সকল প্রশংসা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের। তাঁহার নামেই শুরু করছি। আমি তৌসিফ। আমরা তিন ভাই-বোন, অর্থাৎ দুই ভাই এক বোন। আমি মেঝো। আমার বড় ভাই আমার থেকে দুই বছরের বড় হলেও আমার বোন সুবর্ণা আমার থেকে সাত বছরের ছোট। আমার বাবা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। ছোট বড় কয়েকটা প্রতিষ্ঠানের মালিক তিনি। ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে মিলিয়ে আমাদের আটটা বাড়ি আছে। গাড়িও আছে চারটা। আশ্চর্য হলেও সত্যি আমি কোন গাড়ি ব্যবহার করিনা; এমনকি আটটি বাড়ির মধ্যে ছয়টি বাড়িতেই আমার কখনো যাওয়া হয়নি। স্থায়ীভাবে আমরা সবাই একই বাড়িতে বসবাস করছি। আমার বড় ভাই বাবার মতোই বিচক্ষণ আর উচ্চাবিলাসী। পড়াশোনায় খুব সুবিধা করতে না পারলেও তার বিচক্ষণতার ছাপ পাওয়া যায়, বাবার সাথে ব্যবসায় ক্ষেত্রে। কোন রকম ইন্টারমিডিয়েট সম্পন্ন করেই সে বাবার সাথে ব্যবসায়ের হাল ধরেছে। তার তুলনায় আমি পরিবারের সবার কাছে অকম্মার ঢেকি।
কারণ বাবার কোথায় কোন ব্যবসায় আছে, কোন কিছুই আমি জানি না। আমার বোনটিও অনেকটা বড় ভাইয়ের মতোই বিচক্ষণ এবং বিলাসী। বড় লোকের মেয়ে হিসেবে বিলাসী হওয়াটা তাকে মানায়। আমি তার এবং পরিবারের সবারই চক্ষুশূল। সকলের অপ্রিয় হওয়ার কারনটা পরে বলছি। আমার আরোও একটা পরিচয় আছে আমার পরিবারে ‘পাগল’। পরিবারের বাইরেও আত্মীয় মহলে এই নামের পরিচিতি আছে। আমাকে পাগল বলার কারনটা বলার আগে বলে নেওয়া ভাল যে, গল্পটি মূলত আমার বোন সুবর্ণাকে নিয়ে। সে এখন হসপিটালের আইসিওতে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রয়েছে। ডাক্তাররা বলছে বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম, মাথায় তীব্র আঘাতের কারণে অনেক বড় ফ্রেকচার হয়েছে। আমার বোনটির এই দশার জন্য দায়ী আমার বাবা অঢেল টাকা, মায়ের অত্যাধিক আধিক্ষ্যেতা এবং বড় ভাইয়ের পশ্রয়। যদিও এখন দায় সারাভাবে সবাই নিজের কর্ম নিয়ে ব্যস্ত। হসপিটালে কেবল আমিই আছি ওকে দেখার জন্যে।
দীর্ঘদিন ধরে একটা ছেলের সাথে তার রিলেশন ছিলো। মূলত ছেলেটা তার সৌন্দর্যে যতটা না তাকে ভালোবেসেছে, তার টাকাকে বেসেছে বেশি। বিষয়টা সুবর্ণা বুঝতো, কারন শুরু থেকেই বিভিন্ন সময় রৌনক তার কাছ থেকে হিসেব ছাড়া টাকা নিয়েছে কিন্তু তাকে হারানোর ভয়ে আমার বোন কখনো কোন এটেম্পট নেয়নি। সুবর্ণার টাকার প্রতি খুব ফেসিনেশন ছিলো, শৈশব থেকেই সে বিলাসী জীবন-যাপন করেছে। প্রয়োজনের চেয়ে অপ্রয়োজনেই অর্থ ব্যয় করেছে বেশি। তার বেশ কয়েকটা ভিসা ও ক্রেডিট কার্ড রয়েছে। বেশ কিছুদিন ধরে তার অযৌক্তিক অর্থ ব্যয় দেখে আমার মা কিছুটা সাবধান হতে চাইলেন, আর তার ক্রেডিট কার্ডগুলো লুকিয়ে রাখলেন।
ঠিক সেই মুহুর্তে রৌনক নাকি তার কাছে পঞ্চাশ লাখ টাকা চেয়েছিলো। সে জানে রৌনক টাকাটা পেলে আর দেশে থাকবেনা; এমনকি তার প্রতি যে রৌনকের কোন আন্তরিকতা নেই এটা অনেক আগেই বুঝেছে। কিন্তু তার প্রতি দুর্বলতার জন্য তাকে ছাড়তে পারেনি। পরশু দিন সকালে আমার স্ত্রীকে সুবর্ণা কেঁদে কেঁদে বলছিলো, “ভাবি, আমার সব শেষ হয়ে গেলো। রৌনক আর আমাকে চায় না। সে আমাকে ডিচ করেছে। আমার কাছে পঞ্চাশ লাখ টাকা চেয়েছিলো, আমি দিতে রাজি হইনি। তাই সে আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। আমি এখন কী করবো ভাবি?”
সুমি আমার স্ত্রী, তাকে বললো, “তুমি ধৈর্য ধরো। যে তোমাকে ভালোবাসবে সে টাকা নয়, যেকোন মূল্যে তোমাকেই চাইতো। সে তোমাকে চায় না এটা তুমি ভালো করে জানো। শান্ত হও। স্বাভাবিক জীবন-যাপন করো। হয়তো তোমার জন্য ভালোই হয়েছে।”
কিন্তু এতে সে কনভিন্স নয়। সকল বন্ধু-বান্ধবের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। কেউ ফোন দিলে রেসপন্স করেনা। সারাদিন ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমায় আর মাদক সেবন করে। এটা অবশ্য নতুন কিছু নয়। যখনই তার কোন সমস্যা হতো সে এমন করতো।
গতকাল সে মায়ের ঘরে গিয়ে তার সাথে চড়াও হয়। মাকে বলে- “আম্মু আমার কার্ডগুলো দিবে কিনা বলো?”
মা বলল- “কিছুদিন পরে দেবো।”
“আমার এখনই লাগবে। তুমি এখনি আমাকে আমার কার্ডগুলো দিবে।”
ওর দুর্ব্যবহারের মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ায়, মা তার কার্ডগুলো ফেরত দিলো। সে তখন মাকে বললো, “এখন থেকে আমি ধানমন্ডির আটতলা ভবনে থাকবো। আমি এখনই চলে যাবো সব কিছু নিয়ে।”
মা বললো, “কেনো কি হয়েছে তোর? এমন করছিস কেনো?”
“তোমাদের কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই।”
এই বলে চলে গেলো। শুনেছি ব্যাংকে যত টাকা ছিলো সব টাকা তুলে নিয়ে বাসার সিন্ধুকে রেখেছে। ওর ফোন কল রেকর্ডার অন করা থাকতো। কল রেকর্ড থেকে জানতে পারি, সুশ্মিতা নাতে ওর এক বান্ধবী কল দিয়েছিলো। কল করে যা বলল- “সুবর্ণা চল ঢাকার বাইরে থেকে ঘোরে আসি।”
“নারে, আমি এখন কোথাও যাবোনা।”
সুশ্মিতা- “কেনো?’’
“রৌনক আমাকে ডিচ করেছে। আমার মন খুব খারাপ। এছাড়া আমি বাসা থেকে ধানমন্ডির বাসায় চলে এসেছি। কয়েকদিন যাবৎ কেউ একজন আমার ব্যাংক একাউন্ট হ্যাক করার চেষ্টা করছে। আমার ফোনে বারবার ওটিপি’র এসএমএস আসছে। ওটিপি কন্ফার্ম কনফার্ম করতে পারছেনা, তাই টাকা ট্রান্সফার করতে পারছেনা। কিন্তু আমার মনে হয় একসময় সে একাউন্ট হ্যাকও করে ফেলবে। তাই ব্যাংকের সকল টাকা তুলে সিন্ধুকে এনে রেখে দিয়েছি। এই অবস্থায় আমার ঢাকার বাইরে যাওয়া ঠিক হবেনা। তুই না হয় আমার বাসায় চলে আয়, দু’জন মিলে গল্প করবো।”
সুশ্মিতা- “ঠিক আছে আমি বিকালে আসবো।”
“ঠিক আছে।”
বাসার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে জানতে পারলাম, সুশ্মিতা চারটা বাজে বাসায় এসেছে। প্রথমে কিছুক্ষণ স্বাভাবিক কথা বলতে দেখলাম। এরপর উভয়ে উভয়ের সাথে চড়াও হয়ে কি যেনো বলছিলো। সুবর্ণা অন্য রুমে গেলো সুশ্মিতাকে বসিয়ে। এবার সুশ্মিতা সিন্ধুকের হ্যান্ডেল ধরে টান দিয়ে সিন্ধুুকের দরজা খুলে ফেললো, যদিও এটা সিকিউরলি লক করা ছিলো। সুবর্ণা পাশের রুম থেকে এসে দেখলো, সিন্ধুকটি খোলা এবং কোন টাকা এর ভিতর নেই। হঠাৎ করে রৌনক ভেসে উঠল তাদের মাঝে। তার হাতে ছিলো অনেক বড় ড্রিল মেশিন ও মাথায় হেলমেট। অর্থাৎ সে যেকোন উপায়ে বাসায় প্রবেশ করে সিন্ধুকের পিছন থেকে খুব সতর্কভাবে ড্রিল মেশিন ব্যবহার করে সকল টাকা সরিয়ে ফেলে এবং পরে সুবর্ণাকে জানায় সে কিভাবে সবকিছু করল।
সুবর্ণা তাদের হেন ঘটনায় চড়াও হলে রৌনকের হাতে থাকা ড্রিল মেশিন দিয়ে তার মাথায় আঘাত করে এবং সুবর্ণা রক্তাক্ত হয়ে মাাটিতে লুটিতে পড়ল।। এরপর ওরা পালিয়ে গেলো। সুশ্মিতার ফোন ট্রেস করে জানা যায়, রৌনকের সাথে তার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ছিলো। এছাড়া রৌনক এই বাড়িতে এর আগেও দুইবার এসেছিলো, তা সিসিক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়। যেহেতু রৌনক আগে থেকেই বাসার অবস্থান জানতো, তাই সুশ্মিতার কাছ থেকে টাকার সন্ধান পেয়ে তা সরিয়ে নেওয়ার মাস্টার প্লান করে। যদিও সব কিছুই প্রকাশ পেয়েছে এবং তাদের দু’জনকেই পুলিশ গ্রেফতার করেছে। কিন্তু মোটের উপরে আমার বোন হসপিটালে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।
এবার আসি মূল গল্পে। আমাকে বাসায় সবাই পাগল বলতো। খুব ছোটবেলা থেকেই আমি নিয়মিত নামাজ, রোজার প্রতি খুব আন্তরিক ছিলাম। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কখনো অর্থ অপচয় করতাম না। সকলর শ্রেণীর মানুষের সাথে মিশতাম এবং সাধারণ মানুষের মতো সারাদিন পড়াশোনার পাশাপাশি অনেক পরিশ্রমের কাজ করতাম। সুযোগ পেলেই মানুষের কাজে সাহায্য করতাম। সবাই আমাকে পছন্দ করতো। উচুশ্রেণীর চেয়ে নিচু শ্রেণীর মানুষের সাথেই আমি বেশি মিশেছি; এমনকি কখনো খুব দামী পোষাক ও পড়িনি। সাধারণ এই জীবনযাপনে আমার বাসার সবাই আমার প্রতি বেশ বিরক্ত হতো। এছাড়া বড় ভাইয়ের মতো আমিও যদি ব্যবসায় মনোযোগী হতাম তাহলে হয়তো আমাদের সম্পদ আরো বেশি হতো, এই ধারণা তাদের। স্কুল পাশের পর থেকেই আমি টিউশনি করে নিজের খরচ চালাতাম। বাবার কাছে খুব কম সময়ই টাকা চেয়েছি। কখনো টাকা দিতে চাইলে আমি নিতাম না, তাই তাদের কাছে আমাকে অস্বাভাবিক মনে হতো।
যেহেতু আমার পরিবারের লোকজনের ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি অনিহা তাই আমার সবরকমের ইবাদত তাদের কাছে বাড়াবাড়ি মনে হতো। শিক্ষামূলক কোন কথা বললেই আমাকে বলতো আমি পাগল। আমি উন্মাদ। আমি মানসিকভাবে অসুস্থ; এমনকি দু’য়েকবার আামার মা আমাকে মানসিক ডাক্তার দেখাতেও নিয়ে গিয়েছিলেন। যখন রাগ করার মানে বুঝতাম না তখন কেউ আমায় পাগল বললে আমি খুব ক্ষেপে যেতাম। যখন বুঝলাম রেগে গিয়ে নিজের আচরণকে অসংযত ও উগ্র করে আমি বরং ভুল মানসিকতার পরিচয় দিচ্ছি, তখন থেকে রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছি। আমি শিখেছি ধৈর্য্যই মহত্তের লক্ষণ। যাকে আল্লাহ হেদায়াত না দেন, সে আমার কথায় কতটাইবা পরিবর্তন হবে। আর আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তিনি তোমাদের জন্যে দ্বীনের ক্ষেত্রে সে পথই নির্ধারিত করেছেন, যার আদেশ দিয়েছিলেন নূহকে, যা আমি প্রত্যাদেশ করেছি আপনার প্রতি এবং যার আদেশ দিয়েছিলাম ইব্রাহিম, মূসা ও ঈসাকে এই মর্মে যে, তোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত কর এবং তাতে অনৈক্য সৃষ্টি করো না। আপনি মুশরেকদেরকে যে বিষয়ের প্রতি আমন্ত্রণ জানান, তা তাদের কাছে দুঃসাধ্য বলে মনে হয়। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা মনোনীত করেন এবং যে তাঁর অভিমুখী হয়, তাকে পথ প্রদর্শন করেন।”-সুরা-আশ-শূরা, আয়াত-১৩
এবং আরোও বলেন, “আর যাকে আল্লাহ্ হেদায়াত করেন তার জন্য কোন পথভ্রষ্টকারী নেই; আল্লাহ কি পরাক্রমশালী, প্রতিশোধ গ্ৰহণকারী নন?” - সুরা- আয-যুমার, আয়াত-৩৭
আমার পরিবারের প্রতিটি মানুষ অর্থ, আভিজাত্য আর আধুনিক পৃথিবীর সাথে স্রোতে গা-ভাসিয়ে চলে। দুনিয়াটা তাদের কাছে কৃত্রিম স্বর্গ। কিন্তু তারা জানতে কিংবা বুঝতে চায় না, একদিন সন্ধ্যা হবে, আলো ফুরাবে, পাখিদের কোলাহোল স্তব্দ হবে, অন্ধকারে আবৃত হবে পৃথিবী। তখন তাকে দাড়াতে হবে চরম বাস্তবতায়। যেদিন নিশ্বাসটা বন্ধ হবে, এরপর থেকেই তাদের দুনিয়ার রংঢং শেষ হয়ে যাবে। শেষ হবে অবৈধ সম্পর্কের ও হারাম জীবিকার।
সুবর্ণা শৈশব থেকেই ছিলো খামখেয়ালি স্বভাবের। বিশেষ করে অপচয়ের ক্ষেত্রে তার জুড়ি নেই। জীবনে অভাব কী জিনিস জানেনি সে। দেখেনি বাহিরের জগতের বাসিন্দাদের। অহংকার, বিলাসীতা, অবাধ মেলামেশা এবং মাদক সবকিছুর মূলেই ছিলো প্রচুর টাকা পয়সার সহজলভ্যতা। ধর্মীয় মূল্যবোধ, ইসলামের অনুশাসন কখনোই পায় নি। সকলের বাড়তি আদর এবং শাসনের অভাবে যারপরনাই চলাফেরা করতো সে। অন্য সকলের মতো সে আমাকে পছন্দ করতো না আমি ইবাদত করি বলে। তার কাছে আল্লাহর উপাসনা করা পাগলামি ছাড়া কিছু না। মৃত্যুর পরে আখেরাতে নেই কোন বিশ্বাস। যদিও আমার পরিবারের অন্য সদস্যরা ওকেশনাল ধার্মিক; মানের ঈদ উদযাপন এবং লোক দেখানো ধর্ম পালন।
আজ সুবর্ণার এমন অবস্থার জন্য দায়ী আমার বাবা-মা ও বড় ভাই। ছোট শিশুর হাতে যেখানে খেলনা তুলে দেওয়ার কথা, তাকে দেওয়া হয়েছিল টাকা। সারাদিন টাকা নিয়ে খেলতো। দিনদিন যখন বড় হচ্ছিল তখনো তাকে টাকার সঠিক ব্যয় সম্পর্কে শিক্ষা দেয়নি, বরং দামি দামি ড্রেস, স্কুটি, গাড়ি, মোবাইল, ট্যাব ও ল্যাপটপ হাতে তুলে দিয়েছে শৈশবেই। যা পেয়ে সে মেতে থাকতো হৈ চৈ বিনোদন, সিনেমা, আড্ডাবাজি, ভিডিও গেমস এবং রোটিন বিহীন অনিয়মের জীবন। যেখানে অর্থের অভাবে মানুষ তার সামান্য শখ পূরণ করতে পারেনা, সেখানে অর্থ তার জীবনকে নরকে পরিণত করেছে।