নায়ক চরিত্র মহেন্দ্রের মা রাজলক্ষ্মী।স্বামীর মৃত্যুর পর হতে সমাজ সংসারে পুত্র মহেন ছাড়া আর কিছু রাজলক্ষ্মী বোঝে না, মহেনই তার সব। উপন্যাসটির কাহিনী নির্মিত হয়েছে রাজলক্ষ্মীর পরিবারকে কেন্দ্র করেই। রাজলক্ষ্মী ধনী বিধবা। তার একমাত্র পুত্র মহেন্দ্রকে নিয়েই সুখে-শান্তিতে বসবাস করে। আর দশজন মায়ের চেয়ে রাজলক্ষ্মী কিছুটা আলাদা। তার দৃষ্টিকোণ থেকে তার ছেলে মহেন্দ্রের চেয়ে ভাল ছেলে আর একটিও হয় না ।
মহেন যখন পড়াশোনায় এমএ পাস করে ফেলেছে এবং ডাক্তারি পড়া শোনা করছে তখনো তার মা তাকে আঁচলছাড়া করে না। মহেনের আহার, বিহার, আরাম— সবই রাজলক্ষ্মী কে ঘিরে। মা ছেলের যেন সব কিছুতেই দারোণ আদিক্ষ্যেতা। মা হিসাবে নিজের কাছে যেটা ভাল মনে হয় সে সম্পর্কে বিশ্বের লোককে উপেক্ষা করার মতো একটা স্বাভাবিক জেদ তার ছিল । তদুপরিও মহেনের যা কিছু ভাল লাগে রাজলক্ষ্মীর তা ভাল না লাগলেও সে তা ভাল না লাগিয়ে পারে না ।
রাজলক্ষী চরিত্রের দোষ-ত্রুটিঃ
মা হিসাবে রাজলক্ষী চরিত্রের অন্যতম দূর্বলতা হলো তার ছেলে যত অন্যায়, যত ভুলই করুক না কেন সে বিষয়ে যে কোন প্রকারেই হোক তা আড়াল করে রাজলক্ষ্মী বরং অন্যকে দোষারোপ করবে। রাজলক্ষ্মীর ইচ্ছে হয়েছে মহেন্দ্র বিয়ে করুক। কিন্তু মহেন বিয়ে করতে রাজি নয়। রাজলক্ষ্মী তার জা অন্নপূর্ণাকে নালিশ করে জানায় যে, অন্নপূর্ণা বলেছে— এখন ছোট ছেলেটির মতো ব্যবহার মানায় না। এতেই রাজলক্ষ্মী অন্নপূর্ণার উপর ক্ষেপে ওঠে— মহেন যদি অন্যদের চেয়ে মাকে একটু বেশি ভালবাসে তবে অন্যদের তাতে কী? রাজলক্ষ্মী তার সইয়ের সুদর্শনা সুশিক্ষিতা মেয়ে বিনোদিনীকে মহেনের সাথে বিয়ের কথা বলে কিন্তু মহেন বিয়েতে রাজি হয় না। অথচ জা অন্নপূর্ণার বোনঝি আশাকে বিহারীর জন্য দেখতে গিয়ে নিজেই পছন্দ করে বসে।
যদিও রাজলক্ষ্মী মহেনের এহেন কাজে মত দেয় নি, তাই দেখে মহেন বাড়ি ত্যাগ করে মেসে গিয়ে ওঠে। রাজলক্ষ্মী ছেলেকে খুব ভাল করেই জানে, তাই গোলযোগ হবার ভয়ে আশাকেই বউ করে ঘরে আনে আর সমস্ত দোষ দেয় অন্নপূর্ণাকে। কিন্তু মহেন যখন আবার আশালতাকে ফেলে বিনোদিনীর দিকে ঝুঁকে রাজলক্ষ্মী ছেলের দোষ না দিয়ে আশাকে দোষারোপ করতে শুরু করে। রাজলক্ষীর ধারণা, পুরুষ মানুষ কিছুটা বেপোরোয়া ও বিপথে যেতেই পারে, কিন্তু বউয়ের উচিত তাকে সামলে রাখা।
‘চোখের বালি' উপন্যাসের কাহিনীতে আবর্তন বিবর্তন ঘটিয়েছে তার পুত্র সর্বস্ব অভিমান ও বেসামাল মানসিকতা, যা তার চরিত্রকে কেন্দ্রে বসিয়ে দেয়। রাজলক্ষ্মীর অভিমানই পুত্রবধূ আশাকে খর্ব করেছে, আর একহাতে বিনোদিনীকে দিয়ে পুত্রকে প্রলুব্ধ করিয়েছে। এই উপন্যাসের রাজলক্ষ্মীর মধ্য দিয়ে আমরা প্রথম রক্তমাংসে গড়া আধুনিক মা চরিত্রের চিত্র পাই। সে কিন্তু শুধু মা নয়, একজন নারীও। ফলে তার আত্মকামিতায় আঘাতকারী পুত্রবধূর সুখ, এমনকি সন্তানের সুখও তার সহ্য হয় নি। বিনোদিনীর মাধ্যমে সে আশার প্রতি প্রতিশোধ নিয়েছে। অবুঝ পুত্রপরায়ণতা রাজলক্ষ্মী চরিত্রের দুর্বলতা এবং প্রধান বৈশিষ্ট্য।
রাজলক্ষী চরিত্রের ইর্ষা ও স্বভাবজাত দূর্বলতাঃ
আশালতার প্রতি রাজলক্ষীর মনোকষ্টের তিনটি বিশেষ কারণ খোঁজে পাওয়া যায়। এক- তার পুত্র মহেন্দ্র তার জা অন্নপূর্ণার বোনঝি আশাকে বিয়ে করেছে। সে যে কেবল অবহেলিত হয়েছে, তা নয়, আশার সাথে অন্নপূর্ণার পূর্ব থেকেই সম্পর্ক রয়েছে বলে রাজলক্ষ্মীর খুব অসন্তোষ ।
দুই— গর্বধারণকৃত মাতৃ হৃদয়ের অতি স্বাভাবিক ভাবনাগত ঈর্ষা। যেই ছেলে এতদিন তার আঁচলে বাধা ছিল, এখন সে নব্য বিবাহিত এবং স্ত্রীর প্রতি অধিক আনুগত্যশীল ।
তিন— মহেনের নব্য বিবাহিত স্ত্রী আশার গৃহকর্মে অনভিজ্ঞতা ও অপটুতা। আশাকে বিয়ে করার পর রাজলক্ষ্মী তার ছেলেকে পরীক্ষা পাসের প্রস্তুতি নিতে বললেও সে আশাকে নিজের কাছে রেখে ঘরকন্নার কাজ করায়। মহেনের এরূপ দৃশ্য মোটেও সহ্য হয় না ৷ তাই রাজলক্ষ্মী আশাকে মহেনের কাছে দিয়ে দেয়।
বিনোদিনীর প্রতি মোহ ও সন্তানের প্রতি জেদের স্বরূপঃ
রাজলক্ষ্মী তার পুত্রের স্ত্রৈণ ও বেহাল অবস্থা পরিলক্ষণ করে মান-অভিমান বুকে পোষে গ্রামের বাড়ি দেখার নাম করে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। বারাসতে যাওয়ার পর বিধবা বিনোদিনীকে দেখে তার উপর যারপরনাই মায়া জন্মায়। রাজলক্ষী বিনোদিনীর সেবা ও যত্নে বিষণ রকমের সন্তুষ্ট। বিনোদিনীর শিক্ষা-দীক্ষা, আধুনিকতা ও রুচিশীলতা, বুদ্ধি-সেবা-যত্নে তার বধূ বিদ্বেষ আরো বহুগুণ বেড়ে যায়। মহেন্দ্র বিনোদিনীকে বিয়ে না করে যে কি পরিমাণ ঠকেছে, তা প্রমাণ করতেই যেন রাজলক্ষ্মী বিনোদিনীর উপর সংসারের কর্তৃত্ব বুঝিয়ে দিয়েছে। আশার অনুপস্থিতিতে মহেন্দ্রের পরিচর্যার ভার দিয়েছে বিনোদিনীর উপর। রাজলক্ষ্মী ছেলের অপরাধ না দেখে বিনোদিনীর ঘাড়েই মহেন্দ্রের স্খলনের দোষ চাপিয়ে দেয় ।
আশার প্রতি বিশ্বাস ও যথাযথ মূল্যায়নঃ
বিনোদিনীও যখন তার আস্থার প্রতিদান দিতে ব্যর্থ হয়, তখন পুনরায় তার মন ভেঙ্গে যায়। সে আশার উপর বিশ্বাস ফিরে পায় এবং প্রসন্ন হন। পুত্রকে গৃহবাসী না করতে পারায় রাজলক্ষ্মী সম্পূর্ণ দোষ চাপায় আশার উপর এবং তার উপর বিরক্ত হয়। কিন্তু রাজলক্ষ্মীর শারীরিক অসুস্থতার কারনে আশার উদ্বেগ ও ব্যাকুলতা মিশ্রিত পরিচর্যা দেখে রাজলক্ষী অবশেষে আশার যথার্থ মূল্য দিতে বাধ্য হয়। মা হিসাবে রাজলক্ষ্মীর যে পুত্রসর্বস্বতা ও মাত্রাতিরিক্ত আদিক্ষ্যেতার কারণেই মহেন্দ্র নির্লজ্জ, অসংযত ভোগলিপ্সু হয়ে ওঠে, তা বুঝতে পারে। পুত্রবধূ আশার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে রাজলক্ষ্মী তার পছন্দের বিনোদিনীর দ্বারা পুত্রকে প্রলুব্ধ করেছে। অতি মাত্রায় অভিমান ও প্রবল আবেগপ্রবণতা যে রাজলক্ষ্মীর নিজের গৃহে নিজে6ই বিষবৃক্ষ রোপণ করেছিল, সেটা বুঝতে আর তার বাকি রইলো না।
রাজলক্ষ্মীর আবেগ ও অভিমানের দুলাচল থেকে বের হয়ে সে তার পুত্রের প্রতি তীক্ষ্ম দৃষ্টি সদা জাগ্রত এবং যে সূক্ষ্ম অনুভূতি জ্ঞাপন করে তাতে মহেন্দ্র-বিনোদিনীর অশালীন ও অনুচিত ঘনিষ্ঠতা তার দৃষ্টি এড়ায়নি। ‘চোখের বালি' উপন্যাসের সকল চরিত্রের মধ্যে যে জটিলতা, সক্রিয়তা ও প্রবাহমানতা তার কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছে রাজলক্ষ্মী চরিত্র। ‘চোখের বালি’ উপন্যাসে যে বৃত্তাকার প্রেমের কাহিনী প্রকাশ পেয়েছে তা কেবল মহেন্দ্র-বিনোদিনী-বিহারী-আশা-মহেন্দ্র এর মধ্যে ঘূর্ণায়িত হয়েছে। এ বৃত্তের কেন্দ্রে রয়েছে রাজলক্ষ্মী। রাজলক্ষীর এমন মানসিকতাই মূলত পুতুল নাচের অদৃশ্য সুতা হাতে রেখে সবাইকে তারই ইচ্ছেমত নাচিয়েছে এবং শেষে সুতার একটানে সবাইকে তার মৃত্যুশয্যায় টেনে এনে নিজেদের অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে সর্বৈব বিচারে ‘চোখের বালি' উপন্যাসের রাজলক্ষ্মী অত্যাধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্রে উজ্জীবিত মা-চরিত্রের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ৷
No comments:
Post a Comment
Thanks for your comment